বিশেষ সংবাদদাতা : কয়েক মাসের বাগযুদ্ধের পর ভারত ও বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য বিধিনিষেধের সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিবিসি লিখেছে, স্থানীয় শিল্পকে রক্ষা করতে গত মাসে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ। ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার কয়েক দিন বাদে ঢাকা এই পদক্ষেপ নেয়। এই সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে রপ্তানি করতে ভারতের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করা যেত। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কারণ হিসেবে বন্দের ‘ভিড়’ বা চাপের কথা বলছে।
প্রবল আন্দোলনের আন্দোলনের মুখে গত অগাস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন দায়িত্বে রয়েছে। পটপরিবর্তনের পর থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা। শেখ হাসিনা নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবির বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বিবিসি লিখেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার খবরে প্রায়ই সমালোচনা করে ভারত। সম্প্রতি দেশটি বলেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নেতাকে হত্যার ঘটনা ‘অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পদ্ধতিগত নিপীড়নের নমুনার প্রতিফলন’। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের নিশানা করার অভিযোগ অস্বীকার করছে এবং বেশিরভাগ ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বা ‘সাধারণ অপরাধ’ বলে বর্ণনা করছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে ১০ শতাংশেরও কম হিন্দু। দেশ দুটির বিবাদের মূল্য গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার অত্যাবশ্যকীয় সুতা সমুদ্র ও আকাশপথেও প্রবেশ করতে পারে- তবে তা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। ২০২৪ সালে ভারত ১৬০ কোটি ডলারের সুতা বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে, যার এক-তৃতীয়াংশই এসেছে স্থলবন্দরের মাধ্যমে। বিবিসি লিখেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা অভিজাত ব্র্যান্ডের জন্য তৈরি পোশাক সড়কপথে ভারতের বিভিন্ন শহরে পাঠাতে পারত। সেখান থেকে সেগুলো উড়োজাহাজে করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হতো।‘জারা’র মতো ব্র্যান্ডের পোশাক সরবরাহকারী এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেছেন, “এটি (বাংলাদেশের ফাস্ট-ফ্যাশন রপ্তানি শিল্পের জন্য) একটি বড় ধাক্কা।“ভারতের রুট দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে পণ্য পৌঁছাত এক সপ্তাহে। সমুদ্রপথে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে।”পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে গত বছর ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য গেছে ভারতের স্থল-আকাশ পথ ব্যবহার করে, যা আহমেদের ভাষায় ‘ভালোই চলছিল’।
বিবিসি লিখেছে, আকাশপথে পণ্য পরিবহনের সীমিত সক্ষমতা এবং বিমানবন্দরের অপ্রতুল সুবিধার কারণে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রতিক চীন সফরে ইউনূসের দেওয়া মন্তব্যের জবাব হিসেবে দিল্লি ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, এই মন্তব্যকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতারা ‘আপত্তিকর’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই অঞ্চলে চীনের তুলনায় ভারতের কৌশলগত দুর্বলতার কথা ইউনূস বলায় উদ্বেগ বেড়েছে দিল্লির। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ২০ কিলোমিটার প্রশস্তের শিলিগুড়ি করিডোরের মাধ্যমে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত, ওই করিডোর ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত। নেপাল ও বাংলাদেশ ঘেরা এই এলাকার অদূরেই রয়েছে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা। বিবিসি লিখেছে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয় এবং সীমান্ত উত্তেজনার ইতিহাস থাকায় ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারকদের আশঙ্কা, দেশটির মূল ভূখ- থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করতে ভবিষ্যতে কোনো সংঘাতে চীন এই করিডোরকে নিশানা করতে পারে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূসের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদারই ছিল ওই বক্তব্যের সারকথা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ১০০ কোটি ডলারের তিস্তা নদী প্রকল্পে বেইজিংয়ের যে আগ্রহ রয়েছে, তাতে ঢাকা স্বাগত জানিয়েছে ইউনূসের চীন সফরের সময়। কৌশলভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের অদূরে ওই প্রকল্পে চীনের সংশ্লিষ্টতা দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করতে পারে বলে ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তবে শীতল সম্পর্ক নিয়ে দুই পক্ষই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবিসি লিখেছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ভারতীয় ভিসার নিয়ম কঠোর করায় বাংলাদেশে অসন্তোষ বাড়ছে। এর আগে প্রতিবছর ২০ লাখ বাংলাদেশি ভ্রমণ, ব্যবসা, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতেন। গত কয়েক মাসে দৈনিক ভিসা ইস্যুর সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি কমেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং প্রত্যর্পণের দাবি একটি বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে রয়েছে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরণ বলেন, “তাদের বোঝা উচিত, এমন কোনো উপায় নেই যাতে হাসিনাকে আমরা তাদের হাতে তুলে দিতে পারি। আমরা জানি- তাকে হস্তান্তর করলে তার কী হবে। আমার মনে হয়, ভারতের জনগণও তাতে সমর্থন করবে না।” ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি স্থলপথে বাংলাদেশি গার্মেন্ট আমদানি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আরও বাণিজ্যিক বিধিনিষেধে উল্টো ফল দেবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেছেন, “আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এখন প্রবল জনমত গড়ে উঠেছে যে- ভারতকে (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য) তৎকালীন হাসিনা সরকার যেসব ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছে, সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করা।” ভারত তার স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের বন্দর, সড়ক ও নৌপথ ব্যবহার করে, যা দূরত্ব, সময় ও ব্যয় সাশ্রয় করে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রানজিটের পরিমাণ আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জোরাল হতে থাকায় উত্তেজনা বাড়ছে দিল্লি-ঢাকার। বিবিসির ভাষ্য, বাংলাদেশ, একসময়ের পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল। শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে পাকিস্তান থেকে নিজেকে দূরে রাখেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বেলুচ গত মাসে ঢাকা সফর করেন, যা গত দেড় দশকের মধ্যে এ ধরনের প্রথম সফর। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের গত মাসের শেষে ঢাকা সফরের কথা ছিল। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রাণক্ষয়ী জঙ্গি হামলা নিয়ে দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে ওই সফর স্থগিত করা হয়েছে। সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক শরণ বিবিসিকে বলেছেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে বলে আমি মনে করি না। তবে এমন যদি কোনো ইঙ্গিত থাকে- ভারতের জন্য সমস্যা সৃষ্টিতে তারা এক হয়ে কাজ করছে, তাহলে সেটা স্বভাবতই উদ্বেগের কারণ হবে।”