বিশেষ সংবাদদাতা :রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে মস্কোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল আগে থেকেই। তবে নতুন করে সেই টানাপোড়েনের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ঢাকায়। বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে যে শীতল লড়াই চলছে, তা এখন অনেকটাই প্রকাশ্য চলে এসেছে। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন, নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ নিয়ে ঢাকাস্থ রাশিয়া দূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়েছে। রাশিয়া দূতাবাসের বিবৃতির জবাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। এদিকে ঢাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে মস্কো।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ঢাকার রাশিয়া দূতাবাস গত ২০ ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দেয়। সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, তৃতীয় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া তার নীতিগত অবস্থানে সব সময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো অনেক রাষ্ট্র বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের জন্য তাদের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়ন এবং একই পন্থা অবলম্বন করে। তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে রাশিয়া।
রাশিয়া দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করে, যারা নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে, তারা ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ রক্ষার অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। এ ধরনের নীতি স্পষ্টতই বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্ব নষ্ট করে এবং বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। এই তালিকায় আছে যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানসগহ আরও অনেক দেশ।
বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই বলে জানিয়ে ঢাকার রাশিয়ার দূতাবাসের দেওয়া বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
রাশিয়ার দূতাবাসের এই বিবৃতি দেওয়ার একদিন পরেই ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের টুইটার পেজ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রাশিয়ার বিবৃতিটি শেয়ার করে প্রশ্ন তোলা হয়- এটা কি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নিয়ে মস্কো থেকেও একটি বিবৃতি প্রচার হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা ২২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে গত ১৪ ডিসেম্বর যে ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাবিত করার জন্য একজন মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য বলেও জানিয়েছে মস্কো। এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে কূটনীতিকদের শিষ্টাচার মেনে চলার আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এটি কোনো কলোনি নয়।
দুই বিশ্ব শক্তির টানাপড়েন
বাংলাদেশের গণতন্ত্রসহ অন্যান্য মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করে আসছে। সম্প্রতি রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর এ ধরনের ভূমিকাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল হিসেবে মন্তব্য করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাবেক কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশে দুই বৈশ্বিক শক্তির পেশি প্রদর্শন দেশের জন্য এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ, একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের মন্তব্য যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, অপরদিকে রাশিয়ার মন্তব্যও একই নীতিতে জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘রাশিয়া যা বলছে, সরাসরি অথবা সরাসরি নয়, সেটিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো। এখানে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিষয়ে কী বলছে, সেটি রাশিয়ার বিষয় নয়। আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সামলাবো।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘রাশিয়ানদের ভাষ্য ‘বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলানো গ্রহণযোগ্য নয়।’ আবার তারাই ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাচ্ছে এবং এটি তো হতে পারে না। রাশিয়া এক হিসেবে আমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যদিও সেটি পুরোপুরি তাদের নিজেদের স্বার্থে নিয়েছে, আমাদের স্বার্থে নয়। এখন সেটি বিরোধিতা করাও সরকারের জন্য কঠিন।’’
রাশিয়া পক্ষ নিয়েছে, কিন্তু যেভাবে নিয়েছে, সেটিও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এটি স্বাগত জানানোর মতো বিষয় নয়। আমি মনে করি না বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও দেশের অস্বস্তিকর সম্পর্ক রয়েছে যে এখানে দুইপক্ষ তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এটি কাম্য নয়।’
যুক্তরাষ্ট্র যা বলেছে, সেটিও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে সেটিও সব দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটি মধ্যপ্রাচ্যে প্রযোজ্য নয়, এটি মিসর বা ইসরায়েলে প্রযোজ্য নয়। এটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু এটি কেন এখানে প্রযোজ্য, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।’
এদিকে দুই বৃহৎ শক্তির পাল্টাপাল্টি মন্তব্যে বাংলাদেশকে কোনও পক্ষ নিতে হবে বলে মনে করেন না সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতের কারণে আমাদের কোনও পক্ষে যোগ দিতে হবে, বিষয়টি সে রকম নয়।’
বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখানো কঠিন বলে মনে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের করণীয় হচ্ছে তাদের বক্তব্য চুপচাপ শুনতে থাকা। এটি বাস্তবতা। আমরা রাশিয়ানদের চুপ থাকতে বলতে পারবো না। আবার যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে পারবো না তোমরা কথা বলা বন্ধ না করলে তোমাদের বের করে দেবো।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমরা কোনও ধরনের সংঘাতে জড়াতে চাই না। একই সঙ্গে বাংলাদেশ কোনও সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠুক, এটিও আমরা চাই না।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে—একটি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে উভয়পক্ষকে সতর্ক করা। কিন্তু এটি করাও বিভিন্ন কারণে দুরূহ। এজন্য কূটনৈতিক নিয়ম অনুসরণ করে, সবার সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করা দরকার।
নতুন করে সৃষ্ট স্নায়ুযুদ্ধের শিকার হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে— বৃহৎ শক্তির সংঘাত বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবদিক বিবেচনা করে ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখা আগের যেকোনও সময়ে থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে দুই বিশ্ব শক্তির টানাপড়েন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ