ঢাকা ০৯:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বাজেট ঘাটতি পূরণে ক্রমেই বাড়ছে ঋণনির্ভরতা

  • আপডেট সময় : ০৫:১৬:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

অর্থনৈতিক ডেস্ক: রাজস্ব বৃদ্ধি ধীরগতির কারণে এবং বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সরকারের তহবিলের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, নতুন নোট ছাপিয়ে সরাসরি সরকারকে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করার পর সরকারকে তার আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৯৮ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে; যা গত বছরের একই সময়ের ৬১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। এতটা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ৪৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার চেয়ে সামান্য কম।
নেট ব্যাংক ঋণ হিসাব করা হয়, সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করা অর্থ বাদ দিয়ে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৫৬ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

সরকার সাধারণত ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়। গত অর্থবছর পর্যন্ত সরকার সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অর্থ নিয়েছিল। তবে অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের ব্যাপক সমালোচনার পর, এই অনুশীলন বন্ধ করা হয়। তাদের সতর্কতা ছিল যে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে নতুন টাকা ছাপানো হলে, টাকার যোগান বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ঋণ দেওয়া বন্ধ করার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করা ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি বলেন, কর রাজস্ব প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ায়, সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায় মাত্র ২.৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্চ মাস পর্যন্ত এনবিআর যা রাষ্ট্রের মোট রাজস্বের ৮৬ শতাংশের জোগান দেয়- ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। তা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার থেকে অনেক কম।
এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। উচ্চ সুদহার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর ফলে, ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা সরকারি সিকিউরিটিজে (বন্ড ও বিল) বেশি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বর্তমানে ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগের সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮২ শতাংশ; যা আগের মাসের ৭.১৫ শতাংশ থেকে কম।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায়, ব্যাংকগুলো এখন সরকারি ট্রেজারি বিল এবং বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি প্রান্তিকে সরকারের ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে; যা ব্যাংক ঋণের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার প্রমাণ। তিনি বলেন, এখনো সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই হার এখনো উদ্বেগজনক নয়।
অর্থবছর ২০২৫-এর সংশোধিত বাজেটে, সরকার ব্যাংক থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। এর মধ্যে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছে।

ব্যাংক ঋণ ছাড়াও সরকার ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩৫ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই), বিমা কোম্পানি এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী। ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত, সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নিট অবস্থান বাদ দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ৭৭ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাজেট ঘাটতি পূরণে ক্রমেই বাড়ছে ঋণনির্ভরতা

আপডেট সময় : ০৫:১৬:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

অর্থনৈতিক ডেস্ক: রাজস্ব বৃদ্ধি ধীরগতির কারণে এবং বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সরকারের তহবিলের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, নতুন নোট ছাপিয়ে সরাসরি সরকারকে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করার পর সরকারকে তার আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৯৮ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে; যা গত বছরের একই সময়ের ৬১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। এতটা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ৪৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার চেয়ে সামান্য কম।
নেট ব্যাংক ঋণ হিসাব করা হয়, সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করা অর্থ বাদ দিয়ে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৫৬ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

সরকার সাধারণত ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়। গত অর্থবছর পর্যন্ত সরকার সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অর্থ নিয়েছিল। তবে অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের ব্যাপক সমালোচনার পর, এই অনুশীলন বন্ধ করা হয়। তাদের সতর্কতা ছিল যে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে নতুন টাকা ছাপানো হলে, টাকার যোগান বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ঋণ দেওয়া বন্ধ করার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করা ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি বলেন, কর রাজস্ব প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ায়, সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায় মাত্র ২.৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্চ মাস পর্যন্ত এনবিআর যা রাষ্ট্রের মোট রাজস্বের ৮৬ শতাংশের জোগান দেয়- ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। তা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার থেকে অনেক কম।
এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। উচ্চ সুদহার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর ফলে, ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা সরকারি সিকিউরিটিজে (বন্ড ও বিল) বেশি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বর্তমানে ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগের সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮২ শতাংশ; যা আগের মাসের ৭.১৫ শতাংশ থেকে কম।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায়, ব্যাংকগুলো এখন সরকারি ট্রেজারি বিল এবং বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি প্রান্তিকে সরকারের ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে; যা ব্যাংক ঋণের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার প্রমাণ। তিনি বলেন, এখনো সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই হার এখনো উদ্বেগজনক নয়।
অর্থবছর ২০২৫-এর সংশোধিত বাজেটে, সরকার ব্যাংক থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। এর মধ্যে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছে।

ব্যাংক ঋণ ছাড়াও সরকার ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩৫ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই), বিমা কোম্পানি এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী। ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত, সরকার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নিট অবস্থান বাদ দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ৭৭ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।