এম এম খালেকুজ্জামান : নিয়তির ঠোঁটে নাকি কৌতুকের হাসি লেগেই থাকে। না হলে কেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বিপুল আয়োজন সত্ত্বেও পালন করা গেল না পরিপূর্ণভাবে। না হয় মানলাম করোনাভাইরাস এসেছিল দৈব বেশে। বিষময় বিশ শেষ করে একুশে ছিল দেশের অর্ধ শতকের উদযাপন পর্ব। তাও কি করা গেল নির্বিঘেœ! কোভিডের পাশাপাশি এবার সব ভ-ুল করে দিতে নেমেছিল হেফাজত নামের দৈত্য। অথচ ‘আওয়ামী-হেফাজতি দোস্তি’তে (!) অনেকেই স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিলেন নতুন সওয়ার পাওয়া গেছে ভেবে। ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ ভেবে সক্রিয়তা থেকে মুখ লুকালে যা হয় তারই ফলিত রূপায়ন দেখা গেল স্বাধীনতার মাস বলে গর্ব করা মার্চের শেষ সপ্তাহ জুড়ে। এসব অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো কিছু ভুল হিসাবের ফল। কে জানে সত্তর পেরোনো দলটিকে জনকের শতবার্ষিকী আর দেশের পঞ্চাশের মতো ঐতিহাসিক সমাপতনের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ করে দিল কিনা!
একালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়ামক শক্তি হচ্ছে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক ক্ষমতার মৌল পুষ্টির জোগানদাতাও রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের বা পার্টির অতি সক্রিয়তাকে লুই আর্মস্ট্রং ‘পার্টিক্রেসি’ শব্দ দিয়ে বাঁধেন গত শতকের ষাটের দশকে। রাজনৈতিক দলের অতি ভূমিকার কারণে ডেমোক্রেসিতে ‘পার্টিক্রেসি’ দেখা যায় । আধুনিক সমাজের মেট্রোপলিস শহরগুলোতে, যেখানে জনগণ ভোটারমাত্র এবং প্রায়ই দর্শকের ভূমিকায় থাকে- তখন রাজনৈতিক দলগুলোই প্রতিনিধিত্ব এবং শাসনের লাগাম নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়, কায়েম করে তার একচেটিয়াত্ব। এ বাস্তবতা উন্নত দেশে যেমন আমাদের উপমহাদেশীয় রাজনীতিতেও প্রবল।
অথচ বহু প্রাচীন ভারতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এমন নজির আছে, যেখানে দলের সভাপতি ও দেশের প্রধানমন্ত্রী সমান্তরাল কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। জওহরলাল নেহেরুর আমলে তিনি দলের সভাপতিকে পূর্ণ শ্রদ্ধা করতেন, পরামর্শ নিতেন। এমন ধারা আমাদের দেশে বজায় রাখা যায় নি। আমাদের দেশে দল ও সরকার একাকার।
‘মিমিক্রি’ পারফর্মিং আর্টের প্রেক্ষাপটে বেশ লোকপ্রিয় মাধ্যম কিন্তু রাজনীতিতে নয়। ‘মিমিক্রি’ বা বিবেচনাহীন অন্ধ অনুকরণের ঘেরাটোপে পড়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে সংস্কারবিমুখ। এই মতের সাথে মতানৈক্য পোষণ করার লোক কি খুব বেশি আছে? খুব বেশি কিছু সংস্কার না করে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী লীগ’ সত্তর পার করেছে দুই বছর আগে। সংস্কার বলতে প্রতিষ্ঠাকালীন ‘মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। আধুনিক দল হিসেবে আরো ইতিবাচক সংস্কার দরকার ছিল।
নিঃসন্দেহে দলটি এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের পতাকাবাহী। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটির ভূমিকা অগ্রগণ্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেন ছিল আওয়ামী লীগের আঁতুর ঘর। আত্মপ্রকাশের পর দলটির পথচলা নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে।
শাস্ত্রের ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ’ অর্থাৎ নিজ ধর্মে নিষ্ঠ থেকে মৃত্যু ভালো, পরধর্মে আশ্রয় গ্রহণ ভয়াবহ বিষয়টি যেমন ব্যক্তির বেলায় প্রযোজ্য, তেমন দলের বেলায়ও। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই একটি দর্শন বা চেতনা-ধর্ম থাকে। অগ্রাধিকার সময়ে সাথে বদলাতে পারে কিন্তু দলের দর্শন বা চেতনা-ধর্ম কখনোই না। স্বধর্মচ্যুতির দ্বারা শুধু দলের না দেশের ও বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ঘরানায় বিশ্বাসী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের দর্শন হিসেবে ঘোষণা করেন। যদিও আওয়ামী লীগের ভেতরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দলের দর্শনের বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র হয়েছে। ডানপন্থি নেতাকর্মী তখনও দলে ছিলেন, তবে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের সক্রিয় প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়েছে। অতীতের মতো এখন,ও দল ও দেশকে অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের কবল মুক্ত রাখার কবচ আছে আওয়ামী লীগের আস্তিনেই।
অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন ধাক্কা খায় একদলীয় বাকশাল চালু, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-, সামরিক শাসন জারির ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে। উদার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শেকড় সন্ধানী বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করেই আওয়ামী লীগ আজ বড় দল। আর বিপরীতে অন্য বড় অংশটি স্থানীয় সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলি নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে রাজনৈতিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ চরমপন্থার কারণেই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনগুলো এদেশে কোনও জনসমর্থন পায়নি, পাবে বলেও মনে হয় না।
বামপন্থিদের মধ্যে আদর্শিক দেউলিয়াপনা কেবল যে তাদের নিজেদের রাজনীতিতে সংকট তৈরি করছে তাইনা, এদেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও সংকট তৈরিতে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বামপন্থিদের ক্ষমতা-পিপাসা ও নিজেদের স্বার্থচিন্তা এ অধ:পতনের কারণ। বামপন্থিদের এ অবস্থা যে শাসকশ্রেণিকে সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন, জনগণের প্রতি কর্তব্যহীন এবং বেপরোয়া করতে সহায়ক হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। যেভাবে জবাবদিহিতাহীন সরকার একের পর এক টিকে থাকছে, তার সব থেকে বড় শর্ত বামপন্থিরাই তৈরি করেছে। চিন্তার দেউলিয়াপনা ও নৈরাজ্য তাদের অবস্থাকে দাবার কমজোরি সৈন্যের মতো মানহীন গুটিতে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অবদান তুলনারহিত। রাষ্ট্র প্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চেতনা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আওয়ামী লীগের মতো করে ভাবে না অন্য কোনও বড় দল। এসব কারণে প্রয়োজন আওয়ামী লীগের। তবে তৃণমূলভিত্তিক দলের গত কয়েক দশকের পরিক্রমায় দেখা যায় বিত্তশালীরা কিংবা এমপি শহিদ ইসলাম পাপলু-র মতো সুযোগ সন্ধানীরা জায়গা করে নিয়েছে নানাভাবে। এ হতাশা নিয়েই শেষ হতে পারতো লেখাটি।
কিন্তু দুর্মর আশাবাদীরা আশা খুঁজে পাবেন কদিনের মধ্যেই হতে যাওয়া তিন সংসদীয় আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেখে, জনসম্পৃক্ত নেতাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সুবোধ মরেনি এখনো। আওয়ামী আদর্শ আর বাঙালি চেতনার জাদুকরী যুগল মধ্যস্ততায় বাংলাদেশের জন্ম, যা দরকার হতে পারে দেশের স্থিতির জন্য।
বাঙালি ও আওয়ামী চেতনার জাদুকরী যুগল মধ্যস্ততায় বাংলাদেশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ