প্রত্যাশা ডেস্ক: ইরানের নাম শুনলে মনে হতে পারে, সেখানে নারীদের আইস হকি খেলার পরিবেশ নেই। তবে দেশটির অত্যন্ত রক্ষণশীল মূল্যবোধ আর আর্থিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে জয় করে ঠিকই আইস হকি খেলে যাচ্ছেন ইরানি নারীরা। আইস হকির জগতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন তাঁরা।
মাত্র তিন বছর আগে ইরানে নারী আইস হকি লিগের যাত্রা শুরু হয়। এর সদস্য সোহেইলা খোসরাভি বলেন, ‘প্রথমবার যখন আমাকে একটি স্টিক দেওয়া হলো, তখন থেকেই আমি এই খেলার প্রেমে পড়ে গেলাম।’
তেহরানে আইস হকি খেলতে দুই বছর আগে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন খোসরাভি। তেহরানের আইস রিংকটি (আইস হকি খেলার জায়গা) ইরানের একমাত্র অলিম্পিক আইস রিংক।
ইস্পাহান প্রদেশের ১৭ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় বলেন, ‘এখানে একা একা থাকাটা কঠিন, তবে হকিকে ভালোবাসার কারণে এটা করতে হচ্ছে।’
খেলোয়াড়দের অনেককে প্রায়ই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ থেকে শুরু করে কারিগরি ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে পোশাকসংক্রান্ত বিধিনিষেধ জারি হয়। সেই ইসলামি বিধি অনুযায়ী নারী খেলোয়াড়দের বাধ্যতামূলকভাবে মাথায় হেলমেটের নিচে হিজাব পরতে হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বড় শহরগুলোতে ইসলামি পোশাকবিধি লঙ্ঘনকারী নারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
ইরানে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম নারী আইস হকি লিগের আসর শুরু হয়। তবে যাত্রা শুরুর পর প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যেই এ আয়োজনের উল্লেখজনক উত্থান হয়েছে।
২০২৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল আইস হকি ফেডারেশন (আইআইএইচএফ) এশিয়া অ্যান্ড ওশেনিয়া কাপের ফাইনালে ফিলিপাইনকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইরানের নারী দল। তারা ওই আসরে অপরাজিত ছিল।
এ জয় খেলার জগতে ইরানের এক বিরাট অগ্রগতির স্মারক হয়ে গেল। আর এর হাত ধরে ইরানে অবহেলিত এ খেলাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো জায়গা তৈরি হয়।
পুরুষদের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক কাভেহ সেদঘি বলেন, ‘হকি এমন একটি খেলা, যা খেলতে সাহস ও নির্ভীকতার প্রয়োজন হয়। আর আপনারা দেখবেন, ইরানের নারীদের মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্য আছে।’
বর্তমানে ইরানের আইস হকি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত আছেন সেদঘি। তিনি আরও বলেন, ইরানই একমাত্র দেশ, যেখানে পুরুষ আইস হকি খেলোয়াড়ের চেয়ে নারী খেলোয়াড় বেশি।
তেহরানের রিংকে দেখা গেল, দুই নারী দলের মধ্যে লড়াই চলছে। দুটো দলই জয়ী হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আর শত শত নারী ও পুরুষ দর্শক চিৎকার করে তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। এম. আর নামের দলটির খেলোয়াড়েরা পরেছেন লাল ও সাদা রঙের জার্সি, আর পান্ডা নামের দলটির খেলোয়াড়েরা সবুজ ও কালো রঙের জার্সি। চলতি বছরের আসরে এ দুটি দলসহ মোট ছয়টি দল অংশ নিয়েছে।
তরুণী খেলোয়াড়েরা বরফের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন, ইরান মল আইস রিংকে দক্ষতার সঙ্গে পাক দেন। দেশের মাত্র চারটি আইস রিংকের মধ্যে একটি ইরান মল আইস রিংক। ছয় বছরেরও কম সময় আগে এটির যাত্রা শুরু হয়।
ইরানে আইস হকি তদারক করে দেশটির স্কি ফেডারেশন। নবগঠিত নারী লিগকে সহযোগিতা করতে গত আগস্টে মেয়েদের আইস হকি লিগ শুরু করে স্কি ফেডারেশন। তবে হকির এমন আসরের আয়োজন করাটা প্রতিবন্ধকতাহীন ছিল না।
জাতীয় দলের খেলোয়াড় দোরসা রাহমানি বলেন, ‘খেলার সময় আমরা হিজাববিধি মানি এবং না, আমাদের কোনো বিধিনিষেধ নেই।’
১৯ বছর বয়সী ওই খেলোয়াড় আরও বলেছেন, তাঁদের জার্সিগুলো দেখতে একেবারে পুরুষদের জার্সির মতোই। মাঝেমধ্যে এমনও হয় যে ছেলেরা খেলছে নাকি মেয়েরা খেলছে, তা বোঝা যায় না।
এরপরও আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আরেকটি উল্লেখযোগ্য বাধা। কারণ, অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদই অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল পরিবারের সন্তান।
ইরানের নারী দলের কোচ আজম সানায়ি বলেন, ‘তাদের উৎসাহ আছে, তবে খরচের বিষয়টি তাদের জন্য বড় বাধা।’
এর ব্যাখ্যা দিয়ে কোচ বলেন, একটি হকি স্টিক প্রতি দুই মাস অন্তর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। এর দাম প্রায় ২০০ ডলার, যা ইরানে গড় মাসিক বেতনের সমান।
সানায়ি মনে করেন, এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও খেলোয়াড়দের মনোবল অনেক। তাঁরা অনেক সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন।
রাহমানির কণ্ঠেও একই কথা প্রতিধ্বনিত হলো। জাতীয় দলের জার্সি পরা এই তরুণ খেলোয়াড় অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা ফলাফল পেতে কঠোর পরিশ্রম করি।’