বিশেষ সংবাদদাতা : আসন্ন বাজেটের অগ্রাধিকার হিসেবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য কমানোর লক্ষ্য চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজে বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। একইসঙ্গে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য, আবাসন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে থাকছে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তুত করার অপেক্ষায় থাকা নতুন বাজেটের আকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বাজেটে যা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য যে ঘাটতি ধরা হচ্ছে, সেই ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি উৎস থেকে এবং বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। নতুন বাজেটের আকার কমলেও পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের ব্যয় ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরও মূল্যস্ফীতির একই হারই ছিল। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা রয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। মূলত, আগামী বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন। সংসদ না থাকায় এবার সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থান করা হবে না। অর্থ উপদেষ্টা টেলিভিশনে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন।
রাজস্ব আয়
আসন্ন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে সরকারের আয়ের লক্ষ্য হতে পারে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎসসহ অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এনবিআর ৫ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নিতে চাইলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাবদ ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থাকলেও আগামী বাজেটে এডিপি বাবদ বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
অগ্রাধিকার খাত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একই সঙ্গে সবুজ ও জলবায়ুসংক্রান্ত প্রকল্প বিশেষ গুরুত্ব পাবে। একই সঙ্গে নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার পাচ্ছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত। সমাজে বৈষম্য কমানোর পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও থাকবে। নতুন বাজেটে থাকছে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষদের বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা ও কিছু ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ। সূত্র জানিয়েছে, সরকারের নতুন অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় আসন্ন বাজেটে বৈদেশিক ঋণ কিংবা অনুদানে বাস্তবায়ন হচ্ছে এসব প্রকল্পে এডিপিতে অর্থ বরাদ্দের চাহিদা প্রস্তাব করতে হবে। পাশাপাশি দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এসব প্রকল্পের জন্য অগ্রাধিকার বিবেচনায় আনতে হবে। এ ছাড়াও মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট এমন সব প্রকল্প এডিপির আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে ।
তবে এসব প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দের চাহিদা প্রস্তাব করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে। এ ছাড়াও প্রকল্পভিত্তিক চাহিদা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দের পাশাপাশি আগামী ২০২৬-২৭, ২০২৭-২৮ অর্থবছরের বরাদ্দের প্রক্ষেপণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রাথমিকভাবে শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য সেক্টরের আওতাধীন ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এসব সেক্টরের মাল্টি ইয়ার পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম তেরি হবে। যে কারণে বেশকিছু বিবেচনায় নিতে হবে বলে সরকারের নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হওয়ার আগেই আগামী ২ জুন (সোমবার) বাজেট ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘোষণার পর অর্থ উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, অর্জনযোগ্য, বাস্তব সম্মত বাজেট হওয়া উচিত। আর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটটি হবে বাস্তবায়নযোগ্য। যেখানে সমাজে বৈষম্য কমানোর রোডম্যাপ থাকবে।