প্রত্যাশা ডেস্ক: মৌসুম পরিবর্তন ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দীর্ঘায়িত হয়েছে। আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত তিন মাসের তুলনায় এ মাসের ২৫ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
চলতি বছরে ডেঙ্গুরোগী বাড়তে শুরু করে মে মাস থেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুলাই মাসে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আগস্টে ভর্তি ছিলেন ১০ হাজার ৪৯৬ জন, মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। সেপ্টেম্বর মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন, মৃত্যু হয় ৭৬ জনের।
অক্টোবর মাসে মাত্র ২৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৯৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এদিকে শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৪৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে চারজনের। ফলে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬৩ জনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে দেরিতে বৃষ্টিপাত ও অস্থিতিশীল আবহাওয়া এডিস মশার বিস্তারে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। এ কারণে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রোগী বাড়লে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ে। এবারের ভয়াবহতা ২০১৯ সালের মতো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ১৪৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৮৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২১ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৬৫ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৫৪ জন, ঢাকা বিভাগে ২৮২ জন, খুলনা বিভাগে ৬৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৬ জন, রংপুর বিভাগে ৫০ জন এবং সিলেট বিভাগে ৮ জন ভর্তি হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় মারা গিয়েছে চারজন। বরিশাল বিভাগে দুইজন রাজশাহী বিভাগে একজন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একজন।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৬৫ হাজার ৪৪০ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। রাস্তায় কিংবা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পানি জমে এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘দেরিতে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, এই অবস্থায় এসে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এবারের ধরন একটু ব্যতিক্রম। জলবায়ুর পরিবর্তন, দেরিতে বৃষ্টিপাত, স্থানীয় সরকার পরিবর্তন, মেয়র ও কাউন্সিলর না থাকা, মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগের অভাব- এগুলোই প্রধান কারণ। সাধারণভাবে স্প্রে করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু এখন লক্ষ্যভিত্তিকভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সরকার নয়, কমিউনিটি মবিলাইজেশন বাড়াতে হবে। বাসাবাড়ি, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে, কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুর বর্তমান ধাক্কা জানুয়ারি পর্যন্ত টিকতে পারে। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে মশার উপদ্রব কমে যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক লাখ ১ হাজার ৩৭৪ জন আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। ২০২৫ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৫ হাজার ৪৪০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৬৩ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় কম হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যে প্রায় ১০০ জন বেশি।
২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন, মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। ২০২২ সালে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন, মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। ২০২৩ সালে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়- সে বছর আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২০২৪ সালে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের।
বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বয়সসীমার মানুষ কর্মজীবী ও চলাফেরায় বেশি সক্রিয় থাকায় তারা বেশি মশার সংস্পর্শে আসছে।
এসি/আপ্র/২৭/১০/২০২৫




















