ঢাকা ০৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

বাজেট ২০২৪-২০২৫ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

  • আপডেট সময় : ১২:০৩:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০২৪
  • ১৬৫ বার পড়া হয়েছে

নীলাঞ্জন কুমার সাহা : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ৬ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের আগামী বাজেটকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। যেমন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা মজুত হ্রাস, লেনদেনে অস্থিতিশীলতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ।
অধিকন্তু, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বাড়তি চাপও সামাল দিতে হবে। তাই, এতসব নেতিবাচক অর্থনৈতিক নিয়ামকের চাপ সামাল দিয়ে বাজেটের মাধ্যমে সমষ্টির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেটের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে। বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশে ও মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা থাকতে পারে।
বাজেটে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এনবিআর এর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। আর বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি বিগত বছরের ন্যায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে মেটানোর সম্ভাবনা থাকবে।
আকার যাই হোক না কেন, আসন্ন বাজেটের মূল লক্ষ্যই হবে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে আনা। কেননা, মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে বর্তমান সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ও নির্মম ঘাতক। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। লাগামহীন, অনবরত। সাধারণ মানুষের জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে। এর ভয়ংকর আঘাতে নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে।
আর মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস অবস্থা। সরকারের সব প্রচেষ্টায় এর কাছে ধরাশায়ী। দেখে মনে হচ্ছে, অর্থনীতি যেন নিজেই দিশাহারা। এর আস্ফালনে দেশের অন্যান্য অর্জনগুলো ম্লান হয়ে পড়ছে। তাই, মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ সর্বাগ্রে। অন্যান্য সমস্যা পরে মোকাবিলা করা যেতে পারে।
সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। যদিও বাজেট ঘোষণায় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতিকে সেই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আনা কখনো সম্ভব হয়নি।
বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭৪ শতাংশে ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০.২২ শতাংশে দেখানো হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে অপর সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস।
কোভিড-১৯ পরবর্তী কয়েক বছরে মূলত মূল্যস্ফীতির হার ৫-৬ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমত কোভিড-১৯ মহামারি, দ্বিতীয়ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পর আমদানিতে ডলারের দাম বাড়ে। এর ফলে আমদানি মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং রপ্তানি মূল্য মন্থর থাকে।
ফলশ্রুতিতে, অর্থপ্রদানের ভারসাম্যের অবনতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা মজুত হ্রাস পায় ও টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। এরমধ্যে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিশিয়াল রেট এক দিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে (যুগান্তর, ৮ মে ২০২৪)। এর ফলে পণ্যের দাম বাড়বে। কাজেই, মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর আরও একধাপ।
মূল্যস্ফীতির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী বাজেটে আমদানি কমবে, অযৌক্তিক ব্যয় আরও হ্রাস পাবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনার চেষ্টাতো চলছেই। বাজেটে রাজস্ব বাড়িয়ে ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এছাড়াও, কৌশল পত্র প্রণয়নে দেশের বাহির থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহযোগী হিসেবে আইএমএফ, ভারত, বিশ্ব ব্যাংক, জাপান এবং চীন আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কাজ করছে। কিন্তু, এতসব উদ্যোগে কি আদৌ কোনো কাজ হবে! চলতি অর্থবছরেও এসব উদ্যোগে কোনো কাজ হয়নি।
আবার, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি দেশ কোভিড-১৯ পরবর্তী বছর দুয়েক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়লেও বর্তমানে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে পেরেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসায় বিশ্ববাজারে ক্রমান্বয়ে দ্রব্যমূল্য কমে গেলেও আমাদের দেশে এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কেন এমনটা হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে মনে করেন যে, সঠিকভাবে অর্থনীতি পরিচালনায় ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দিতে হবে বাজারের দিকে। কেননা, আমাদের বাজার ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না। সাধারণত, পণ্যের সংকট থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট না থাকলেও সব নিত্যপণ্যের দামই বেশি। কেননা, এর পেছনেও রয়েছে দুর্নীতি। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বাজার সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অতি মুনাফার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে যা স্পষ্টতই অপরাধ। যারা এই অপরাধ করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। খাদ্যপণ্যের দামের কারসাজি রোধে সরকারকে কঠোর হতেই হবে। যেসব অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে, বাজারে প্রকৃত তদারকির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্নীতি শুধু বাজার ব্যবস্থায় নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্য আসল দুশমন হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির সবগুলো সমস্যার আঁতুড় ঘর। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারের মূল্য বা ডলারের মূল্য কারসাজি, মুদ্রা পাচার, খেলাপি ঋণ, এই সবকিছুর পেছনেই রয়েছে দুর্নীতি।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। এর ফলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’-এর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু, দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট দুর্নীতিরও আবির্ভাব ঘটেছে। রাহুর মতো গ্রাস করছে অর্থনীতিকে।
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে যেমন সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। দুর্নীতির কারণে রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি। এই ঘাটতি মেটাতে পরিচালনা ব্যয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। টাকা ছাপিয়েও এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ মূল্যস্ফীতিতে অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া, দুর্নীতির অর্থ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আর, পুঞ্জিভূত অর্থই বৈদেশিক মুদ্রায় অবৈধ উপায়ে পাচার হচ্ছে বিদেশে। ফলশ্রুতিতে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে টান পড়েছে এবং আমাদের ক্রয় ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে।
অর্থনীতির অন্যান্য নিয়ামকগুলোর উপর আমাদের তেমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই, দুর্নীতি নিয়ে আর রাজনীতি নয়। কেননা, দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই। এখন সময় এসেছে, একে জাতির এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সমূলে উৎপাটন করার। এর দূরীকরণ শুরু করতে হবে একদম উপর থেকে। কেননা এটা একটা টপ টাউন এপ্রোচ। প্রতিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে থেকে শুরু করলে ধীরে ধীরে তা প্রান্তিক স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে।
দীর্ঘদিন প্রতিকার না থাকায় দুর্নীতি আমাদের সমাজের অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। ফলে, রাতারাতি দুর্নীতি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তবে, সব ক্ষেত্রে ন্যূনতম পক্ষে সহনশীল পর্যায়ে দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে সরকারকে। কেননা, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে দুর্নীতিস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শুধুমাত্র বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কখনোই সম্ভব নয়।
লেখক; অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাজেট ২০২৪-২০২৫ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

আপডেট সময় : ১২:০৩:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০২৪

নীলাঞ্জন কুমার সাহা : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ৬ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের আগামী বাজেটকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। যেমন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা মজুত হ্রাস, লেনদেনে অস্থিতিশীলতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ।
অধিকন্তু, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বাড়তি চাপও সামাল দিতে হবে। তাই, এতসব নেতিবাচক অর্থনৈতিক নিয়ামকের চাপ সামাল দিয়ে বাজেটের মাধ্যমে সমষ্টির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেটের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে। বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশে ও মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা থাকতে পারে।
বাজেটে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এনবিআর এর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। আর বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি বিগত বছরের ন্যায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে মেটানোর সম্ভাবনা থাকবে।
আকার যাই হোক না কেন, আসন্ন বাজেটের মূল লক্ষ্যই হবে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে আনা। কেননা, মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে বর্তমান সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ও নির্মম ঘাতক। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। লাগামহীন, অনবরত। সাধারণ মানুষের জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে। এর ভয়ংকর আঘাতে নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে।
আর মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস অবস্থা। সরকারের সব প্রচেষ্টায় এর কাছে ধরাশায়ী। দেখে মনে হচ্ছে, অর্থনীতি যেন নিজেই দিশাহারা। এর আস্ফালনে দেশের অন্যান্য অর্জনগুলো ম্লান হয়ে পড়ছে। তাই, মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ সর্বাগ্রে। অন্যান্য সমস্যা পরে মোকাবিলা করা যেতে পারে।
সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। যদিও বাজেট ঘোষণায় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতিকে সেই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আনা কখনো সম্ভব হয়নি।
বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭৪ শতাংশে ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০.২২ শতাংশে দেখানো হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে অপর সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস।
কোভিড-১৯ পরবর্তী কয়েক বছরে মূলত মূল্যস্ফীতির হার ৫-৬ শতাংশ থেকে ক্রমান্বয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমত কোভিড-১৯ মহামারি, দ্বিতীয়ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পর আমদানিতে ডলারের দাম বাড়ে। এর ফলে আমদানি মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং রপ্তানি মূল্য মন্থর থাকে।
ফলশ্রুতিতে, অর্থপ্রদানের ভারসাম্যের অবনতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা মজুত হ্রাস পায় ও টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে। এরমধ্যে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিশিয়াল রেট এক দিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে (যুগান্তর, ৮ মে ২০২৪)। এর ফলে পণ্যের দাম বাড়বে। কাজেই, মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর আরও একধাপ।
মূল্যস্ফীতির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী বাজেটে আমদানি কমবে, অযৌক্তিক ব্যয় আরও হ্রাস পাবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনার চেষ্টাতো চলছেই। বাজেটে রাজস্ব বাড়িয়ে ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এছাড়াও, কৌশল পত্র প্রণয়নে দেশের বাহির থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহযোগী হিসেবে আইএমএফ, ভারত, বিশ্ব ব্যাংক, জাপান এবং চীন আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কাজ করছে। কিন্তু, এতসব উদ্যোগে কি আদৌ কোনো কাজ হবে! চলতি অর্থবছরেও এসব উদ্যোগে কোনো কাজ হয়নি।
আবার, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি দেশ কোভিড-১৯ পরবর্তী বছর দুয়েক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়লেও বর্তমানে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে পেরেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসায় বিশ্ববাজারে ক্রমান্বয়ে দ্রব্যমূল্য কমে গেলেও আমাদের দেশে এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কেন এমনটা হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে মনে করেন যে, সঠিকভাবে অর্থনীতি পরিচালনায় ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দিতে হবে বাজারের দিকে। কেননা, আমাদের বাজার ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না। সাধারণত, পণ্যের সংকট থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট না থাকলেও সব নিত্যপণ্যের দামই বেশি। কেননা, এর পেছনেও রয়েছে দুর্নীতি। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বাজার সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অতি মুনাফার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে যা স্পষ্টতই অপরাধ। যারা এই অপরাধ করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। খাদ্যপণ্যের দামের কারসাজি রোধে সরকারকে কঠোর হতেই হবে। যেসব অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে, বাজারে প্রকৃত তদারকির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্নীতি শুধু বাজার ব্যবস্থায় নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের অর্থনীতির বেহাল অবস্থার জন্য আসল দুশমন হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির সবগুলো সমস্যার আঁতুড় ঘর। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারের মূল্য বা ডলারের মূল্য কারসাজি, মুদ্রা পাচার, খেলাপি ঋণ, এই সবকিছুর পেছনেই রয়েছে দুর্নীতি।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। এর ফলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’-এর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। উপরন্তু, দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট দুর্নীতিরও আবির্ভাব ঘটেছে। রাহুর মতো গ্রাস করছে অর্থনীতিকে।
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে যেমন সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। দুর্নীতির কারণে রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি। এই ঘাটতি মেটাতে পরিচালনা ব্যয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। টাকা ছাপিয়েও এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ মূল্যস্ফীতিতে অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া, দুর্নীতির অর্থ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আর, পুঞ্জিভূত অর্থই বৈদেশিক মুদ্রায় অবৈধ উপায়ে পাচার হচ্ছে বিদেশে। ফলশ্রুতিতে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে টান পড়েছে এবং আমাদের ক্রয় ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে।
অর্থনীতির অন্যান্য নিয়ামকগুলোর উপর আমাদের তেমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই, দুর্নীতি নিয়ে আর রাজনীতি নয়। কেননা, দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই। এখন সময় এসেছে, একে জাতির এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সমূলে উৎপাটন করার। এর দূরীকরণ শুরু করতে হবে একদম উপর থেকে। কেননা এটা একটা টপ টাউন এপ্রোচ। প্রতিটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে থেকে শুরু করলে ধীরে ধীরে তা প্রান্তিক স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে।
দীর্ঘদিন প্রতিকার না থাকায় দুর্নীতি আমাদের সমাজের অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। ফলে, রাতারাতি দুর্নীতি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তবে, সব ক্ষেত্রে ন্যূনতম পক্ষে সহনশীল পর্যায়ে দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে সরকারকে। কেননা, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে দুর্নীতিস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শুধুমাত্র বাজেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কখনোই সম্ভব নয়।
লেখক; অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়