ঢাকা ০২:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
১২৬তম জন্মজয়ন্তী

বাঙালির আবেগ-অনুভূতিতে চিরবিদ্রোহী কবি নজরুল

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৫:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

মাত্র বাইশ বছর লেখালেখি করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। জগৎকে জানিয়ে দিয়েছিলেন- নজরুল মানে বিদ্রোহ, ঘূর্ণি, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসার সুখছাউনি। এত বর্ণাঢ্য লেখনীর বৈচিত্র্য দুনিয়ার আর কোনো লেখকের কি আছে, না ছিল? আমাদের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছেন তিনি। চলার পথে পথে আলোর রশ্মি ছড়িয়েছেন। তিনি লিখেছেন বিদ্রোহের কবিতা ‘বল বীর’; আবার লিখলেন, ‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফঁস্ গয়ি…।’ তিনি মুগ্ধ হয়েছেন দূর দ্বীপবাসিনীকে দেখে। আবার লাইলির ফিরে আসায় মজনুর আঁখি খোলার বাসনা তার কবিতায়। এ বিষয় নিয়েই এবারের সাহিত্য পাতার প্রধান রচনা

কবি নজরুলের জন্ম ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। বাংলায় ওই দিনটি ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সাল। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। নজরুলের দাদার নাম ছিল কাজী আমিন উল্লাহ। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুনের তিনি ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান।

নজরুলের ছোটবেলার নাম ছিল দুখু মিয়া। অল্প বয়সে তিনি মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দিতেন। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন কট্টর। অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপসহীন। তিনি নারীর অধিকার নিয়েও স্পষ্টবাদী ছিলেন। ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। বাবার মৃত্যুতে সংসারে অভাব-অনটন পেয়ে বসে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয় কবির। বিভিন্ন পেশায় জড়িত হতে হয় কবিকে। তার পরও চেষ্টা করেন বিভিন্ন শিক্ষা মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। তিনি রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলেও পড়াশোনা করেন। এ সময় বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় তার বিশাল দখল ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন। নজরুল তরুণ বয়সে লোকশিল্পে নাট্যদলে যোগ দেন। তিনি লেটো ও কবিগানের আসরে অংশ নিতেন। অল্প বয়সে গান ও নাটকে কবির পারদর্শিতা সবাইকে মুগ্ধ করত।

পেশাগত জীবনে কবিকে অনেক ধরনের কাজই করতে হয়েছিল। আর্থিক সংকটের কারণে কাজ করেছেন রুটি বানানোর দোকানে। খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা ছিলেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময় পরিচয় আসানসোলের দারোগা রফিক উল্লাহর সঙ্গে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বুঝতে পারলেন নজরুলের মেধা মননের উচ্চতা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবিকে নিয়ে গেলেন তিনি। ভর্তি করালেন দরিরামপুর স্কুলে। ১৯১৭ সালের শেষ দিকে মাধ্যমিক প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। সৈনিক, করপোরাল থেকে হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ফারসি ভাষার চর্চা তখনই হয়েছিল। করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে নজরুলের সেনা ইউনিট ভেঙে দেওয়া হয়। চাকরিজীবন শেষ করে তিনি ফিরে যান কলকাতায়। এই সময় তিনি নিজের লেখাগুলো নিয়ে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নজরুলের লেখার প্রশংসা করেন তারা। এই সব লেখা প্রকাশের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তার প্রথম জীবনের লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়।

প্রেম ও দ্রোহ কী একসঙ্গে বুকে ধারণ করা যায়? জীবনের কোনো কিছুতে পরোয়া ছিল না তার। ছুটে বেড়াতেন বলগা হরিণের মতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠ। গাইতেন সাম্যের গান। বলতেন স্বাধীনতার কথা। আবার ভালোবেসে বেঁধেছিলেন ঘর। প্রেমেও পড়েছেন বারবার। পথচলায় ছিল না কোনো ক্লান্তি।

বদলে যেতে দেখলেন দুই দিন আগের শুভানুধ্যায়ীদের। মানুষের মুহূর্তে চেহারা বদল তাকে অবাক করল। কবি ফিরলেন আবার লেখালেখিতে। সব ধরনের লেখা লিখতেন দুই হাতে। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রবন্ধ। কোনো কিছুই বাদ ছিল না। লেখক জীবনের বয়স মাত্র বাইশ বছরের। তারপর হুট করে নির্বাক হলেন। আফসোস! আহা! তিনি আরো কিছুদিন লিখতে পারলে কী হতো? জীবনের সব অজানা দুঃখ-কষ্ট তাকে কুরে কুরে খেল। অজানা অসুস্থতা নিয়ে মানুষের পৃথিবীতে কথা বলা বন্ধ করলেন। থামিয়ে দিলেন লেখনী। কেউ প্রশ্ন করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। ভালোবাসার স্বপ্নচারিণী সামনে এলেও একবারের জন্যও বলতেন না, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল’। গাইতেন না আর সাম্যের গান। প্রিয়ার বিরহে লিখতেন না নতুন কবিতা। হয়তো মনে মনে বলতেন-

“পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও ব’লো না।”

কবি চিরতরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। অজানা ভয়াবহ অসুখ কবির শরীরে ভর করল। কবির কলম থেমে গেল। সভ্য দুনিয়ার মানুষের অসততা, ভণ্ডামি, নোংরামি, দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, মুহূর্তে রূপ বদলানো, স্বার্থপরতা স্তব্ধ করে দিল কবি নজরুলকে। তার নির্বাক চাউনিতে লুকিয়ে থাকত অজানা বেদনা। ভেতরে জমিয়ে রাখা কষ্ট শেয়ার করা হতো না কারো সঙ্গে। কবি হয়তো বলতে চাইতেন অনেক কিছু, বলতে পারতেন না। এভাবে কঠিন অসুখে দীর্ঘদিন ভুগলেন। তারপর চলে গেলেন চিরতরে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ কবি নজরুল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন।

মাহে রমজান শুরু করতে হয় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আর গানের লাইন নিয়ে। আবার ঈদের খুশির আলো ঝরে তার গানে। সেই নজরুলকে আমরা পাই পূজায়ও। এত শ্যামাসংগীত নজরুল ছাড়া আর কে লিখবেন? তিনি লিখেছেন, ‘শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে…।’ মনের অব্যক্ত কথা তিনি লিখেছেন, ‘ভীরু এ মনের কলি ফোটালে না কেন ফোটালে না-/জয় করে কেন নিলে না আমারে, কেন তুমি গেলে চলি।’

দুই হাতে গান লিখেছেন। তার লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। অনেকে বলেন, আরো অনেক ছিল; যা সংরক্ষণ করা হয়নি ঠিকভাবে। নজরুলের অনেক লেখা এখনো অপ্রকাশিত। আবার অনেক লেখা আসেনি সামনে। কবি দোল-পূর্ণিমা-রাতে ‘দোলন চাঁপা বনে’ ঘুরেছেন। হেঁটেছেন ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদায়’। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন’ নিয়ে ভেবেছেন। লিখেছেন গান।

জেলখানায় পাঠিয়েও তার লেখনী থামানো যায়নি। জেলেই লিখলেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। প্রকৃতি আর প্রেম তাকে মুগ্ধ করত। ঘুরতে পছন্দ করতেন। সব ধরনের সাহিত্য লিখে গেছেন। তার কবিতা ছাড়া ঈদ, পূজা- কিছুই হয় না। তার লেখা শ্যামাসংগীত দুর্গা ও কালীপূজায় বাজে। ভালোবেসে যুদ্ধে গেলে রণসংগীতেও আছেন নজরুল! আবার না-পাওয়ার বেদনা তাকে করেছিল নিঃস্ব। মনোবেদনায় লিখেছেন, ‘দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!’ চলার পথে ক্লান্ত হতেন। থামাতেন না পথচলা। পুত্রশোকেও টাকার জন্য গ্রামোফোন কম্পানিকে লিখে দিয়েছেন গান। দুঃখকষ্ট ছিল, তার পরও নিজের স্বকীয়তা থেকে বের হননি। ১৯১৭ সালে কবি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন মাত্র আড়াই বছর। সেই সময় শুরু হয় তার লেখা। ‘হেনা’, ‘মেহের নেগার’, ‘ব্যথার দান’, ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘মুক্তি’ লিখেছিলেন সেনাছাউনিতে বসে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দান কবির জীবন ও চিন্তা বদলে দিয়েছিল। দ্রোহ, প্রেম, বিরহ তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল মানুষের হৃদয়মন্দিরে। ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ চোখের জলেই অজানা ডাকের আহ্বানে থাকতেন কবি। গজল ‘তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম/ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদায়ী কালাম’। আল্লাহর সৃষ্টি খুঁজতে গিয়ে লিখেছেন ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবানী।’

সেনাবাহিনী ছেড়ে কবি চলে যান কলকাতা। ৩২ কলেজ স্ট্রিটে বসবাস শুরু করেন। থাকতেন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন সাহিত্যজগতে। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি লেখেন ‘রবিহারা’। ১৯২০ সালে তিনি শেরেবাংলা সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগ দেন। শুরু করেন সাংবাদিকতা। সে সময় শরৎচন্দ্রসহ তৎকালীন সব সাহিত্যিক, সাংবাদিকের সঙ্গে কবির ব্যক্তিগত অসাধারণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। নজরুল পত্রিকায় যোগদানের পর তাকে উৎসাহিত করেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র লেখা দিয়ে।

১৯২২ সালে নজরুল প্রকাশ করেন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। এ পত্রিকায় তাকে শুভেছা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন’। কবি বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন। ব্রিটিশদের ভালো লাগেনি সেই কেতন। তার লেখনীর ওপর খড়্গ নেমে আসে। আটক হন কবি। তারপর পত্রিকা বন্ধ। তার ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়। কুমিল্লা থেকে আটক করে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। আটকের পর আদালতে জবানবন্দি দেন। সাহিত্যের পাতায় যা এখন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ হিসেবে খ্যাত। এই জবানবন্দিতে কবি তুলে ধরেছিলেন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিজেকে। কবির সেই জবানবন্দি আলোড়িত করেছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীদের।

বঙ্গীয় মুসলমানদের দুটি গ্রুপ ছিল নজরুলকে ঘিরে। এক গ্রুপ তাকে পছন্দ করত, আরেক গ্রুপ ছিল বিরোধী। এখন মুসলিম সমাজ কবিকে নিজেদের লোক দাবি করে কান্নাকাটি করে। সেই সময়ে মুসলমানের একটি অংশই হৈচৈ শুরু করল যখন কবি লিখলেন, ‘মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ আবার গোঁড়া হিন্দুরা খুশি ছিলেন না তার ওপর। তারা খেপলেন কবির লেখা ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রকাশের পর। বাস্তব জীবনে কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার। তার বাড়িতে পূজা হতো আবার নামাজও হতো। এক পুত্রের নাম রাখলেন কৃষ্ণ, আরেকজনের মুহাম্মদ। এভাবে সবাই সবকিছু পারে না। নজরুল পেরেছেন। জয় করেছেন। এক ছেলেকে নিয়ে প্রমীলা দেবী বসতেন পূজায়। আরেকজনকে নিয়ে নজরুল যেতেন নামাজে। কোনো সমস্যা ছিল না। কবি দুই হাতে গজল লিখেছেন। খোদা ও নবীর বন্দনায় তার লেখা গজলের অভাব নেই। আবার তিনিই লিখেছেন পূজার গান।

সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কবি লড়েছেন সারাটা জীবন। এ কারণে অনেক ভোগান্তি ও সমালোচনায় পড়তে হয়েছিল। কবি সব চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়েছিলেন। শির উঁচু করে লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান।’ কবি সারাটা জীবন লড়েছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্যই। মানুষের কথা বলতে গিয়েই কারাভোগ করেছেন। জেলের ভেতরেও লেখনি থামেনি। লিখেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন সমর্থন করতেন। বিদ্রোহী, বিপ্লবীরা পছন্দ করতেন কবি নজরুলকে। নেতাজি সুভাষ বসু বলতেন, নজরুল আমাদের অনুপ্রেরণা। ফেনীর হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও তার বোন শামসুন নাহার মাহমুদ তখন ছিলেন শিক্ষায়-কর্মে পূর্ব বাংলার অগ্রসর মানুষ। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত এই পরিবারের সঙ্গেও কবির সম্পর্ক ছিল। কবি এই দুজনকে নিয়েও লিখেছেন কবিতা। যেতেন তাদের বাড়িতেও।

চলার পথে প্রেমের কবির স্বপ্নমিনারের বড় অংশ ছিল কুমিল্লা। তিনি লিখেছেন, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর—কে সেই সুন্দর কে!’ কবির প্রেম ও দ্রোহের শহর তখনকার ত্রিপুরার কুমিল্লা। বাবুদের তালপুকুর দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছেন কান্দিরপাড়-, রাণীর দীঘির তীরে। শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রথম তৈরি হয় কুমিল্লা শহরে। দুজন মিলে তৈরি করতেন সুরের ঝংকার। কুমিল্লায় নজরুলের হাজারো স্মৃতি। ফরিদা বিদ্যানিকেতনের বিপরীতের সেই স্মৃতির ঘরগুলো হয়তো নেই। ঐতিহ্যের কুমিল্লার বাতাস এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে নজরুলের নিঃশ্বাসের শব্দ। গবেষকদের লেখনীতে সব কিছু ভালোভাবে উঠে আসেনি। এসেছে প্রেম ও বিয়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কুমিল্লার অংশ নিয়ে আরো গবেষণা হতে পারে। নজরুল কুমিল্লায় সাম্যের গান গেয়েছেন। মানুষকে শুনিয়েছেন স্বাধিকারের কথা।

কবি নজরুল অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আটক হয়েছিলেন কুমিল্লা থেকে। সেসব নিয়ে কবির কোনো আক্ষেপ ছিল না। বরং কুমিল্লার প্রতি কবির মোহ ছিল। ভালোবেসে কুমিল্লায় বেঁধেছিলেন ঘর। পড়েছিলেন কুমিল্লার মেয়েদের প্রেমে। বিয়ের আসরে মোহরানা আর ঘরজামাই থাকার বিরোধ তাকে থামাতে পারেনি। দুঃখের গহিন বনে আবারো ভালোবাসার সূত্র খুঁজেছেন কুমিল্লায়। বের করেছেন নিজের হৃদয়ের স্পন্দন। কবি নজরুলের ‘এই আঁখি জল মোছো প্রিয়া’- কুমিল্লার তখনকার নাম ছিল ত্রিপুরা।
মুরাদনগরের দৌলতপুর কবির বিরহের গ্রাম। শহর ছিল স্বস্তি ও ক্লান্তিহীন প্রেম। রাণীর দিঘির জলচ্ছায়ায় কবি নিজেকে খুঁজতেন। দৌলতপুরের সেই রাতের কষ্ট ভুলতে কবি লিখেছেন প্রেম-বিরহের অনেক কবিতা। কলকাতার প্রকাশক বন্ধু আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে দৌলতপুরে গিয়েছিলেন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। গ্রামে সবার সঙ্গে মিশে গেলেন। আনন্দ-উচ্ছলতায় কবি বাজালেন বাঁশের বাঁশুরি। একদিন পুকুরঘাটে লম্বা খোলা চুলের তরুণীর ছায়া দেখলেন নজরুল। বিস্মিত নয়নে তাকালেন। দু’জনের চোখাচুখি হলো। দৃষ্টি বিনিময়েই নজরুল নাম দিলেন নার্গিস। সৈয়দা খাতুন নামের মেয়েটি ছিল আলী আকবরের ভাগ্নি। নজরুল তার ভালো লাগার কথা জানালেন। সিদ্ধান্ত হলো, নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হবে সেই তরুণীর। বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন নজরুল। সৈয়দা খাতুনেরও আপত্তি নেই। নজরুলের বাঁশি মুগ্ধ করেছে তাকে। বিয়ে পড়ানোর পর সবাই মত দিলেন, চালচুলাহীন কবিকে ঘরজামাই থাকতে হবে। কোনোভাবে মুরাদনগর ছাড়া যাবে না। লেখালেখি এখানে বসেই করতে হবে। কবি সব শুনলেন। তারপর বললেন, সৈয়দা খাতুনকে নিয়ে ফিরতে চান কলকাতায়। কেউ সম্মত হলেন না। এমনকি আলী আকবর খানও না। ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবাদে নজরুলের মন খারাপ হলো। ঝগড়া-বিবাদের নীরব অভিমানে মাঝরাতে কবি মুরাদনগর ছাড়লেন। হয়নি নবদম্পতির ফুলের বাসর।

কাঁটার ঘায়ে জর্জরিত কবিকে ঠাঁই দিলেন কুমিল্লা শহরের বিরজা দেবী। কবি পেলেন মায়ের স্নেহ। ৩০ মাইল হেঁটে আসা নজরুল ছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তার মন ভেঙে গেছে। শরীরের অবস্থা ভালো ছিল না। বিরজা দেবীর বাড়িতে ছিলেন অনেক দিন। তারপর বিয়ে করলেন বিরজা দেবীর ভাশুরের মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তকে। বিয়ের পর নজরুল তার নাম দিলেন আশালতা। হিন্দুু-মুসলিম বিয়ে এত সহজ ছিল না। এ নিয়েও কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল।

অন্যদিকে বাসরঘর করতে না পারা সৈয়দা খাতুন অনেক বছর নজরুলের প্রতীক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের মিলন হয়নি। আরেকজন কবিকে বিয়ে করে সংসার গড়েছিলেন সৈয়দা খাতুন। তার শেষ জীবনটা ইংল্যান্ডে কেটেছিল। সৈয়দা খাতুনের দুই সন্তান ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় অবস্থান গড়েছিলেন। মৃত্যুর পর সৈয়দা খাতুনের দাফন ব্রিটেনে হয়।

প্রেম ও বিরহের কবির জীবনে আরো অনেক অধ্যায় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার একতরফা প্রেমে পড়েছিলেন নজরুল। এই প্রেমের বিষয়টি উঠে আসে কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে কবির চিঠি বিনিময়ে। মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে তাদের সাক্ষাৎ হয়। কবি নজরুল হাত দেখতে পারতেন- এমন একটা খবর ছিল ফজিলাতুন্নেছার কাছে। তিনি বর্ধমান হাউসে কবিকে তার হাত দেখতে দিয়েছিলেন। কবি হাত দেখলেন। বললেন অনেক কথা। দুজনের কথোপকথনের পর প্রেমে পড়েন নজরুল। একটা ভয়াবহ ঘোর তৈরি হয় কবির মনের ভেতর। ১৯২৮ সালের কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেছার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে হাজির হন কবি। সরাসরি প্রেম নিবেদন করেন। এত রাতে এইভাবে কবিকে দেখে অবাক হলেন ফজিলেতুন্নেছা। কবিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এ নিয়ে কবির জীবনে বড় আক্ষেপ ছিল। প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা ছিল। মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিতে কবি সেই সব কষ্টের কথা লিখতেন। ফজিলাতুন্নেছাকেও চিঠি লিখেছিলেন নজরুল। উত্তর পাননি। কবি সন্দেহ করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দুু শিক্ষকের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেছার প্রেম ছিল। সেই সন্দেহের কথাও তিনি লিখেছেন অনেক বেদনা নিয়ে।
কবির জীবনের আরেক অংশে ছিলেন প্রতিভা বসু। ‘জীবনের জলছবি’ গ্রন্থে প্রতিভা বসু লিখেছেন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতির কথা। আছে কলকাতা ও ঢাকার অনেক হারানো সুর। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে বাস করতেন প্রতিভা বসুরা।

তখন তার নাম ছিল রানু সোম। বাসায় তিনি গান শিখতেন। ওস্তাদ ছিলেন দিলীপ রায়। দিলীপ রায় নজরুলগীতিও শেখাতেন। নজরুলগীতি মুগ্ধ করত রানু সোমকে। এ সময় ঢাকায় আসেন কবি নজরুল। একদিন দিলীপ রায় নজরুলকে নিয়ে আসেন রানু সোমদের ওয়ারীর বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা হলো। এরপর কবি মাঝে মাঝে আসতেন এই বাড়িতে। ওয়ারীতে তখন বনেদি হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। মহল্লার ছেলেরা দেখল, ঝাঁকড়া চুলের লোকটি নিয়মিত এই বাড়িতে আসে। তারা সন্দেহ করল, এই বাড়ির মেয়ে রানুর সঙ্গে লোকটার সম্পর্ক আছে। একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের সম্পর্ক? আর যায় কোথায়। রানু সোমের বাড়িতে আসতে গিয়ে নজরুল আক্রমণের শিকার হলেন। ওয়ারীর হিন্দু যুবকরা নজরুলের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করল। এর অনেক দিন পর রেলস্টেশনে কবিকে দেখেন রানু সোম। তখন তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু। কবির দিকে এগিয়ে যান। কবি তাকিয়ে থাকেন, চিনতে পারেন না। কারণ তিনি তখন নির্বাক জীবনে।

কবির আরেকটি প্রেমের কথা কলকাতার একটি পত্রিকা রসালোভাবে প্রকাশ করে। কানন দেবী নামের এক গায়িকাকে গান শেখাতেন কবি। অনেক সময় গান শেখাতে গিয়ে সেই বাড়িতে বেশি সময় থাকতেন। কখনো রাতের খাবার খেতে দেরি হতো। কবির এই আসা-যাওয়া সহ্য হলো না পাড়ার লোকদের, আশপাশের বন্ধুদের। তারা গসিপ ছড়াল। এমন আরো অনেক গল্পে কবি বিস্মিত হতেন। হতাশ হতেন। থামতেন না। প্রেমের কবি চলতেন আপন গতিতে।

প্রেম নিয়ে অচেনা কষ্ট কবির বুকে বাসা বাঁধত। ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন, ‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’ দহনে সিক্ত কবি লিখেছেন ভালোবাসার মানুষকে, ‘তুমি দেবী চিরশুদ্ধা তাপস কুমারী, তুমি মম পুজারিণী’। আবার দুঃখের দহনে লিখেছেন, ‘এরা দেবী, এরা লোভী যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো! ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।’

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর না যেতেই কবি নজরুল ১৯৪২ সালে অসুস্থ হন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত নীরবে এক ধরনের কষ্টের জীবন অতিবাহিত করেন। এই সময়ে তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থের সংকট ছিল। অসুস্থতায় ধীরে ধীরে ফুলের জলসায় নীরব কবি। কী কারণে কবি নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন? এ নিয়ে বিতর্ক ব্রিটিশ শাসনকাল ১৯৪২ সাল থেকে। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দেন। বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য ২০ জুলাই কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় বিহারের মধুপুরে। সবাই ভাবলেন কবি ঠিক হয়ে যাবেন। না, কবি ঠিক হননি। ফিরে আসেন কলকাতায়। এ নিয়ে কবির প্রিয়ভাজন সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তার আত্মকথায় নিউরোসার্জন ড. অশোক কুমার বাগচীর কথা লিখেছেন। আর ড. বাগচীর মতামত ছিল খোলামেলা। ড. বাগচীর মতে, নজরুলের অসুস্থতার লক্ষণ প্রথম যখন প্রকাশ পায় তখন বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে তার স্ত্রী প্রমীলার অসুস্থতার পর কবি কিছুদিন কালী সাধনা করেছেন। গেরুয়া পোশাক পরতেন আর মাথায় ছিল একই রঙের টুপি। কবির এই চালচলন, বেশভূষাকে অনেকেই ধরে নেন মানসিক বৈকল্য হিসেবে। সেই সময় থেকেই কবির সুর-তাল ক্ষয়ে যেতে থাকে। গ্রামোফোন কম্পানিতে গান গাওয়ার সময় তা প্রকাশও পেতে থাকে। কবি একটু-আধটু বেসুরো হতে থাকেন। অবশ্য ধরিয়ে দিলে সংশোধন হতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু পুরোপুরি অসুস্থ হওয়ার পর তিনি সব কিছুর বাইরে চলে যান। এই সময় চশমাধারী কোনো মানুষকে দেখলে খেপে যেতেন। উত্তেজিত হতেন। এ কারণে ড. অশোক বাগচীর ধারণা ছিল, কোনো চশমাধারী ব্যক্তি কবির বড় ধরনের ক্ষতি করেছিল; যা তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে যায়। ড. বাগচী বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, ‘স্নায়বিক বৈকল্য’ মতামতাই যথার্থ। ১৯৫৩ সালে ভিয়েনার বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকরা স্নায়বিক বৈকল্য মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। তারা বলেছিলেন, ১৯৩৯ সাল থেকে কবির সঠিক চিকিৎসা হলে তিনি বাকরুদ্ধ থাকতেন না। ঠিকভাবে তার চিকিৎসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ড. বাগচীরও একই মত। ভিয়েনার চিকিৎসকরা আরো বললেন, ১৯৫৩ সালে এসে নজরুল চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরে চলে যান। তখন আর কিছু করার নেই চিকিৎসকদের। হাল ছেড়ে দিলেন তারা।

১৯৫৩ সালে কবি নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড পাঠানো হয়। চিকিৎসা শেষে ফিরে এলেন। আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। বললেন না নতুন করে কাউকে ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য।’ তিনি আর উচ্চারণ করতে পারলেন না ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। বললেন না বিধাতাকে- ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।’ কী এমন মানসিক দুঃখ ছিল, যার কারণে কবি নজরুল ভেঙে হয়েছিলেন খান খান। চিরতরে তাকে পেয়ে বসে নীরবতা, নিস্তব্ধতা। অজানা কষ্ট নিয়ে কবি চিরতরে স্তব্ধ হলেন ১৯৭৬ সালে। চলে গেলেন চিরতরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই কবির ঠাঁই হয়েছে। সেখানে শুয়ে তিনি হয়তো শুনছেন আজানের ধ্বনি। হয়তো খুঁজছেন বুক চিরে ব্যথা জড়ানো সেই প্রিয়াকে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রধান উপদেষ্টা হতাশ-ক্ষুব্ধ, ‘পদত্যাগ’ নিয়ে আলোচনা

১২৬তম জন্মজয়ন্তী

বাঙালির আবেগ-অনুভূতিতে চিরবিদ্রোহী কবি নজরুল

আপডেট সময় : ০৮:৪৫:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

মাত্র বাইশ বছর লেখালেখি করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। জগৎকে জানিয়ে দিয়েছিলেন- নজরুল মানে বিদ্রোহ, ঘূর্ণি, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসার সুখছাউনি। এত বর্ণাঢ্য লেখনীর বৈচিত্র্য দুনিয়ার আর কোনো লেখকের কি আছে, না ছিল? আমাদের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছেন তিনি। চলার পথে পথে আলোর রশ্মি ছড়িয়েছেন। তিনি লিখেছেন বিদ্রোহের কবিতা ‘বল বীর’; আবার লিখলেন, ‘আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফঁস্ গয়ি…।’ তিনি মুগ্ধ হয়েছেন দূর দ্বীপবাসিনীকে দেখে। আবার লাইলির ফিরে আসায় মজনুর আঁখি খোলার বাসনা তার কবিতায়। এ বিষয় নিয়েই এবারের সাহিত্য পাতার প্রধান রচনা

কবি নজরুলের জন্ম ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। বাংলায় ওই দিনটি ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সাল। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। নজরুলের দাদার নাম ছিল কাজী আমিন উল্লাহ। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুনের তিনি ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান।

নজরুলের ছোটবেলার নাম ছিল দুখু মিয়া। অল্প বয়সে তিনি মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দিতেন। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন কট্টর। অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপসহীন। তিনি নারীর অধিকার নিয়েও স্পষ্টবাদী ছিলেন। ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। বাবার মৃত্যুতে সংসারে অভাব-অনটন পেয়ে বসে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয় কবির। বিভিন্ন পেশায় জড়িত হতে হয় কবিকে। তার পরও চেষ্টা করেন বিভিন্ন শিক্ষা মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। তিনি রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলেও পড়াশোনা করেন। এ সময় বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় তার বিশাল দখল ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন। নজরুল তরুণ বয়সে লোকশিল্পে নাট্যদলে যোগ দেন। তিনি লেটো ও কবিগানের আসরে অংশ নিতেন। অল্প বয়সে গান ও নাটকে কবির পারদর্শিতা সবাইকে মুগ্ধ করত।

পেশাগত জীবনে কবিকে অনেক ধরনের কাজই করতে হয়েছিল। আর্থিক সংকটের কারণে কাজ করেছেন রুটি বানানোর দোকানে। খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা ছিলেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময় পরিচয় আসানসোলের দারোগা রফিক উল্লাহর সঙ্গে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বুঝতে পারলেন নজরুলের মেধা মননের উচ্চতা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবিকে নিয়ে গেলেন তিনি। ভর্তি করালেন দরিরামপুর স্কুলে। ১৯১৭ সালের শেষ দিকে মাধ্যমিক প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। সৈনিক, করপোরাল থেকে হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ফারসি ভাষার চর্চা তখনই হয়েছিল। করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে নজরুলের সেনা ইউনিট ভেঙে দেওয়া হয়। চাকরিজীবন শেষ করে তিনি ফিরে যান কলকাতায়। এই সময় তিনি নিজের লেখাগুলো নিয়ে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নজরুলের লেখার প্রশংসা করেন তারা। এই সব লেখা প্রকাশের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তার প্রথম জীবনের লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়।

প্রেম ও দ্রোহ কী একসঙ্গে বুকে ধারণ করা যায়? জীবনের কোনো কিছুতে পরোয়া ছিল না তার। ছুটে বেড়াতেন বলগা হরিণের মতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠ। গাইতেন সাম্যের গান। বলতেন স্বাধীনতার কথা। আবার ভালোবেসে বেঁধেছিলেন ঘর। প্রেমেও পড়েছেন বারবার। পথচলায় ছিল না কোনো ক্লান্তি।

বদলে যেতে দেখলেন দুই দিন আগের শুভানুধ্যায়ীদের। মানুষের মুহূর্তে চেহারা বদল তাকে অবাক করল। কবি ফিরলেন আবার লেখালেখিতে। সব ধরনের লেখা লিখতেন দুই হাতে। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রবন্ধ। কোনো কিছুই বাদ ছিল না। লেখক জীবনের বয়স মাত্র বাইশ বছরের। তারপর হুট করে নির্বাক হলেন। আফসোস! আহা! তিনি আরো কিছুদিন লিখতে পারলে কী হতো? জীবনের সব অজানা দুঃখ-কষ্ট তাকে কুরে কুরে খেল। অজানা অসুস্থতা নিয়ে মানুষের পৃথিবীতে কথা বলা বন্ধ করলেন। থামিয়ে দিলেন লেখনী। কেউ প্রশ্ন করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। ভালোবাসার স্বপ্নচারিণী সামনে এলেও একবারের জন্যও বলতেন না, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল’। গাইতেন না আর সাম্যের গান। প্রিয়ার বিরহে লিখতেন না নতুন কবিতা। হয়তো মনে মনে বলতেন-

“পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও ব’লো না।”

কবি চিরতরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। অজানা ভয়াবহ অসুখ কবির শরীরে ভর করল। কবির কলম থেমে গেল। সভ্য দুনিয়ার মানুষের অসততা, ভণ্ডামি, নোংরামি, দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, মুহূর্তে রূপ বদলানো, স্বার্থপরতা স্তব্ধ করে দিল কবি নজরুলকে। তার নির্বাক চাউনিতে লুকিয়ে থাকত অজানা বেদনা। ভেতরে জমিয়ে রাখা কষ্ট শেয়ার করা হতো না কারো সঙ্গে। কবি হয়তো বলতে চাইতেন অনেক কিছু, বলতে পারতেন না। এভাবে কঠিন অসুখে দীর্ঘদিন ভুগলেন। তারপর চলে গেলেন চিরতরে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ কবি নজরুল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন।

মাহে রমজান শুরু করতে হয় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আর গানের লাইন নিয়ে। আবার ঈদের খুশির আলো ঝরে তার গানে। সেই নজরুলকে আমরা পাই পূজায়ও। এত শ্যামাসংগীত নজরুল ছাড়া আর কে লিখবেন? তিনি লিখেছেন, ‘শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে…।’ মনের অব্যক্ত কথা তিনি লিখেছেন, ‘ভীরু এ মনের কলি ফোটালে না কেন ফোটালে না-/জয় করে কেন নিলে না আমারে, কেন তুমি গেলে চলি।’

দুই হাতে গান লিখেছেন। তার লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। অনেকে বলেন, আরো অনেক ছিল; যা সংরক্ষণ করা হয়নি ঠিকভাবে। নজরুলের অনেক লেখা এখনো অপ্রকাশিত। আবার অনেক লেখা আসেনি সামনে। কবি দোল-পূর্ণিমা-রাতে ‘দোলন চাঁপা বনে’ ঘুরেছেন। হেঁটেছেন ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদায়’। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন’ নিয়ে ভেবেছেন। লিখেছেন গান।

জেলখানায় পাঠিয়েও তার লেখনী থামানো যায়নি। জেলেই লিখলেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। প্রকৃতি আর প্রেম তাকে মুগ্ধ করত। ঘুরতে পছন্দ করতেন। সব ধরনের সাহিত্য লিখে গেছেন। তার কবিতা ছাড়া ঈদ, পূজা- কিছুই হয় না। তার লেখা শ্যামাসংগীত দুর্গা ও কালীপূজায় বাজে। ভালোবেসে যুদ্ধে গেলে রণসংগীতেও আছেন নজরুল! আবার না-পাওয়ার বেদনা তাকে করেছিল নিঃস্ব। মনোবেদনায় লিখেছেন, ‘দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!’ চলার পথে ক্লান্ত হতেন। থামাতেন না পথচলা। পুত্রশোকেও টাকার জন্য গ্রামোফোন কম্পানিকে লিখে দিয়েছেন গান। দুঃখকষ্ট ছিল, তার পরও নিজের স্বকীয়তা থেকে বের হননি। ১৯১৭ সালে কবি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন মাত্র আড়াই বছর। সেই সময় শুরু হয় তার লেখা। ‘হেনা’, ‘মেহের নেগার’, ‘ব্যথার দান’, ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘মুক্তি’ লিখেছিলেন সেনাছাউনিতে বসে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দান কবির জীবন ও চিন্তা বদলে দিয়েছিল। দ্রোহ, প্রেম, বিরহ তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল মানুষের হৃদয়মন্দিরে। ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ চোখের জলেই অজানা ডাকের আহ্বানে থাকতেন কবি। গজল ‘তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম/ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদায়ী কালাম’। আল্লাহর সৃষ্টি খুঁজতে গিয়ে লিখেছেন ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবানী।’

সেনাবাহিনী ছেড়ে কবি চলে যান কলকাতা। ৩২ কলেজ স্ট্রিটে বসবাস শুরু করেন। থাকতেন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন সাহিত্যজগতে। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি লেখেন ‘রবিহারা’। ১৯২০ সালে তিনি শেরেবাংলা সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগ দেন। শুরু করেন সাংবাদিকতা। সে সময় শরৎচন্দ্রসহ তৎকালীন সব সাহিত্যিক, সাংবাদিকের সঙ্গে কবির ব্যক্তিগত অসাধারণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। নজরুল পত্রিকায় যোগদানের পর তাকে উৎসাহিত করেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র লেখা দিয়ে।

১৯২২ সালে নজরুল প্রকাশ করেন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। এ পত্রিকায় তাকে শুভেছা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন’। কবি বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন। ব্রিটিশদের ভালো লাগেনি সেই কেতন। তার লেখনীর ওপর খড়্গ নেমে আসে। আটক হন কবি। তারপর পত্রিকা বন্ধ। তার ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়। কুমিল্লা থেকে আটক করে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। আটকের পর আদালতে জবানবন্দি দেন। সাহিত্যের পাতায় যা এখন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ হিসেবে খ্যাত। এই জবানবন্দিতে কবি তুলে ধরেছিলেন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিজেকে। কবির সেই জবানবন্দি আলোড়িত করেছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীদের।

বঙ্গীয় মুসলমানদের দুটি গ্রুপ ছিল নজরুলকে ঘিরে। এক গ্রুপ তাকে পছন্দ করত, আরেক গ্রুপ ছিল বিরোধী। এখন মুসলিম সমাজ কবিকে নিজেদের লোক দাবি করে কান্নাকাটি করে। সেই সময়ে মুসলমানের একটি অংশই হৈচৈ শুরু করল যখন কবি লিখলেন, ‘মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ আবার গোঁড়া হিন্দুরা খুশি ছিলেন না তার ওপর। তারা খেপলেন কবির লেখা ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রকাশের পর। বাস্তব জীবনে কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার। তার বাড়িতে পূজা হতো আবার নামাজও হতো। এক পুত্রের নাম রাখলেন কৃষ্ণ, আরেকজনের মুহাম্মদ। এভাবে সবাই সবকিছু পারে না। নজরুল পেরেছেন। জয় করেছেন। এক ছেলেকে নিয়ে প্রমীলা দেবী বসতেন পূজায়। আরেকজনকে নিয়ে নজরুল যেতেন নামাজে। কোনো সমস্যা ছিল না। কবি দুই হাতে গজল লিখেছেন। খোদা ও নবীর বন্দনায় তার লেখা গজলের অভাব নেই। আবার তিনিই লিখেছেন পূজার গান।

সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কবি লড়েছেন সারাটা জীবন। এ কারণে অনেক ভোগান্তি ও সমালোচনায় পড়তে হয়েছিল। কবি সব চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়েছিলেন। শির উঁচু করে লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান।’ কবি সারাটা জীবন লড়েছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্যই। মানুষের কথা বলতে গিয়েই কারাভোগ করেছেন। জেলের ভেতরেও লেখনি থামেনি। লিখেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন সমর্থন করতেন। বিদ্রোহী, বিপ্লবীরা পছন্দ করতেন কবি নজরুলকে। নেতাজি সুভাষ বসু বলতেন, নজরুল আমাদের অনুপ্রেরণা। ফেনীর হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও তার বোন শামসুন নাহার মাহমুদ তখন ছিলেন শিক্ষায়-কর্মে পূর্ব বাংলার অগ্রসর মানুষ। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত এই পরিবারের সঙ্গেও কবির সম্পর্ক ছিল। কবি এই দুজনকে নিয়েও লিখেছেন কবিতা। যেতেন তাদের বাড়িতেও।

চলার পথে প্রেমের কবির স্বপ্নমিনারের বড় অংশ ছিল কুমিল্লা। তিনি লিখেছেন, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর—কে সেই সুন্দর কে!’ কবির প্রেম ও দ্রোহের শহর তখনকার ত্রিপুরার কুমিল্লা। বাবুদের তালপুকুর দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছেন কান্দিরপাড়-, রাণীর দীঘির তীরে। শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রথম তৈরি হয় কুমিল্লা শহরে। দুজন মিলে তৈরি করতেন সুরের ঝংকার। কুমিল্লায় নজরুলের হাজারো স্মৃতি। ফরিদা বিদ্যানিকেতনের বিপরীতের সেই স্মৃতির ঘরগুলো হয়তো নেই। ঐতিহ্যের কুমিল্লার বাতাস এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে নজরুলের নিঃশ্বাসের শব্দ। গবেষকদের লেখনীতে সব কিছু ভালোভাবে উঠে আসেনি। এসেছে প্রেম ও বিয়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কুমিল্লার অংশ নিয়ে আরো গবেষণা হতে পারে। নজরুল কুমিল্লায় সাম্যের গান গেয়েছেন। মানুষকে শুনিয়েছেন স্বাধিকারের কথা।

কবি নজরুল অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আটক হয়েছিলেন কুমিল্লা থেকে। সেসব নিয়ে কবির কোনো আক্ষেপ ছিল না। বরং কুমিল্লার প্রতি কবির মোহ ছিল। ভালোবেসে কুমিল্লায় বেঁধেছিলেন ঘর। পড়েছিলেন কুমিল্লার মেয়েদের প্রেমে। বিয়ের আসরে মোহরানা আর ঘরজামাই থাকার বিরোধ তাকে থামাতে পারেনি। দুঃখের গহিন বনে আবারো ভালোবাসার সূত্র খুঁজেছেন কুমিল্লায়। বের করেছেন নিজের হৃদয়ের স্পন্দন। কবি নজরুলের ‘এই আঁখি জল মোছো প্রিয়া’- কুমিল্লার তখনকার নাম ছিল ত্রিপুরা।
মুরাদনগরের দৌলতপুর কবির বিরহের গ্রাম। শহর ছিল স্বস্তি ও ক্লান্তিহীন প্রেম। রাণীর দিঘির জলচ্ছায়ায় কবি নিজেকে খুঁজতেন। দৌলতপুরের সেই রাতের কষ্ট ভুলতে কবি লিখেছেন প্রেম-বিরহের অনেক কবিতা। কলকাতার প্রকাশক বন্ধু আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে দৌলতপুরে গিয়েছিলেন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। গ্রামে সবার সঙ্গে মিশে গেলেন। আনন্দ-উচ্ছলতায় কবি বাজালেন বাঁশের বাঁশুরি। একদিন পুকুরঘাটে লম্বা খোলা চুলের তরুণীর ছায়া দেখলেন নজরুল। বিস্মিত নয়নে তাকালেন। দু’জনের চোখাচুখি হলো। দৃষ্টি বিনিময়েই নজরুল নাম দিলেন নার্গিস। সৈয়দা খাতুন নামের মেয়েটি ছিল আলী আকবরের ভাগ্নি। নজরুল তার ভালো লাগার কথা জানালেন। সিদ্ধান্ত হলো, নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হবে সেই তরুণীর। বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন নজরুল। সৈয়দা খাতুনেরও আপত্তি নেই। নজরুলের বাঁশি মুগ্ধ করেছে তাকে। বিয়ে পড়ানোর পর সবাই মত দিলেন, চালচুলাহীন কবিকে ঘরজামাই থাকতে হবে। কোনোভাবে মুরাদনগর ছাড়া যাবে না। লেখালেখি এখানে বসেই করতে হবে। কবি সব শুনলেন। তারপর বললেন, সৈয়দা খাতুনকে নিয়ে ফিরতে চান কলকাতায়। কেউ সম্মত হলেন না। এমনকি আলী আকবর খানও না। ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবাদে নজরুলের মন খারাপ হলো। ঝগড়া-বিবাদের নীরব অভিমানে মাঝরাতে কবি মুরাদনগর ছাড়লেন। হয়নি নবদম্পতির ফুলের বাসর।

কাঁটার ঘায়ে জর্জরিত কবিকে ঠাঁই দিলেন কুমিল্লা শহরের বিরজা দেবী। কবি পেলেন মায়ের স্নেহ। ৩০ মাইল হেঁটে আসা নজরুল ছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তার মন ভেঙে গেছে। শরীরের অবস্থা ভালো ছিল না। বিরজা দেবীর বাড়িতে ছিলেন অনেক দিন। তারপর বিয়ে করলেন বিরজা দেবীর ভাশুরের মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তকে। বিয়ের পর নজরুল তার নাম দিলেন আশালতা। হিন্দুু-মুসলিম বিয়ে এত সহজ ছিল না। এ নিয়েও কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল।

অন্যদিকে বাসরঘর করতে না পারা সৈয়দা খাতুন অনেক বছর নজরুলের প্রতীক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের মিলন হয়নি। আরেকজন কবিকে বিয়ে করে সংসার গড়েছিলেন সৈয়দা খাতুন। তার শেষ জীবনটা ইংল্যান্ডে কেটেছিল। সৈয়দা খাতুনের দুই সন্তান ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় অবস্থান গড়েছিলেন। মৃত্যুর পর সৈয়দা খাতুনের দাফন ব্রিটেনে হয়।

প্রেম ও বিরহের কবির জীবনে আরো অনেক অধ্যায় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার একতরফা প্রেমে পড়েছিলেন নজরুল। এই প্রেমের বিষয়টি উঠে আসে কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে কবির চিঠি বিনিময়ে। মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে তাদের সাক্ষাৎ হয়। কবি নজরুল হাত দেখতে পারতেন- এমন একটা খবর ছিল ফজিলাতুন্নেছার কাছে। তিনি বর্ধমান হাউসে কবিকে তার হাত দেখতে দিয়েছিলেন। কবি হাত দেখলেন। বললেন অনেক কথা। দুজনের কথোপকথনের পর প্রেমে পড়েন নজরুল। একটা ভয়াবহ ঘোর তৈরি হয় কবির মনের ভেতর। ১৯২৮ সালের কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেছার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে হাজির হন কবি। সরাসরি প্রেম নিবেদন করেন। এত রাতে এইভাবে কবিকে দেখে অবাক হলেন ফজিলেতুন্নেছা। কবিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এ নিয়ে কবির জীবনে বড় আক্ষেপ ছিল। প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা ছিল। মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিতে কবি সেই সব কষ্টের কথা লিখতেন। ফজিলাতুন্নেছাকেও চিঠি লিখেছিলেন নজরুল। উত্তর পাননি। কবি সন্দেহ করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দুু শিক্ষকের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেছার প্রেম ছিল। সেই সন্দেহের কথাও তিনি লিখেছেন অনেক বেদনা নিয়ে।
কবির জীবনের আরেক অংশে ছিলেন প্রতিভা বসু। ‘জীবনের জলছবি’ গ্রন্থে প্রতিভা বসু লিখেছেন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতির কথা। আছে কলকাতা ও ঢাকার অনেক হারানো সুর। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে বাস করতেন প্রতিভা বসুরা।

তখন তার নাম ছিল রানু সোম। বাসায় তিনি গান শিখতেন। ওস্তাদ ছিলেন দিলীপ রায়। দিলীপ রায় নজরুলগীতিও শেখাতেন। নজরুলগীতি মুগ্ধ করত রানু সোমকে। এ সময় ঢাকায় আসেন কবি নজরুল। একদিন দিলীপ রায় নজরুলকে নিয়ে আসেন রানু সোমদের ওয়ারীর বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা হলো। এরপর কবি মাঝে মাঝে আসতেন এই বাড়িতে। ওয়ারীতে তখন বনেদি হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। মহল্লার ছেলেরা দেখল, ঝাঁকড়া চুলের লোকটি নিয়মিত এই বাড়িতে আসে। তারা সন্দেহ করল, এই বাড়ির মেয়ে রানুর সঙ্গে লোকটার সম্পর্ক আছে। একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের সম্পর্ক? আর যায় কোথায়। রানু সোমের বাড়িতে আসতে গিয়ে নজরুল আক্রমণের শিকার হলেন। ওয়ারীর হিন্দু যুবকরা নজরুলের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করল। এর অনেক দিন পর রেলস্টেশনে কবিকে দেখেন রানু সোম। তখন তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু। কবির দিকে এগিয়ে যান। কবি তাকিয়ে থাকেন, চিনতে পারেন না। কারণ তিনি তখন নির্বাক জীবনে।

কবির আরেকটি প্রেমের কথা কলকাতার একটি পত্রিকা রসালোভাবে প্রকাশ করে। কানন দেবী নামের এক গায়িকাকে গান শেখাতেন কবি। অনেক সময় গান শেখাতে গিয়ে সেই বাড়িতে বেশি সময় থাকতেন। কখনো রাতের খাবার খেতে দেরি হতো। কবির এই আসা-যাওয়া সহ্য হলো না পাড়ার লোকদের, আশপাশের বন্ধুদের। তারা গসিপ ছড়াল। এমন আরো অনেক গল্পে কবি বিস্মিত হতেন। হতাশ হতেন। থামতেন না। প্রেমের কবি চলতেন আপন গতিতে।

প্রেম নিয়ে অচেনা কষ্ট কবির বুকে বাসা বাঁধত। ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন, ‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’ দহনে সিক্ত কবি লিখেছেন ভালোবাসার মানুষকে, ‘তুমি দেবী চিরশুদ্ধা তাপস কুমারী, তুমি মম পুজারিণী’। আবার দুঃখের দহনে লিখেছেন, ‘এরা দেবী, এরা লোভী যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো! ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।’

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর না যেতেই কবি নজরুল ১৯৪২ সালে অসুস্থ হন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত নীরবে এক ধরনের কষ্টের জীবন অতিবাহিত করেন। এই সময়ে তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থের সংকট ছিল। অসুস্থতায় ধীরে ধীরে ফুলের জলসায় নীরব কবি। কী কারণে কবি নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন? এ নিয়ে বিতর্ক ব্রিটিশ শাসনকাল ১৯৪২ সাল থেকে। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দেন। বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য ২০ জুলাই কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় বিহারের মধুপুরে। সবাই ভাবলেন কবি ঠিক হয়ে যাবেন। না, কবি ঠিক হননি। ফিরে আসেন কলকাতায়। এ নিয়ে কবির প্রিয়ভাজন সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তার আত্মকথায় নিউরোসার্জন ড. অশোক কুমার বাগচীর কথা লিখেছেন। আর ড. বাগচীর মতামত ছিল খোলামেলা। ড. বাগচীর মতে, নজরুলের অসুস্থতার লক্ষণ প্রথম যখন প্রকাশ পায় তখন বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে তার স্ত্রী প্রমীলার অসুস্থতার পর কবি কিছুদিন কালী সাধনা করেছেন। গেরুয়া পোশাক পরতেন আর মাথায় ছিল একই রঙের টুপি। কবির এই চালচলন, বেশভূষাকে অনেকেই ধরে নেন মানসিক বৈকল্য হিসেবে। সেই সময় থেকেই কবির সুর-তাল ক্ষয়ে যেতে থাকে। গ্রামোফোন কম্পানিতে গান গাওয়ার সময় তা প্রকাশও পেতে থাকে। কবি একটু-আধটু বেসুরো হতে থাকেন। অবশ্য ধরিয়ে দিলে সংশোধন হতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু পুরোপুরি অসুস্থ হওয়ার পর তিনি সব কিছুর বাইরে চলে যান। এই সময় চশমাধারী কোনো মানুষকে দেখলে খেপে যেতেন। উত্তেজিত হতেন। এ কারণে ড. অশোক বাগচীর ধারণা ছিল, কোনো চশমাধারী ব্যক্তি কবির বড় ধরনের ক্ষতি করেছিল; যা তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে যায়। ড. বাগচী বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, ‘স্নায়বিক বৈকল্য’ মতামতাই যথার্থ। ১৯৫৩ সালে ভিয়েনার বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকরা স্নায়বিক বৈকল্য মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। তারা বলেছিলেন, ১৯৩৯ সাল থেকে কবির সঠিক চিকিৎসা হলে তিনি বাকরুদ্ধ থাকতেন না। ঠিকভাবে তার চিকিৎসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ড. বাগচীরও একই মত। ভিয়েনার চিকিৎসকরা আরো বললেন, ১৯৫৩ সালে এসে নজরুল চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরে চলে যান। তখন আর কিছু করার নেই চিকিৎসকদের। হাল ছেড়ে দিলেন তারা।

১৯৫৩ সালে কবি নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড পাঠানো হয়। চিকিৎসা শেষে ফিরে এলেন। আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। বললেন না নতুন করে কাউকে ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য।’ তিনি আর উচ্চারণ করতে পারলেন না ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। বললেন না বিধাতাকে- ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।’ কী এমন মানসিক দুঃখ ছিল, যার কারণে কবি নজরুল ভেঙে হয়েছিলেন খান খান। চিরতরে তাকে পেয়ে বসে নীরবতা, নিস্তব্ধতা। অজানা কষ্ট নিয়ে কবি চিরতরে স্তব্ধ হলেন ১৯৭৬ সালে। চলে গেলেন চিরতরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই কবির ঠাঁই হয়েছে। সেখানে শুয়ে তিনি হয়তো শুনছেন আজানের ধ্বনি। হয়তো খুঁজছেন বুক চিরে ব্যথা জড়ানো সেই প্রিয়াকে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ