ক্যাম্পাস ক্যারিয়ার ডেস্ক : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) স্থাপত্যের শেষ বর্ষের ছাত্র চন্দন দেওয়ান। বাড়ি খুলনায়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুবাদে এখন সিলেটও তাঁর আপন। তাই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ‘বারকি’ নৌকার মডেল তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তাঁর তৈরি মডেলটি এখন গোয়াইনঘাটের পর্যটন ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিলেট অঞ্চলে প্রায় ৩০০ বছর আগে বর্ষাকালে জলজীবিকার হাতিয়ার হিসেবে মালবাহী একটি নৌকার প্রচলন শুরু হয়। স্থানীয় নাম ‘বারকি’। সাদামাটা লম্বা আকৃতির নৌকাটির নির্মাণ ও ব্যবহার শুধু সিলেটেই হতো। তাই অনেকের কাছেই বারকি ছিল অচেনা। প্রথম আলোয় সচিত্র একটি প্রতিবেদনের সুবাদে বারকি নতুন করে পরিচিতি পায়। এরপর ঐতিহ্যবাহী বারকি নিয়ে পর্যটন ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয় গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। শাবিপ্রবির স্থাপত্য বিভাগের দুজন শিক্ষকের সহায়তায় বারকির মডেল তৈরি করেন শিক্ষার্থী চন্দন দেওয়
সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে গোয়াইনঘাট প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রসমৃদ্ধ একটি উপজেলা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের পাহাড়, নদী আর চা-বাগানের সবুজঘেরা জাফলং, পাহাড়ি ঝরনার পান্তুমাই, পাথরের প্রাকৃতিক শয্যার বিছনাকান্দি, জলাবন রাতারগুল—সবই এই গোয়াইনঘাটে। প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন। মুগ্ধ পর্যটকেরা স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান কেবল ছবি আর ভিডিও। কিন্তু এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই কোনো স্মারক যদি তৈরি করা যায়, তা হয়তো পর্যটন ব্র্যান্ডিংয়ে কাজে আসবে। সেই ভাবনা থেকেই প্রশাসন বারকির মডেল তৈরির উদ্যোগ নেয়।
বিভিন্ন বই ও গবেষণা থেকে স্থানীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে বারকি নৌকা এসেছে ঘুরেফিরে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৭৫৭ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে সিলেট অঞ্চলে বারকি নৌকার প্রচলন হয়। সে সময় সিলেটে বসবাসরত ‘মি. জন বারকি’ নামের এক ব্রিটিশ নাগরিকের নকশায় প্রথম তৈরি হয় লম্বা আকৃতির একটি বিশেষ নৌকা। তখন এই নৌকায় শুধু চুনাপাথর পরিবহন করা হতো। সেই থেকে নৌকার নাম ‘বারকি’।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান জানালেন, পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত গোয়াইনঘাটের জাফলং-বিছনাকান্দিতে রয়েছে বালু-পাথর আহরণক্ষেত্র। এ জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে বারকি নৌকা। প্রতি বর্ষায় অন্তত ৫০ হাজার বারকি নৌকা চলাচল করে। এই নৌকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষাধিক মানুষের শ্রম-ঘাম। এই শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানাতেই বারকিকে ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র ইউএনও তাহমিলুর। তিনিই স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক কৌশিক সাহা ও গৌরপদ দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের স্থাপত্যভাবনার বাস্তবায়ন করেন শিক্ষার্থী চন্দন দেওয়ান। এ কাজে সহায়তা করেছেন স্থাপত্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিস আহমদ। স্থপতি কৌশিক সাহা বলেন, নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে যেকোনো কাজ করাটা আনন্দের। স্বল্প সময়ে কম খরচে নিজেদের ঐতিহ্য বারকি নৌকাকে চোখের সামনে আকর্ষণীয় করে রাখার কাজটি সুন্দরভাবেই হয়েছে।
চন্দন দেওয়ানও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে খুব খুশি। এ রকম নৌকা তিনি সিলেটে এসেই প্রথম দেখেছেন। স্থাপত্যের ছাত্র হিসেবে নৌকাটির নির্মাণশৈলী শুরুতেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। বারকি নিয়ে এখনো কাজ করছেন চন্দন। জানালেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে মডেল তৈরির প্রস্তাব পেয়ে তিনি জাফলংয়ে গেছেন। বারকি নৌকা, এর সঙ্গে জড়িত মানুষের জীবন-জীবিকা দেখে কাজটি করেছেন। সহজভাবে তৈরি, কম খরচ ও সহজে বহনযোগ্য—এ তিন বিষয় স্থাপত্যভাবনায় রেখে বারকি মডেল করা হয়েছে। ১২ ইঞ্চি লম্বা ও ৪ ইঞ্চি উচ্চতার কাচের বাক্সে মডেল নৌকাটি রাখা হয়েছে। এক পাশে থাকছে বইঠাও। মডেলটিতে নৌকা ও বইঠা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বালসা কাঠ। প্রাথমিকভাবে ৫০টি নৌকা নির্মাণ করা হয়েছে। একেকটির জন্য খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকা। চন্দন জানালেন, একসঙ্গে অনেকগুলো তৈরি করলে খরচ কমবে।
চন্দন দেওয়ানের পড়ার টেবিলে বইখাতার সঙ্গে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বারকি তৈরির নানা উপকরণ। স্থাপত্যের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার মাথায় কাজটি এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। একটি কাজের মধ্য দিয়ে পুরোনো ঐতিহ্যের সঙ্গী হতে পারা খুবই আনন্দের। এটা শিক্ষাজীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
বারকি নৌকার মডেল তৈরি করেছেন শাবিপ্রবির চন্দন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ