আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর ধরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কেন্দ্র ছিল বিশাল বাগরাম বিমান ঘাঁটি। প্রথম মার্কিন সেনাদের পা পড়েছিল এ ঘাঁটিতে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে হাজারো সেনা ঢুকেছে এ ঘাঁটি দিয়েই। লড়াইয়ে মারা যাওয়া মার্কিন সেনাদের প্রস্থানও হত এ ঘাঁটি হয়ে। আজ সেই ঘাঁটি থেকে সেনাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছে দীর্ঘ এক অধ্যায়ের। আর আফগান মিশনের প্রধান এই ঘাঁটি খালি করে সেনাদের চলে যাওয়া আফগানিস্তানে বাজিয়েছে গৃহযুদ্ধের দামামা।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল্র্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর সেবছর ডিসেম্বরেই আফগানিস্তানে যায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। শুরু হয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে মূল্য দিতে হয়েছে। বাগরাম বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের এই চড়া মূল্যের আফগান অভিযানেরই প্রতীক।
নিউ ইয়র্ক সিটির দমকল ও পুলিশ কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে উড়ে গিয়ে এ ঘাঁটিতেই পুঁতেছেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের এক টুকরো ধ্বংসাবশেষ। প্রায় দু’দশক আগের সেই টুকরোকে পেছনে ফেলে শুক্রবার ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেছে মার্কিন ও নেটোর সব সেনাসদস্য।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের আরেকটি ঘাঁটি থেকে যদিও আরও কিছু সেনা এখনও যাই যাই করছে, কিন্তু বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহার অক্ষরিক অর্থেই আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের একটি যুগের অবসান ঘটিয়েছে। তালেবানের সঙ্গে হওয়া শান্তিচু্ক্িতর অংশ হিসেবে বিমান ঘাঁটিটি খালি করে দেওয়া হয়েছে।
১৯৮০’র দশকে সোভিয়েত যুগে মস্কোর বানানো বাগরাম ঘাঁটি রাজধানী কাবুলের ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত; আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী এখান থেকেই তালেবান ও অন্য ইসলামপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর ওপর বেশিরভাগ বিমান হামলা চালাতো। ১০ হাজার পর্যন্ত সেনাও ধারণক্ষম ছিল এ ঘাঁটি। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের কমান্ড স্থাপিত হয়েছিল এ বিমানঘাঁটিতে। এর দুটি রানওয়ে। আছে ১১০ টি বিমান রাখার জায়গা।
কারাগার বা বন্দিশালা হিসেবেও এ ঘাঁটি ব্যবহৃত হয়েছে। যুদ্ধ তুঙ্গে থাকার সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সন্দেহভাজন আল কায়েদা জঙ্গিদের এই ঘাঁটিতেই জেরা করত। এখানে চলত বন্দি নির্যাতনও। সব মিলে কিউবার সেই কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারের মতো বাগরাম ঘাঁটিও পরিচিতি পেয়েছিল আফগানিস্তানের গুয়ানতানামো হিসাবে। বিদেশি সেনা সরে যাওয়ার পর ঘাঁটিটি এখন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করার সময়সীমা নির্ধারিত আছে এবছর ১১ সেপ্টম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার ২০ তম বর্ষপূর্তির দিনে। তার আগে ৪ জুলাইয়েই বেশিরভাগ সেনা প্রত্যাহার হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাগরাম বিমানঘাঁটি খালি হল তারও আগে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে তালেবানের দাপট বাড়তে থাকার মধ্যে রাজধানী কাবুলের কাছের গুরুত্বপূর্ণ এই বিমানঘাঁটি খালি হয়ে যওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।
আফগানিস্তানে আগামী দিনগুলোতে এই ঘাঁটিকে কেন্দ্র করেই ঘোঁট পাকিয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি। তালেবান এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে ঘাঁটিটি। কারণ, বাগরাম একসময় ছিল সোভিয়েত বাহিনীর ঘাঁটি। মার্কিন সামরিক শক্তিরও প্রতীক এটি। আর কেবল প্রতীক হিসাবেই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও ঘাঁটিটির গুরুত্ব কম না। তাই তালেবানের চোখ থাকবে এই ঘাঁটির দিকে। আবার আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এখন ঘাঁটিটি হাতে পাওয়ার পর এর নিরাপত্তা রক্ষায় সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে তৎপর হবে।
বাগরাম ঘাঁটি আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এক মিশ্র আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, এ ঘাঁটির দেয়ালে দেয়ালে আছে সামরিক সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ আবার তালেবানেরও টপ টার্গেট। আর অগণিত আফগান যাদের জীবন ও জীবীকা নির্ভরশীল ছিল এই ঘাঁটির ওপর, তারাও এখন পরিত্যাক্ত বোধ করবে- এত সবকিছুর প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে বাগরামের নতুন অধ্যায় অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ বৈকি!
বিদেশি সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধারা হামলা চালিয়ে একের পর এক জেলা দখল করে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তাতে শঙ্কা প্রকাশ করে এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের আফগান মিশনের শীর্ষ কমান্ডার স্কট মিলার আফগাস্তিানকে নিশ্চিতভাবেই গৃহযুদ্ধের পথে যেতে দেখা যাচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এর আগেই গত সপ্তাহে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। আফগানরা এবার নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরই গড়ুক সেটিই ছিল বৈঠকে বাইডেনের কথা। আর গনি বলেছিলেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিণতি সামাল দেওয়াটাই এখন তার কাজ।
সেনা প্রত্যাহারের বিনিময়ে তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের মাটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের স্বর্গ হয়ে উঠতে না দেওয়া এবং আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু কাতারের দোহায় সেই আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
এ পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এ সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে সাহায্য করা এবং ২০২২ সালে ৩শ’ কোটি ডলারের নিরাপত্তা সহায়তা দিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আফগানিস্তানে সহিংসতার অবসান, সব আফগানের অধিকারকে সম্মান জানানো এবং দোহায় আন্তরিক আলোচনারও আহ্বান জানিয়েছে দূতাবাস।
তাছাড়া, আফগানিস্তানে কাবুল বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস ও কূটনীতিকদের সুরক্ষায় প্রায় ৬৫০ মার্কিন সেনাও রেখে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সঙ্গে কাবুল বিমানবন্দরের সুরক্ষায় থাকছে তুরস্কের সেনারাও। কিন্তু সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাবুলের সুরক্ষা এবং তালেবানকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য বাগরাম ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারাটাই আফগান সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ওদিকে, তালেবানও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে নারাজ। গতবছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির আওতায় তালেবান কোয়ালিশন বাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করলেও আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করেনি। আফগানিস্তানে কোয়ালিশন বাহিনীর আগমনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত গত জুন মাসেই সবচেয়ে বেশি তালেবান সহিংসতা দেখা গেছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রাতভর লড়াইয়ের নতুন নতুন খবর প্রতি সকালেই পাওয়া যাচ্ছে। হেরাত, বাদাখশান, বাঘলান এবং পাকটিকায় তালেবানের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। শুক্রবার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাদাখশান প্রদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে তালেবান এবং সরকারি বাহিনীর মধ্যে লড়াই জোরদার হয়ে উঠছে।
বাগরাম থেকে মার্কিন সেনা বিদায়ে যুগের সমাপ্তি, যুদ্ধের ঝুঁকি আফগানিস্তানে
জনপ্রিয় সংবাদ