ঢাকা ০৩:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫

বাঙালি সংস্কৃতির সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন জরুরি

  • আপডেট সময় : ১০:২০:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ অগাস্ট ২০২১
  • ১৪৪ বার পড়া হয়েছে

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: জাতিরাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি বাঁচলেই কেবল বাঁচবে দেশ। খুব খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক চর্চায় সংস্কৃতিচর্চা প্রায়ই যেমন উপেক্ষিত হচ্ছে, তেমনি সংস্কৃতিচর্চায় রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিও কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এ দুটো বিষয় একে-অপরের পরিপূরক হয়ে যত দিন স্বাধীনভাবে সমান্তরালে পথ হাঁটতে পেরেছে, তত দিন সহাবস্থানের চলার পথ প্রশস্ত থেকেছে। কখনো যদি কোনোটি হোঁচট খেয়ে সাময়িক বেকায়দায় পড়েছে, অন্যটির জোরালো প্রভাবে খুব সহজেই তা উতরে গেছে।

আন্দোলন-সংগ্রামে, সমাজের অভিব্যক্তি প্রকাশে, অধিকার আদায়ে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত সংগতি-অসংগতি, প্রেম-ভালোবাসা, এক কথায় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সব অঙ্গে, এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই সর্বজনবিদিত।
বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। প্রতিটি স্তম্ভেই বাঙালি সংস্কৃতির মানসপট গ্রথিত রয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। কোথাও কোনো বিরোধ নেই। কেবল অপরাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো মূল সংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্রতম অংশ ধর্মীয় সংস্কৃতির অপব্যাখ্যা করে প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে বিরোধ তৈরি করে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে এ দেশের জন্মলগ্ন থেকে।

পুঁথিগত আলোচনায় কোনো ধর্মেই সংকীর্ণতার স্থান নেই। তবে আচারে, রীতিনীতিতে প্রত্যেক ধর্মেরই বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ওই নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের জন্য কেবল ধর্মীয় বিবেচনায় প্রযোজ্য। আর মানবজীবনের ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে সব ধর্মেই কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যা মানুষের কল্যাণে অনেক বেশি শিক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ধর্মের ঔদার্য্য এর পরিধিও অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তা সত্ত্বেও ধর্মের ব্যবহারিক প্রয়োগে একটা সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে সব সময়। সেটা হলো- সব ধর্মের একসাথে সমান্তরালে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরণ বিশ্বে নেই। অথচ কোনো ধর্মই এমন কথা বলে না যে, অন্য ধর্মের সাথে তার যুগপৎ চলতে কোনো সীমাবদ্ধতা আছে।

ধর্মের বাইরেও প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। কোনো কোনো জাতিরাষ্ট্র গড়েই উঠেছে জাতীয় পরিচয়ভিত্তিক সংস্কৃতির চরিত্র ধারণ করে, যার স্বরূপ অসাম্প্রদায়িক। সংস্কৃতির এ রূপটির ঔদার্য্য, সৌন্দর্য এতটা পরিশীলিত ও সক্ষমতাসম্পন্ন যে, সব ধর্মের মানুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমমর্যাদা, অধিকার এবং ধর্ম ব্যবহারের স্বাধীনতা প্রশ্নে যার যার ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকেরই সমমর্যাদার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সে অর্থে এ সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অত্যন্ত আপন করে প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজের সন্তানের মতো চিন্তা করেছে। এমনকি নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধান কর্তৃক।
জনসংখ্যার ভিত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র কোনো জনগোষ্ঠীর ধর্মাচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই এখানে। মহাকালের মহান বিশ্বনেতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সব ধর্মমতের মানুষের জন্য একটি তীর্থস্থান বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন। আর দীর্ঘ সময় সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এ ভূখ-ে একসাথে বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ে সমতার ভিত্তিতে বসবাস করেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান নেতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ধর্মাশ্রয়ী বিশেষ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সে সময় এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধে পরাজয় মানতে না পেরে পাকিস্তানি প্রভুদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের তল্পিবাহক হয়ে তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশকে তারা একদিকে যেমন মানতে পারেনি, অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এ বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করে পরবর্তীতে সুদীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলার সংস্কৃতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই, হেন কোনো ঘৃণ্য নৃশংসতা নেই, যা তারা করেনি। উদ্দেশ্য একটিই, বাঙালি সংস্কৃতি তাদের প্রধান শত্রু। ওই সময়কালে সাম্প্রদায়িক সরকার দেশ পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকেই শুধু দুর্বল করেনি, বিপরীতে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ব্যাপ্তি এতটাই বৃহৎ আকার ধারণ করেছে যে, বিয়ের অনুষ্ঠানেও মাইক বাজানো দুষ্কর হয়ে যায়। তারা জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রচারযন্ত্র, প্রশাসন- রাষ্ট্রের সব অঙ্গে ডালপালা ছড়িয়ে এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এমনকি চিহ্নিত আল-বদর, আল-শামস, যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থেকে বাঙালি জাতির সবচেয়ে সম্মানিত অর্জন লাল-সবুজের পতাকা তাদের গাড়িতে ব্যবহার করে। আর তাতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কতটা ভয়ানক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল তার প্রভাব আমরা এখনো পরতে পরতে দেখেই চলেছি।
বলে রাখা প্রয়োজন, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংস্কৃতিবান্ধব একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে বাংলাদেশ জন্মের বহু আগেই চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন ঢাকা তার হাত ধরে যাত্রা করে। তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭৫-পরবর্তী দেশে ফিরে এসে বাবার পথ ধরে রাজনীতির মাঠে ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণভোমরা হিসেবে ১৯৯৬ সালে এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত করতে যেসব অনুষঙ্গ অত্যন্ত কার্যকর ছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি নান্দনিক অনুষঙ্গ ছিল সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে সংগীতশিল্পী, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনের অন্য কর্মীদের উজ্জীবনী প্রচার-প্রচারণা, এমনকি বিদেশের মাটিতে সাংগীতিক কনসার্ট করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করার মতো নান্দনিক কাজ করে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের পক্ষে শক্তি জোগান দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে কনসার্ট করে অর্জিত আর্থিক অনুদান ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধশিবিরে আশ্রিত মানুষের কল্যাণে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে দীর্ঘসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে থাকা সংস্কৃতিকর্মীরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। পুনরায় সৃষ্টিশীল কাজে নিজেদের নিবেদিত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্রকে কাজে লাগাতে সংস্কৃতিকর্মীরা আবার তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু আগের দীর্ঘদিনের অপশাসন, সাম্প্রদায়িক অপসংস্কৃতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ, বিদেশি সংস্কৃতির ঢালাও প্রবেশ, সেই সাথে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনার ঘাটতি ইত্যাদি বর্তমানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে যে ধারণার জন্ম দিয়েছে অপরাজনীতির ধারক-বাহকরা, সেই ধাক্কা অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মূল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চার স্বরূপে ফেরা তাই কষ্টকরই বটে।
তদুপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের সময়ে দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মামলা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলার সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি নানারকম নারকীয় শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটিয়েছে বারবার। এমনকি কিছু বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের অভ্যন্তরীণ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের শক্তি প্রদর্শনের সাহস আরও বাড়িয়েছিল। এসব রাষ্ট্রের অনেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই সাম্প্রদায়িক পক্ষকে সমর্থন করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে।

এ রকম প্রেক্ষাপটে আমাদের দেখতে হয়েছে রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে সংস্কৃতিকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত করেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক যাত্রা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান উদযাপনে গিয়ে আমরা দেখেছি বারবার তাদেরই পৈশাচিক বিচরণে এর সৌন্দর্যকে নষ্ট করতে। নারীদের প্রতি বিশৃঙ্খল আচরণ করে দেশ-বিদেশে তা প্রচারের মাধ্যমে এই অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের ভবিষ্যৎ রুদ্ধ করতে চেয়েছে নরপিশাচরা। তারা সিনেমা হলে বোমা নিক্ষেপ করে বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র জাতীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে, তাদের সেই ভীতি প্রদর্শনের কারণে আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্প।
সেই সাথে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে নতুন একটি প্রাকটিস চালু হয়েছে। প্রগতিশীল চেতনার রাজনৈতিক স্থানীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের রাজনৈতিক সমাবেশে ধর্মের মুখোশ পরিয়ে সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠানকে সফল ও নিরাপদ করার কাজটি খুব সুচতুরভাবে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে বসিয়ে রেখেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার নিজ দলের নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে কৌশলে। বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে সাধারণ মানুষের অন্তরে গ্রথিত করে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বলয়ভুক্ত করে সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে সমাজে অবাঞ্ছিত করবার লক্ষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন, ভয়-ভীতি দেখানো, এমনকি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সরাসরি বিরোধিতা করা, শক্তি প্রদর্শন করে ভাঙচুর করার মতো অতি দুঃসাহসিক কাজ একের পর এক করে চলেছে প্রকাশ্যে।

এই যখন অস্বস্তিকর চিত্র, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কর্মী-সমর্থকদের কাজে লাগিয়ে জ্বালাও-পোড়াও, নানা রকম মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে সরকারকে দেশ-বিদেশে বিব্রতকর অবস্থায় রাখার ষড়যন্ত্রে দিবানিশি কাজ করে চলছে ওই গোষ্ঠী। কখনো কখনো জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে স্থায়ীরূপে সাংগঠনিক আকার ধারণ করতে মরিয়া। সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যক্তিজীবনের কোনো স্ক্যান্ডাল তা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিড নিউজ ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশন টক শোতে মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পরিকল্পিত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতির ভাবমূর্তি রক্ষায় কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে কোন সংবাদটি প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন সে বিবেচনার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছু মূল গণমাধ্যমে। তারা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ ও অনলাইন গণমাধ্যমের বিরোধিতা করার সাথে কিছু কিছু গুজব রটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রচার করেছে।

ফলস্বরূপ, প্রশাসনিকভাবে এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অনুষ্ঠানের কলেবর সংকুচিত করার যে নতুন ধারা প্রচলিত হয়েছে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই যেকোনো অনুষ্ঠানসূচি শেষ করার, এই চর্চা থেকে বেরিয়ে দিন, সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকা- চালিয়ে যাবার পুরনো সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়া আর কখনো সম্ভব হবে কি না শঙ্কা রয়ে গেছে।

আগে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই অন্তর্ভুক্তির চেতনানির্ভরতা খুব একটা চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও কিছুটা চোখে পড়লেও তা নিতান্তই দায়সারা গোছের মনে হয়। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রাতিষ্ঠানিক সংখ্যা বৃদ্ধি এমনভাবেই ঘটেছে যে, বিপরীতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রের ততোধিক বিস্তৃতি সমাজে ঘটানো সম্ভব না হলে ভারসাম্যে ফিরে আসা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যার প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যেই অনেকখানি টের পেয়ে গেছি।

সরকারিভাবে সংস্কৃতিকর্মীদের মূল্যায়ন, সম্মান বৃদ্ধি, সৃষ্টিশীল কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গবেষণা অব্যাহত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মাধ্যমিক, নি¤œ মাধ্যমিক পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে, অর্থাৎ এ চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় মূল্যবান সম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি গেলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সংস্কৃতিমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইবেন নিশ্চয়ই। তা না হলে এদিক থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। সময় এসেছে সে দিকটাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার।

তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতির পিতার দেওয়া রাজনৈতিক দর্শন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাকে ভবিষ্যতে হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাঙালি সংস্কৃতির সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।

সেই সাথে এই বাঙালি সংস্কৃতির অনুভূতিতে আঘাত করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচার করে, কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করে, কটাক্ষ করে কিংবা আঘাত করে কোনো বক্তব্য প্রদান, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো কাজ করা যা সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর এমন কার্যক্রমকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এতে শাস্তির বিধান প্রণয়ন করে বাঙালি সংস্কৃতিকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এখন খুব জরুরি বলে মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তার অনুপস্থিতিতে অন্য কারও কাছে এ সুরক্ষা প্রস্তাব বাস্তবায়ন আশা করাও অমূলক।
জয় বাংলা।
লেখক: পুলিশ সুপার। প্রাবন্ধিক ও গীতিকার।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

বাঙালি সংস্কৃতির সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন জরুরি

আপডেট সময় : ১০:২০:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ অগাস্ট ২০২১

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: জাতিরাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি বাঁচলেই কেবল বাঁচবে দেশ। খুব খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক চর্চায় সংস্কৃতিচর্চা প্রায়ই যেমন উপেক্ষিত হচ্ছে, তেমনি সংস্কৃতিচর্চায় রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিও কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এ দুটো বিষয় একে-অপরের পরিপূরক হয়ে যত দিন স্বাধীনভাবে সমান্তরালে পথ হাঁটতে পেরেছে, তত দিন সহাবস্থানের চলার পথ প্রশস্ত থেকেছে। কখনো যদি কোনোটি হোঁচট খেয়ে সাময়িক বেকায়দায় পড়েছে, অন্যটির জোরালো প্রভাবে খুব সহজেই তা উতরে গেছে।

আন্দোলন-সংগ্রামে, সমাজের অভিব্যক্তি প্রকাশে, অধিকার আদায়ে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত সংগতি-অসংগতি, প্রেম-ভালোবাসা, এক কথায় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সব অঙ্গে, এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই সর্বজনবিদিত।
বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। প্রতিটি স্তম্ভেই বাঙালি সংস্কৃতির মানসপট গ্রথিত রয়েছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। কোথাও কোনো বিরোধ নেই। কেবল অপরাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো মূল সংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্রতম অংশ ধর্মীয় সংস্কৃতির অপব্যাখ্যা করে প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে বিরোধ তৈরি করে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে এ দেশের জন্মলগ্ন থেকে।

পুঁথিগত আলোচনায় কোনো ধর্মেই সংকীর্ণতার স্থান নেই। তবে আচারে, রীতিনীতিতে প্রত্যেক ধর্মেরই বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ওই নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের জন্য কেবল ধর্মীয় বিবেচনায় প্রযোজ্য। আর মানবজীবনের ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে সব ধর্মেই কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যা মানুষের কল্যাণে অনেক বেশি শিক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ধর্মের ঔদার্য্য এর পরিধিও অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তা সত্ত্বেও ধর্মের ব্যবহারিক প্রয়োগে একটা সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে সব সময়। সেটা হলো- সব ধর্মের একসাথে সমান্তরালে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরণ বিশ্বে নেই। অথচ কোনো ধর্মই এমন কথা বলে না যে, অন্য ধর্মের সাথে তার যুগপৎ চলতে কোনো সীমাবদ্ধতা আছে।

ধর্মের বাইরেও প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। কোনো কোনো জাতিরাষ্ট্র গড়েই উঠেছে জাতীয় পরিচয়ভিত্তিক সংস্কৃতির চরিত্র ধারণ করে, যার স্বরূপ অসাম্প্রদায়িক। সংস্কৃতির এ রূপটির ঔদার্য্য, সৌন্দর্য এতটা পরিশীলিত ও সক্ষমতাসম্পন্ন যে, সব ধর্মের মানুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমমর্যাদা, অধিকার এবং ধর্ম ব্যবহারের স্বাধীনতা প্রশ্নে যার যার ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিকেরই সমমর্যাদার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। সে অর্থে এ সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অত্যন্ত আপন করে প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজের সন্তানের মতো চিন্তা করেছে। এমনকি নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধান কর্তৃক।
জনসংখ্যার ভিত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র কোনো জনগোষ্ঠীর ধর্মাচার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই এখানে। মহাকালের মহান বিশ্বনেতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সব ধর্মমতের মানুষের জন্য একটি তীর্থস্থান বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন। আর দীর্ঘ সময় সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এ ভূখ-ে একসাথে বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ে সমতার ভিত্তিতে বসবাস করেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান নেতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ধর্মাশ্রয়ী বিশেষ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সে সময় এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধে পরাজয় মানতে না পেরে পাকিস্তানি প্রভুদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের তল্পিবাহক হয়ে তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশকে তারা একদিকে যেমন মানতে পারেনি, অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এ বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করে পরবর্তীতে সুদীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলার সংস্কৃতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই, হেন কোনো ঘৃণ্য নৃশংসতা নেই, যা তারা করেনি। উদ্দেশ্য একটিই, বাঙালি সংস্কৃতি তাদের প্রধান শত্রু। ওই সময়কালে সাম্প্রদায়িক সরকার দেশ পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকেই শুধু দুর্বল করেনি, বিপরীতে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ব্যাপ্তি এতটাই বৃহৎ আকার ধারণ করেছে যে, বিয়ের অনুষ্ঠানেও মাইক বাজানো দুষ্কর হয়ে যায়। তারা জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রচারযন্ত্র, প্রশাসন- রাষ্ট্রের সব অঙ্গে ডালপালা ছড়িয়ে এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এমনকি চিহ্নিত আল-বদর, আল-শামস, যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থেকে বাঙালি জাতির সবচেয়ে সম্মানিত অর্জন লাল-সবুজের পতাকা তাদের গাড়িতে ব্যবহার করে। আর তাতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কতটা ভয়ানক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল তার প্রভাব আমরা এখনো পরতে পরতে দেখেই চলেছি।
বলে রাখা প্রয়োজন, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংস্কৃতিবান্ধব একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলে বাংলাদেশ জন্মের বহু আগেই চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন ঢাকা তার হাত ধরে যাত্রা করে। তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭৫-পরবর্তী দেশে ফিরে এসে বাবার পথ ধরে রাজনীতির মাঠে ত্যাগ-তিতিক্ষা, অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণভোমরা হিসেবে ১৯৯৬ সালে এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত করতে যেসব অনুষঙ্গ অত্যন্ত কার্যকর ছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি নান্দনিক অনুষঙ্গ ছিল সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে সংগীতশিল্পী, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনের অন্য কর্মীদের উজ্জীবনী প্রচার-প্রচারণা, এমনকি বিদেশের মাটিতে সাংগীতিক কনসার্ট করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করার মতো নান্দনিক কাজ করে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের পক্ষে শক্তি জোগান দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে কনসার্ট করে অর্জিত আর্থিক অনুদান ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধশিবিরে আশ্রিত মানুষের কল্যাণে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে দীর্ঘসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে থাকা সংস্কৃতিকর্মীরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। পুনরায় সৃষ্টিশীল কাজে নিজেদের নিবেদিত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলমন্ত্রকে কাজে লাগাতে সংস্কৃতিকর্মীরা আবার তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু আগের দীর্ঘদিনের অপশাসন, সাম্প্রদায়িক অপসংস্কৃতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ, বিদেশি সংস্কৃতির ঢালাও প্রবেশ, সেই সাথে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনার ঘাটতি ইত্যাদি বর্তমানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে যে ধারণার জন্ম দিয়েছে অপরাজনীতির ধারক-বাহকরা, সেই ধাক্কা অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মূল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চার স্বরূপে ফেরা তাই কষ্টকরই বটে।
তদুপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের সময়ে দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মামলা বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলার সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি নানারকম নারকীয় শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটিয়েছে বারবার। এমনকি কিছু বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের অভ্যন্তরীণ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের শক্তি প্রদর্শনের সাহস আরও বাড়িয়েছিল। এসব রাষ্ট্রের অনেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই সাম্প্রদায়িক পক্ষকে সমর্থন করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে।

এ রকম প্রেক্ষাপটে আমাদের দেখতে হয়েছে রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে সংস্কৃতিকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত করেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক যাত্রা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান উদযাপনে গিয়ে আমরা দেখেছি বারবার তাদেরই পৈশাচিক বিচরণে এর সৌন্দর্যকে নষ্ট করতে। নারীদের প্রতি বিশৃঙ্খল আচরণ করে দেশ-বিদেশে তা প্রচারের মাধ্যমে এই অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের ভবিষ্যৎ রুদ্ধ করতে চেয়েছে নরপিশাচরা। তারা সিনেমা হলে বোমা নিক্ষেপ করে বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র জাতীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে, তাদের সেই ভীতি প্রদর্শনের কারণে আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্প।
সেই সাথে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে নতুন একটি প্রাকটিস চালু হয়েছে। প্রগতিশীল চেতনার রাজনৈতিক স্থানীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের রাজনৈতিক সমাবেশে ধর্মের মুখোশ পরিয়ে সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠানকে সফল ও নিরাপদ করার কাজটি খুব সুচতুরভাবে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে বসিয়ে রেখেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার নিজ দলের নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে কৌশলে। বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে সাধারণ মানুষের অন্তরে গ্রথিত করে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বলয়ভুক্ত করে সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে সমাজে অবাঞ্ছিত করবার লক্ষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন, ভয়-ভীতি দেখানো, এমনকি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সরাসরি বিরোধিতা করা, শক্তি প্রদর্শন করে ভাঙচুর করার মতো অতি দুঃসাহসিক কাজ একের পর এক করে চলেছে প্রকাশ্যে।

এই যখন অস্বস্তিকর চিত্র, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কর্মী-সমর্থকদের কাজে লাগিয়ে জ্বালাও-পোড়াও, নানা রকম মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে সরকারকে দেশ-বিদেশে বিব্রতকর অবস্থায় রাখার ষড়যন্ত্রে দিবানিশি কাজ করে চলছে ওই গোষ্ঠী। কখনো কখনো জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে স্থায়ীরূপে সাংগঠনিক আকার ধারণ করতে মরিয়া। সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যক্তিজীবনের কোনো স্ক্যান্ডাল তা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিড নিউজ ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশন টক শোতে মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পরিকল্পিত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতির ভাবমূর্তি রক্ষায় কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে কোন সংবাদটি প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন সে বিবেচনার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছু মূল গণমাধ্যমে। তারা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ ও অনলাইন গণমাধ্যমের বিরোধিতা করার সাথে কিছু কিছু গুজব রটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রচার করেছে।

ফলস্বরূপ, প্রশাসনিকভাবে এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অনুষ্ঠানের কলেবর সংকুচিত করার যে নতুন ধারা প্রচলিত হয়েছে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই যেকোনো অনুষ্ঠানসূচি শেষ করার, এই চর্চা থেকে বেরিয়ে দিন, সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকা- চালিয়ে যাবার পুরনো সংস্কৃতিতে ফিরে যাওয়া আর কখনো সম্ভব হবে কি না শঙ্কা রয়ে গেছে।

আগে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই অন্তর্ভুক্তির চেতনানির্ভরতা খুব একটা চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও কিছুটা চোখে পড়লেও তা নিতান্তই দায়সারা গোছের মনে হয়। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রাতিষ্ঠানিক সংখ্যা বৃদ্ধি এমনভাবেই ঘটেছে যে, বিপরীতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রের ততোধিক বিস্তৃতি সমাজে ঘটানো সম্ভব না হলে ভারসাম্যে ফিরে আসা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যার প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যেই অনেকখানি টের পেয়ে গেছি।

সরকারিভাবে সংস্কৃতিকর্মীদের মূল্যায়ন, সম্মান বৃদ্ধি, সৃষ্টিশীল কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গবেষণা অব্যাহত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মাধ্যমিক, নি¤œ মাধ্যমিক পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে, অর্থাৎ এ চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় মূল্যবান সম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি গেলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সংস্কৃতিমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইবেন নিশ্চয়ই। তা না হলে এদিক থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। সময় এসেছে সে দিকটাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার।

তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতির পিতার দেওয়া রাজনৈতিক দর্শন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাকে ভবিষ্যতে হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাঙালি সংস্কৃতির সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।

সেই সাথে এই বাঙালি সংস্কৃতির অনুভূতিতে আঘাত করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচার করে, কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করে, কটাক্ষ করে কিংবা আঘাত করে কোনো বক্তব্য প্রদান, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো কাজ করা যা সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর এমন কার্যক্রমকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এতে শাস্তির বিধান প্রণয়ন করে বাঙালি সংস্কৃতিকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এখন খুব জরুরি বলে মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তার অনুপস্থিতিতে অন্য কারও কাছে এ সুরক্ষা প্রস্তাব বাস্তবায়ন আশা করাও অমূলক।
জয় বাংলা।
লেখক: পুলিশ সুপার। প্রাবন্ধিক ও গীতিকার।