অনিন্দ্য আরিফ : ১. ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য এখানকার জনগোষ্ঠী যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল এবং শহিদী আত্মদানের মাধ্যমে নিজের মায়ের ভাষার মর্যাদাকে রক্ষা করেছিল, তার সত্তর বছর এবার অতিক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা আর যমুনার অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে, এই ভাষার সংগ্রামের অগ্নিশিখাকে ধারণ করে ৫০ বছর আগে আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনও করেছি।এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াও হয়েছে।এই বিশ্বায়নের যুগে যেখানে জাতিরাষ্ট্র নয়া উপনৈবেশিক আধিপত্যে অস্তিত্বের তীব্র সংকটে রয়েছে এবং যেখানে সাম্রাজ্যিক ভাষাগত আধিপত্যের তোড়ে অনেক ভাষা বিলোপ সাধনের মুখে, সেখানে জনসংখ্যার বিবেচনায় পৃথিবীর চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলাও রক্ত ঝরানো সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বকীয়তাকে অনেক ক্ষেত্রে অক্ষুণ্ন রাখতে পারছে না।
পাকিস্তানি আমলে উর্দুকে জোর করে চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে সেদিন সাধারণ জনগণ আর মধ্যবিত্তের পাশাপাশি এখানকার উঠতি আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকরা একসঙ্গে বিদ্রোহে সরব হয়েছিল, তার মূল কারণ যে অর্থনৈতিক, সেটা আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পাশার দান উল্টে যখন এদের কাছেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আসলো, তখন নিজেদের পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি আর নিজেদের সন্তানদের পশ্চিমা পুঁজিবাদের সামাজিক নিরাপত্তায় নিশ্চিত জীবনের বাসনায় তারা আজ সেদিনকার মাতৃভাষার পক্ষে অবস্থানকে অনেকটা ক্ষীণ করে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর তারা নিজেদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় নীতিমালা নিজেদের শ্রেণিশাসনকে আড়াল করার অভিপ্রায়ে জনগণের সামনে মুলো ধরানোর জন্য তৈয়ার করলেও আজ নিজেদেরই শ্রেণিস্বার্থ আর নয়া উপনেবশিক গোলামির জিঞ্জিরে সেই বিন্দুতে আজ আর অবস্থান করতে পারছেন না। সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ থাকলেও নীতিনির্ধারক হিসেবে তারা আসীন থাকাতেই আজও সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। যদিও তারা সরকারি অফিস আর আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেছে, কিন্তু সেখানে প্রয়োগের দুর্বলতা অনেকাংশেই পরিলক্ষিত হয়। সেসব নির্দেশনার কয়েকটি ইংরেজিতে জারি হওয়াতেই এর প্রয়োগগত অন্তর্নিহিত দুর্বলতা প্রকাশ হয়। এখনও এখানকার শিক্ষার দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলার উপস্থিতি জোরালো করলেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজিই রাখা হয়েছে। একাডেমিক লেবেলের অল্প কিছু পুস্তকই বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। একসময় বাংলা একাডেমিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো কিছু অনুবাদ করলেও অতিরিক্তি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের ঝড়ে তার পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছে। আমরা বাইরের উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজ ঔপনিবেশিক ভাষাকে একদম প্রাথমিক অবস্থাতেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নের সময় শুধু ইংরেজিকে ধারণ করলে ফল লাভ করা যায়, তা কিন্তু নয়। আর সেজন্য যারা এই সুযোগ নিতে চান, তারা সেখানে উচ্চশিক্ষার সময়ই নির্দিষ্ট ভাষার স্বল্পমেয়াদী কোর্স করে নিতে পারেন। সেখানে শুধু পুরনো ঔপনিবেশিক ভাষাতেই শিক্ষার ধারা দিনের পর দিন বজায় রাখা কোনো শুভবুদ্ধিও কাজ নয়। এখানে এই ঔপনিবেশিক ভাষার বৈশ্বিক গুরুত্বকে অবশ্যই অবহেলা করা যাবে না, কিন্তু রক্ত দিয়ে অর্জিত মাতৃভাষার মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা তো জনবিরোধী চরিত্রেই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে চীন কিংবা জাপানের মতো দেশগুলো নিজেদের মাতৃভাষাকেই ধারণ করে বৈশ্বিক দৃঢ়স্থান নিশ্চিত করছে। কিন্তু নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ আর শ্রেণিচেতনাই এখানকার শাসকশ্রেণির এই মাতৃভাষার প্রয়োগগত দুর্বলতার প্রধান কারণ, তা সহজেই বোঝা যায়।
২. নিজের মাতৃভাষার প্রতি প্রবল প্রেম যেন অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্মানকে বিঘিœত না করে এবং প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষাই যে আমাদের সকলের চিন্তা-ভাবনার বিষয় আর কোনো নৃগোষ্ঠীর ভাষাই আমাদের পর নয়-সেটা কিন্তু ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে বাঙালির মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের স্বীকৃতি রূপে মেনে নেওয়ার প্রধান অঙ্গীকার। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছিলেন—‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অতীতের যেকোনো সময় থেকে এখন আরও বেশি অনুভব করছে যে আধুনিক বিশ্বে ঔপনিবেশিকতার কোনো স্থান নেই।…আমরা জানি যে বিশ্ব এখন বড়ো ধরনের এক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে। অনেক পুরনো কাঠামো ভেঙে পড়েছে। নতুন ব্যবস্থার রূপায়ণ ঘটেছে।’ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা-ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা শুরু করার মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে—ভাষাগত বৈচিৎর্য এবং বহুভাষার শিক্ষা কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো।
ইউনেস্কো যখন এই অঙ্গীকারের কথা বলছে, তখন বিশ্বব্যাপী অসংখ্য নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অবস্থা কী? আমরা দেখতে পাই যে পৃথিবীজুড়ে বণিক পুঁজিবাদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন শুরুতে অতীতের তুলনায় সবচেয়ে বিপন্ন হতে শুরু হলো পৃথিবীর নানা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। এমনিতে ভাষার একধরনের মৃত্যু আছে, যেটা নিয়ে সমাজভাষাবিজ্ঞানীরা তেমন একটা মাথা ঘামান না। সেটা হলো বির্বতনের মাধ্যমে ভাষার মৃত্যু। ভাষা পরিবর্তিত হতে হতে এক সময় এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছাল যখন আর তাকে সেই ভাষা বলে চেনা গেল না, তার মধ্য থেকে অন্য ভাষার জন্ম হয়েছে। এইভাবে ইউরোপে একদিন কথ্য লাতিন ভেঙে ফরাসি, স্প্যানিশ, পোর্তুগিজ, ইতালীয়, রুমানীয়—এই সব ভাষার জন্ম হয়েছিল, ভারতে সংস্কৃত (তার কথিত রূপ) থেকে প্রাকৃত ভাষাগুলির, আবার প্রাকৃত থেকে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির। কিন্তু আমরা যে ভাষার মৃত্যুর কথা বলছি তা হলো ভাষার বংশলোপ। নদীর মরুভূমিতে এসে স্রোতে হারিয়ে ফেলার মতো। প্রাচীনকালে পশ্চিম এশিয়ায় তোখরীয় ভাষার মৃত্যু এইভাবে ঘটেছিল। সমাজভাষাবিজ্ঞানী স্কুৎনাব কাঙ্গাস এই মৃত্যুকে বলেছেন ‘লিঙ্গুইস্টিক জেনোসাইড’ বা ‘লিঙ্গুস্টিইক মার্ডার’। এই মার্ডার তীব্র হয়েছিল দুনিয়া জুড়া ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের মাধ্যমে আর তাদেরই উত্তরাধিকার নয়া ঔপনিবেশিক প্রভুরাও সেই ধারা বজায় রেখেছেন নানা বাহারি মানবাধিকারের বাণীর আড়ালে। এথনোলগ পত্রিকার (এটি মাঝে মাঝে পৃথিবীর ভাষার গোটা হিসেব জানায়) ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে ওই সময়ে ৬৯১২টি ভাষা ছিল। তার মধ্যে ইউরোপের ভাষা ২৩৯টি আর আফ্রিকার মোট ২০৯২টি। যেসব ভাষা লুপ্ত হচ্ছে সেগুলি সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা। পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র ও দুর্বল ভাষাগুলির সংখ্যাই বেশি, মোট ভাষার শতকরা প্রায় ষাট ভাগ। পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ লোক এই প্রায় চার হাজারের মতো ক্ষুদ্র ভাষা বলে। এরা অধিকাংশই প্রযুক্তিহীন অনাগরিক জীবনের অধিবাসী, কেউ অরণ্যচারী এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে খুবই পশ্চাৎপদ। ফলে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী এবং তাদের ভাষার চাপ এদের ভাষা সহ্য করতে পারে না, এদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল।
পৃথিবীর নানা জায়গায় ক্ষুদ্র ভাষার মানুষেরা সব শক্তিশালী ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কখনও ইংরেজি, কখনও স্প্যানিশ, কখনও পোর্তুগিজ। সাইবেরিয়ায় বিশাল অঞ্চলে তাদের নিজেদের ভাষা অবলুপ্ত, রুশ ভাষার আধিপত্য। জার্মানির অস্ট্রিয়া অঞ্চলে হাঙ্গেরীয় ভাষা অবলুপ্ত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে পাপুয়া নিউ গিনিতে কয়েকশো ভাষার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘টোক পিসিন’ নামে এক মিশ্র ভাষা, তা এক বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রথম ভাষা হতে চলেছে। উত্তর আমেরিকায় অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ইউরোপীয়রা পৌঁছাবার সময়ে প্রায় তিনশো আদি আমেরিকান ভাষা বলা হতো। ১৯৬০ নাগাদও প্রায় দুইশো ভাষার অস্তিত্ব ছিল। গত কয়েক দশকে তার সংখ্যা বিপুলভাবে কমে আসছে। অস্ট্রেলিয়াতে দিরবাল, মেক্সিকোতে নাহুয়াতল ভাষা মরণোম্মুখ। ইয়ানসেনের মতো আফ্রিকাতে নিজের ভাষা ছেড়ে সকলে যে স্থানবিশেষে নিজের অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা ইংরেজি গ্রহণ করছে, সে ঘটনা তত প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু তার চেয়ে বড় সমস্যা হল নিজের ক্ষুদ্র ভাষা ছেড়ে অনেক গোষ্ঠী কাছের বৃহৎ ও শক্তিশালী আফ্রিকার ভাষাতেই আশ্রয় নিচ্ছে। তানজানিয়া আর কেনিয়াতে সে ভাষা সোয়াহালি, জিম্বাবুয়েতে শোনা, নাইজেরিয়াতে হাউসা, ইয়োরুবা বা ইগবোর মধ্যে যেকোনো একটি। ভারতে এখন ৭৮০টির মতো ভাষা বলা হয়, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছওে ২২০টি ভাষা অবলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে দ্রাবিড় গোত্রের মালপাহাড়িয়া, ভোট-বর্মি গোত্রের খুমি, ঠার/ঠেট, লালং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ভাষা বিপন্ন পর্যায়ের। ভাষাবিজ্ঞানীরা তো এই ভয়ই করছেন যে, পৃথিবীতে এখন যে ৭০০০টির মতো ভাষা বলা হয় তার অর্ধেকেই এই শতাব্দীতে শেষ হয়ে যাবে।
অর্থাৎ কোনো গোষ্ঠী কেন নিজেদের ভাষা বলা ছেড়ে অন্য ভাষায় চলে যায়? হান্স ইয়ুরগেন সাসে এর পেছনে তিনটি কারণ নির্ধারণ করেছেন। এই তিনটি ক্রমাণ্বয়ী-অর্থাৎ প্রথমটি দ্বিতীয়টির সূত্রপাত ঘটায় এবং দ্বিতীয়টি তৃতীয়টিকে সম্ভব করার ফলে ভাষাবর্জনের ঘটনা ঘটে। প্রথমটি হলো বর্হিব্যবস্থা, দ্বিতীয়টি হলো ভাষাচার এবং তৃতীয়টি হলো ভাষার শরীরে তার প্রভাব। অর্থাৎ ভাষা ক্রমশ বদলাতে বদলাতে কী করে অন্য ভাষা হয়ে যায় তার প্রক্রিয়া। এর মধ্যে প্রথমটি হলো সবচেয়ে শক্তিশালী, কারণ এটাই অন্য দুটি ঘটনার কারণ। বহির্ব্যবস্থা মানে হলো, এমন এক দ্বিভাষিক পরিবেশ, যেখানে যে ভাষাটি লোপ পাবে তার পাশে আরেকটি আরও শক্তিশালী ভাষা সেই ভাষার ভাষীরা বলতে বাধ্য হবে। অন্য কথায় বলা যায়, যে ভাষাটি আমরা নানা কারণে বলতে বা শিখতে বাধ্য হই সেটাই আমাদের চেয়ে শক্তিশালী ভাষা।
যেহেতু দুনিয়াজুড়ে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ এখনও বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাই এই ভাষার বিপন্নতার হুমকি নেই বললেই চলে। এই জন্য ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ইংরেজি যদি ০ ক্রমাঙ্কে থাকে, তাহলে বাংলা আছে ১ ক্রমাঙ্কে। কিন্তু ইংরেজির মতো একটি শক্তিশালী ভাষা ঔপনিবেশিকতা আর বিশ্বায়নের ফলে এ ভাষাকে যে রীতিমতো প্রভাবিত করছে, তার প্রমাণ ব্যাপক বুলিমিশ্রণ ও বুলিলম্ফন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসে থাকা বাঙালি মা অফিস যাওয়ার আগে বন্ধুর হাতে ছেলের দায়িত্ব দিয়ে ছেলেকে বলছেন, ‘তুমি নটি হয়ো না বাপি। তোমার আন্টি তোমাকে ক্যারট দিয়ে রাইস মেখে দেবে, বি আ গুড বয় অ্যান্ড ইট, কেমন?’ এটা যদি প্রবাসে বাংলিশ খিচুড়ি ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে উদ্বিগ্নতাটা কমই থাকত। কিন্তু এখন ঢাকা বা কলকাতায় আমরা অহরহ শুনতে পাই যে—‘ওকে,সি ইয়ু, চলি ভাই, এক্ষুনি আমার বসের সঙ্গে একটা অ্যাপায়েন্টমেন্ট রাখতে ছুটতে হবে, প্লিজ ভাই, ডোন্ট মাইন্ড, আমার ইয়ঙ্গার ব্রাদারের একটা জবের ব্যাপারে বস একটু প্রমিজ করেছেন, তাই আইম ইন এ হারি, টাইম মেনটেইন করতেই হবে, লেট হলে হয়তো চান্সটা মিস হয়ে যাবে।’
এই প্রবণতাটা কিন্তু আজকের নয়। সেই উনবিংশ শতাব্দীতেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শাসনকালেই এই প্রবণতা লক্ষ করেছিলেন সেই সময়কার বাঙালিদের মধ্যে সবচাইতে ইঙরেজি জানা ব্যক্তিত্ব কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার একেই বলে সভ্যতা প্রহসন থেকে প্রাসঙ্গিক একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা যায়—
নব আর কালী দুই বন্ধু বারবণিতা পল্লিতে একটি বাড়িতে অন্য বন্ধুদের বেশ অপেক্ষায় রেখে একটু দেরি করে ঢুকেছে। অন্য বন্ধুরা তখনই কিছুটা রসস্থ, তাদেও ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার অতিক্রম। এদের মধ্যে নবকে ইর্ষা করে এমনও দু-একজন রয়েছে। ঢুকে নব বলছে—নব : দেখ ভাই, আজ আমাদের এক্সকিউজ করতে হবে, আমাদের একটু কর্ম ছিল বলে তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে।
শিবু : (প্রমত্তভাবে) দ্যাটস এ লাই।
নব : (ক্রুব্ধভাবে) হোয়াট, তুমি আমাকে লাইয়র বল? তুমি জান না আমি তোমাকে এখনি শুট করবো?
চৈতন : (নবকে ধরিয়া বসাইয়া) হাঁ, যেতে দেও, যেতে দেও, একটা ট্রাইফ্লিং কথা নিয়ে মিছে ঝগড়া কেন? ………….(দ্বিতীয়াঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক)
বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা কেই সংকীর্ণ বাংলাপ্রেমিক হয়ে থাকতে পারি না সত্যি, কিন্তু আমাদের অনেকের চাওয়াটা হলো পথে ঘাটে যেন আমরা বাংলাভাষাটা বলে চলি। যেন কথায় কথায় এবং অকারণে এ ভাষার গায়ে ইংরেজি শব্দের ছ্যাঁকা না লাগাই। ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাতে আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, কিন্তু সেটা বাংলাকে ভুলে নয়। আমাদের যেন সোশ্যাল মিডিয়ার বরাতে কোথাও দেখতে যেন না হয়—‘হ্যাপি ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’।
৩. বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এখনকার জনতুষ্টিমূলক পুঁজিবাদের ফ্যাসিবাদী রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এটাকে অনেকে নিও ফ্যাসিবাদ বলছেন। যখন গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, তখন রাশিয়ার মার্কসবাদী নেতা এবং তাত্ত্বিক লিও ট্রটস্কি ‘ফ্যাসিজম ইন জার্মানি’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তখন তিনি সেই ফ্যাসিবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বলেছিলেন, তার একটা এখন তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। তখনকার জার্মানি এবং ইতালিতে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদেও একটি অন্যতম অস্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ। আজ সাম্রাজ্যবাদী অলিগপলিতে সে জাতীয়তাবাদের সুযোগ না থাকলেও নয়া ফ্যাসিবাদ কিন্ত সেই সময়ের মতো মধ্যবিত্তকেই প্রধান লক্ষ্য করেছে। আর এই মধ্যবিত্তের কাছে তার ঝুলানো ললিপপ কিন্তু জাতীয়তাবাদের বদলে ভোগবাদের লক্ষ্যে অদম্য বাসনার পেছনে ছোটার। আর সেখানে কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে কর্মফল, ভাগ্যফল, মুসলিম আইডেন্টিটির জেহাদি জোশ, গণেশ মূর্তির হু হ বিক্রির মতোই ভয়ঙ্কর আরেকটি মোহ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা। আর এই প্রবণতা থেকে পুরনো ঔপনিবেশিক ভাষার আধিপত্য আরও তীব্র হওয়ার শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়।
এখনকার বিশ্বায়িত এবং অন্তর্জালের দুনিয়ায় অবশ্যই আমরা ইংরেজিকে একদম এড়িয়ে চলতে পারব না। তবে নিজেদের জাতিগত সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র কিন্তু মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই বলে গিয়েছেন—‘আমাদের এতই কম যে, ইস্কুল-কলেজের বাহিরে আমরা যে-সব লোকশিক্ষার আয়োজন করিয়াছি সেখানেও বাংলার প্রবেশ নিষেধ। বিজ্ঞানশিক্ষা বিস্তারের জন্য দেশের লোকের চাঁদায় বহুকাল হইতে শহরে এক বিজ্ঞানসভা দাঁড়াইয়া আছে। প্রাচ্যদেশের কোনো কোনো রাজার মতো গৌরবনাশের ভয়ে জনসাধারণের কাছে সে বাহির হইতেই চায় না। বরং অচল হইয়া থাকিবে তবু কিছুতে বাংলা বলিবে না। ও যেন বাঙ্গালির চাঁদা দিয়া বাঁধানো পাকা ভিতের ওপর বাঙ্গালির অক্ষমতা ও ঔদাসিন্যের স্মরণস্তম্ভের মতো স্থাণু হইয়া আছে। কথাও বলে না, নড়ে না। উহাকে ভুলিতেও পারি না, উহাকে মনে রাখাও শক্ত। ওজর এই যে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা অসম্ভব। ওটা অক্ষমের ভিরুর জোর। কঠিন বৈ কি, সেই জন্যই কঠোর সংকল্প চাই।’
এজন্য আমরা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় বিস্তৃত জ্ঞানতত্ত্ব বাংলায় অনুবাদেও মহাব্যবস্থাপনায় যেতে পারি। পৃথিবীর প্রথম রেণেসাঁসের সময় আরব বিশ্বেও মুসলিম শাসকদের নির্দেশনায় সেখানকার প-িতরা কিন্তু সেসময়কার গ্রিক এবং রোমান জ্ঞানতত্ত্বের বিশাল জ্ঞানভান্ডারকে আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। হালে কিন্তু চীন এবং জাপানের মতো সমৃদ্ধির দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশগুলোও এখন এই অনুবাদের বড় নজির তৈরি করেছে।
তবে নিজেদের মাতৃভাষাকে গুরত্ব দিতে গিয়ে যদি আমাদের এখানকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং উপভাষাকে বিপন্নতা কিংবা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে যাই, তবে সেটা হবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৯৬১ সালের ১৯ মের চেতনার বিপ্রতীপ। সেক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারতে যেভাবে ১৯৯২ সালে নেপালি ভাষাকে অন্যতম প্রধান ভারতীয় ভাষারূপে অষ্টম তফসিল ভুক্ত করা এবং পশ্চিম বঙ্গে সাঁওতালি ভাষা রক্ষা নিয়ে উদ্যোগুলি আমাদের পথ দেখাতে পারে। সর্বোপরি নিজেদের পুরনো ঔপনিবেশিক কাঠামো এবং নয়া ঔপনিবেশের গোলামির জিজ্ঞির থেকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত হলেই চলবে না, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ক্ষেত্রেও এই রাহুগ্রাস থেকে বন্ধন ছিন্ন করাও নিজেদের আত্মগত সমৃদ্ধির জন্য জরুরি।
বাংলা ভাষা এবং ভাষার মৃত্যু
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ