ঢাকা ১১:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ কীভাবে পারলো কিন্তু চীন পারলো না

  • আপডেট সময় : ১১:০৭:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১০৩ বার পড়া হয়েছে

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ : তিন বছর ‘জিরো কোভিডনীতি’ বাস্তবায়নের পর চীন হলো বিশ্বের সর্বশেষ বড় অর্থনীতির দেশ, যেটি ‘কোভিডের সঙ্গে বসবাস’-এর বাস্তবতা মেনে নিলো।
সীমান্ত বন্ধ, কঠোর লকডাউন, আবাসিক প্রাঙ্গণে আগাম লকডাউন, কেন্দ্রীভূত কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা, নিয়মিত গণহারে পিসিআর পরীক্ষা, রেস্তোরাঁ, অফিস, গণপরিবহন, এমনকি পার্কে প্রবেশে সংক্রমিত না হওয়ার প্রমাণ দেখানো ছিল সংক্রমণ ঠেকাতে নেওয়া বিস্তৃত পদক্ষেপের কয়েকটি মাত্র। এত কিছুর পরও একটি কম ভাইরাল কিন্তু উচ্চ সংক্রমণশীল ওমিক্রন উপধরন ঢুকে পড়ে।
২০২২ সালজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে জমে থাকা হতাশা ও অবসাদ নভেম্বরে বিরল বিক্ষোভের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা নিরূপণ কঠিন, ওমিক্রন জীবনের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মূল্যায়নের মনোভাব থেকে সম্প্রতি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। ৮ জানুয়ারি থেকে দেশটির সীমান্ত বাইরের দেশের মানুষের উন্মুক্ত করার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
বুস্টার ডোজসহ জনগণকে সম্পূর্ণ টিকাদানের জন্য তিন বছর সময় পেয়েছে চীন। এই সময়ে হাসপাতালের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও পশ্চিমা দেশগুলোর মতো অ্যান্টি-ভাইরালের মজুত করতে পারতো দেশটি। দুর্ভাগ্যবশত, ব্যাপক সংক্রমণ বৃদ্ধির সময় যখন দেশটি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন বার্তা সংস্থাগুলো খবর দিচ্ছে হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না, বয়স্কদের মৃত্যু হচ্ছে এবং শ্মশানগুলো পূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন এক প্রাক্কলনে বলেছে, হুট করে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে চীনে ২০২৩ সালে কোভিডে দশ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
চীনা সিডিসি’র প্রধান এপিডেমিওলজিস্ট সতর্ক করে বলেছেন, মার্চ পর্যন্ত চীনে তিনটি সংক্রমণ ঢেউ দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর দাবি, বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে নয়, ইতোমধ্যে দেশটিতে সংক্রমণের হার উচ্চ ছিল। শুরু থেকে চীনের সংক্রমণ ঠেকানোর নীতি ছিল ভুল। অনেক চীনা নাগরিক দেশ ছাড়ছেন। সংক্রমণের তীব্রতার কারণে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, তাইওয়ান ও বাংলাদেশ তাদের দেশে চীনা ভ্রমণকারীদের প্রবেশে পরীক্ষা করতে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও কোথায় চীনের ভুল হয়েছিল? চীনা জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠেনি। নাগরিকদের জন্য নিজেদের উদ্ভাবিত আটটি টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে দেশটি। কিন্তু এসব টিকার কোনোটিই নতুন প্রযুক্তি মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ)-এ দ্বারা তৈরি নয়। অথচ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই প্রযুক্তির টিকা ব্যবহার করে মহামারি থেকে মুক্তি পেয়েছে। চীনা সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম টিকা বিভিন্ন দেশেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এগুলো হলো প্রচলিত নিষ্ক্রিয় টিকা। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় রূপ ব্যবহার করা হয় ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরির জন্য। এমআরএনএ টিকায় (ফাইজার ও মডার্না) জিনগতভাবে পরিবর্তিত আরএনএ ব্যবহার করা হয়। যা দেহের কোষকে ইঙ্গিত দেয় সার্সকভ২ ভাইরাসের মতো স্পাইক প্রোটিন তৈরির জন্য। এই প্রোটিন দেহের কাছে অপরিচিত, ইমিউন ব্যবস্থাকে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি ও ইমিউন কোষ তৈরির দিকে নিয়ে যায়। ফলে প্রকৃত ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে দেহকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে। চীনে তাদের উদ্ভাবিত টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা সহজলভ্য নয়। কিন্তু অপর যেসব দেশে চীনা টিকা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। ব্রাজিলে পরিচালিত একটি গবেষণার ফল ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। দেশটিতে চীনা টিকার ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, চীনা সিনোভ্যাক ৭৯ বছর পর্যন্ত বয়সীদের গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় এবং বয়স ৮০ হলে এর সুরক্ষা প্রদানের হার ৩০ শতাংশ।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, সিনোভ্যাক টিকা নেওয়া ৮০ বছর বয়সী মাত্র ৪৫ শতাংশ এবং ৯০ বছর বয়সীদের ৩৩ শতাংশ সিনোভ্যাক টিকা নেওয়ায় করোনায় আক্রান্ত মৃত্যু থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন। এই গবেষণার পর ব্রাজিল দেশটির ষাটোর্ধ্বদের তৃতীয় ডোজ হিসেবে এমআরএনএ টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেরুতে পরিচালিত আরেকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সংক্রমণের বিরুদ্ধে চীনা টিকা সিনোফার্ম সুরক্ষা দেয় ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। ওমিক্রনের বিরুদ্ধে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম খুব কম সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বাহরাইনে পরিচালিত গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বুস্টার ডোজ হিসেবে এমআরএনএ টিকা শক্তিশালী ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
সিনোভ্যাক টিকা ব্যবহারের পরও পুনরায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণে ২০২১ সালে ভিন্ন টিকা প্রয়োগের পথে হাঁটে চিলি, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। গত বছর পর্যন্ত বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশ সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম টিকা প্রয়োগ করছিল। যা আগের উপধরনগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
বেশিরভাগ দেশ বুস্টার ডোজ হিসেবে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্নার টিকা ব্যবহার করেছে। এফডিএ অনুমোদিত ফাইজার টিকা এখন বিশ্বের ১৫৬টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মডার্না ৮৮টি দেশে। ফাইজারের বুস্টার ডোজ গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে ৭০-৮০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় এবং মডার্নার বুস্টার ডোজ ওমিক্রন উপধরনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে ৮৮-৯৯ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে।
‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’ টিকার ফল কী? যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও স্পেনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ টিকা গ্রহণের ফলে কোভিডের বিরুদ্ধে উচ্চ সুরক্ষা পাওয়া যায়। নিষ্ক্রিয় টিকা (অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম) শরীরে শক্তিশালী টি-কোষের মাধ্যমে ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আর এমআরএনএ টিকা (ফাইজার ও মডার্না) উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
উভয় প্রযুক্তির টিকার মিশ্রণে টি-কোষ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা এবং যাদের ইমিউন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের টি-কোষ প্রতিক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক মানুষদের দুর্বল ইমিউন ব্যবস্থা রয়েছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী টিকা ও বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়। নেচার মেডিসিন-এ প্রকাশিত দুটি মডেল গবেষণায় দেখা গেছে, চীনে প্রাক্কলিত উচ্চ মৃত্যুর হার ঠেকানো যাবে যদি জনগণের ৮৫ শতাংশ চতুর্থ ডোজ হিসেবে ভিন্ন টিকা গ্রহণ করে। বিশেষত, একটি এমআরএনএ টিকা, যা সংক্রমণের হার মন্থর করবে এবং মৃত্যু ও গুরুতর সংক্রমণ কমাবে। এর পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব ও বয়স্ক এবং গুরুতর রোগে আক্রান্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিয়ে মৃত্যু কমানো যেতে পারে ৩৫ শতাংশ। মজার ব্যাপার হলো, ওই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে চীনে ষাটোর্ধ্ব ২৬০ মিলিয়ন মানুষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকার তৃতীয় ডোজ গ্রহণ করেছেন। এরমধ্যে ৬০ বছর বা বেশি বয়সীদের ৭০ শতাংশ এবং ৮০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের মাত্র ৪০ শতাংশ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। ফলে, চীনের বিশাল ৮০ বা তার বেশি বয়সী সংবেদনশীল মানুষের কম কার্যকর টিকার কম সংখ্যক ডোজ গ্রহণে উদ্বেগ রয়েছে। তারা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার বড় ঝুঁকিতে আছে।
আমরা যদি তুলনা করি তাহলে বাংলাদেশ যে চীনের চেয়ে অনেক বেশি জীবন ও জীবিকাকেন্দ্রিক পথে চালিত হয়েছে তা বলা কি নিরাপদ হবে? এক বছরের বেশি সময় আগে ফাইজারের টিকাকে স্বীকৃতি দিলেও চীন স্বনির্ভরতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। তারা এখনও ফাইজারের টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দেয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর কয়েক দশকের গবেষণার ফলে এমআরএনএ টিকা উদ্ভাবিত হয়েছে। আর চীন এখনও এই টিকার নিজেদের সংস্করণ উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে পশ্চিমা টিকার বুস্টার ডোজ গ্রহণ করলে দেশটির জনগণ উপকৃত হবে। কারণ, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সুরক্ষা দেয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে চীনে বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করার পর জার্মান সরকার দেশটিকে পরামর্শ দিয়েছে মহামারি থেকে বের হতে পশ্চিমা এমআরএনএ টিকা প্রয়োগ শুরুর করার জন্য। খুব সম্প্রতি চীন ফাইজারের উৎপাদিত করোনার ওষুধ পাক্সলোভিড জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কঠোর লকডাউনের ফলে মানুষের ক্রস ইমিউনটি ও স্বাভাবিক ইমিউনিট গড়ে ওঠায় বাধা তৈরি করেছে। যা টিকার ওপর নির্ভরশীলতাকে গুরুতর করে তুলেছে। অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ শুরু থেকেই মহামারি নিয়ে সতর্ক ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে টিকা কেনার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ। দেশের পুরো জনগণকে বিনামূল্যে টিকা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ একটি করে বুস্টার ডোজ নিয়েছেন এবং ৮৮ হাজার ৩৪৬ জনকে চতুর্থ ডোজ দেওয়া হয়েছে।
ডব্লিউএইচও পরামর্শ দিয়েছিল যে টিকা পাওয়া যায় তা প্রয়োগ করতে। বাংলাদেশ এই কৌশল অবলম্বন করে। সরকার ভারতের কাছ থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের কাছ থেকে সিনোফার্ম কিনেছিল। এছাড়া ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রচুর টিকা গ্রহণ করেছে কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে। যে উদ্যোগে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান টিকা দান করেছে। টিকা প্রয়োগ কৌশলেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বয়স ও ঝুঁকির বিষয়টি। শুরুতে বয়স্ক ও দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষদের টিকা দেওয়া হয়। পরে দেওয়া হয় মধ্য বয়সীদের। শেষে শিশুদের জন্য নিরাপদ টিকা প্রয়োগ করা হয়। কয়েক দশকের সফল ইপিআই কর্মসূচির অভিজ্ঞতা মসৃণভাবে কোভিড টিকা প্রদানে সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের তারুণ্যনির্ভর একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে। অসংখ্য উপসর্গহীন আক্রান্ত মানুষ ছিলেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড অ্যান্টিবডি থাকা ৬০-৭০ শতাংশ মূলত উপসর্গহীন আক্রান্ত থাকার ফল। ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি পৃথক ধাপের লকডাউন প্রতিবার সংক্রমণ চেইন ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
লকডাউনে থাকার সময় সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের অক্সিজেন সরবরাহের সামর্থ্য বৃদ্ধি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো, পরীক্ষার সক্ষমতার বিস্তৃতি, মাস্ক পরার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা, চিকিৎসার হালনাগাদ বিধিগুলো প্রচার এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের উৎপাদন বাড়িয়েছে। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী মানুষের বাণিজ্য ও জীবিকায় সহযোগিতার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকায় বিস্তৃত করেন। ডিজিটাল কানেক্টিভিটি টিকার নিবন্ধন, অনলাইন শিক্ষা, টেলিমেডিসিন, দৈনন্দিন অফিসের কাজ, মুদিপণ্য কেনাকাটা, মোবাইল ব্যাংকিং এবং বিচার ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করেছে।
অপরদিকে, সাম্প্রতিক সংক্রমণ ঢেউয়ের কারণে ‘করোনার সঙ্গে বসবাস’-এর চীনানীতি ছিল স্বল্পস্থায়ী। গত সপ্তাহে চীন থেকে চার ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত শনাক্তের পর আবারও বাংলাদেশ সতর্কতা অবলম্বন করেছে। যখনই নতুন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের একটি দেশের নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষকে রক্ষা করেছে, এটি প্রশংসার যোগ্য। তাই করোনাভাইরাস মহামারিকে মোকাবিলায় সফলতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বারবার প্রশংসিত হওয়া ন্যায্য। চীনকে নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের জনগণের সুরক্ষায় আরও বেশি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বত্র এই মহামারি অবসানের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।
লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কাল মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা

বাংলাদেশ কীভাবে পারলো কিন্তু চীন পারলো না

আপডেট সময় : ১১:০৭:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ : তিন বছর ‘জিরো কোভিডনীতি’ বাস্তবায়নের পর চীন হলো বিশ্বের সর্বশেষ বড় অর্থনীতির দেশ, যেটি ‘কোভিডের সঙ্গে বসবাস’-এর বাস্তবতা মেনে নিলো।
সীমান্ত বন্ধ, কঠোর লকডাউন, আবাসিক প্রাঙ্গণে আগাম লকডাউন, কেন্দ্রীভূত কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা, নিয়মিত গণহারে পিসিআর পরীক্ষা, রেস্তোরাঁ, অফিস, গণপরিবহন, এমনকি পার্কে প্রবেশে সংক্রমিত না হওয়ার প্রমাণ দেখানো ছিল সংক্রমণ ঠেকাতে নেওয়া বিস্তৃত পদক্ষেপের কয়েকটি মাত্র। এত কিছুর পরও একটি কম ভাইরাল কিন্তু উচ্চ সংক্রমণশীল ওমিক্রন উপধরন ঢুকে পড়ে।
২০২২ সালজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে জমে থাকা হতাশা ও অবসাদ নভেম্বরে বিরল বিক্ষোভের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা নিরূপণ কঠিন, ওমিক্রন জীবনের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মূল্যায়নের মনোভাব থেকে সম্প্রতি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়। ৮ জানুয়ারি থেকে দেশটির সীমান্ত বাইরের দেশের মানুষের উন্মুক্ত করার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
বুস্টার ডোজসহ জনগণকে সম্পূর্ণ টিকাদানের জন্য তিন বছর সময় পেয়েছে চীন। এই সময়ে হাসপাতালের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও পশ্চিমা দেশগুলোর মতো অ্যান্টি-ভাইরালের মজুত করতে পারতো দেশটি। দুর্ভাগ্যবশত, ব্যাপক সংক্রমণ বৃদ্ধির সময় যখন দেশটি বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন বার্তা সংস্থাগুলো খবর দিচ্ছে হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না, বয়স্কদের মৃত্যু হচ্ছে এবং শ্মশানগুলো পূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন এক প্রাক্কলনে বলেছে, হুট করে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে চীনে ২০২৩ সালে কোভিডে দশ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
চীনা সিডিসি’র প্রধান এপিডেমিওলজিস্ট সতর্ক করে বলেছেন, মার্চ পর্যন্ত চীনে তিনটি সংক্রমণ ঢেউ দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর দাবি, বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে নয়, ইতোমধ্যে দেশটিতে সংক্রমণের হার উচ্চ ছিল। শুরু থেকে চীনের সংক্রমণ ঠেকানোর নীতি ছিল ভুল। অনেক চীনা নাগরিক দেশ ছাড়ছেন। সংক্রমণের তীব্রতার কারণে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, তাইওয়ান ও বাংলাদেশ তাদের দেশে চীনা ভ্রমণকারীদের প্রবেশে পরীক্ষা করতে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও কোথায় চীনের ভুল হয়েছিল? চীনা জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠেনি। নাগরিকদের জন্য নিজেদের উদ্ভাবিত আটটি টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে দেশটি। কিন্তু এসব টিকার কোনোটিই নতুন প্রযুক্তি মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ)-এ দ্বারা তৈরি নয়। অথচ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই প্রযুক্তির টিকা ব্যবহার করে মহামারি থেকে মুক্তি পেয়েছে। চীনা সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম টিকা বিভিন্ন দেশেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এগুলো হলো প্রচলিত নিষ্ক্রিয় টিকা। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় রূপ ব্যবহার করা হয় ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরির জন্য। এমআরএনএ টিকায় (ফাইজার ও মডার্না) জিনগতভাবে পরিবর্তিত আরএনএ ব্যবহার করা হয়। যা দেহের কোষকে ইঙ্গিত দেয় সার্সকভ২ ভাইরাসের মতো স্পাইক প্রোটিন তৈরির জন্য। এই প্রোটিন দেহের কাছে অপরিচিত, ইমিউন ব্যবস্থাকে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি ও ইমিউন কোষ তৈরির দিকে নিয়ে যায়। ফলে প্রকৃত ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে দেহকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে। চীনে তাদের উদ্ভাবিত টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা সহজলভ্য নয়। কিন্তু অপর যেসব দেশে চীনা টিকা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। ব্রাজিলে পরিচালিত একটি গবেষণার ফল ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। দেশটিতে চীনা টিকার ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, চীনা সিনোভ্যাক ৭৯ বছর পর্যন্ত বয়সীদের গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় এবং বয়স ৮০ হলে এর সুরক্ষা প্রদানের হার ৩০ শতাংশ।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, সিনোভ্যাক টিকা নেওয়া ৮০ বছর বয়সী মাত্র ৪৫ শতাংশ এবং ৯০ বছর বয়সীদের ৩৩ শতাংশ সিনোভ্যাক টিকা নেওয়ায় করোনায় আক্রান্ত মৃত্যু থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন। এই গবেষণার পর ব্রাজিল দেশটির ষাটোর্ধ্বদের তৃতীয় ডোজ হিসেবে এমআরএনএ টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেরুতে পরিচালিত আরেকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সংক্রমণের বিরুদ্ধে চীনা টিকা সিনোফার্ম সুরক্ষা দেয় ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। ওমিক্রনের বিরুদ্ধে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম খুব কম সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বাহরাইনে পরিচালিত গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বুস্টার ডোজ হিসেবে এমআরএনএ টিকা শক্তিশালী ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
সিনোভ্যাক টিকা ব্যবহারের পরও পুনরায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণে ২০২১ সালে ভিন্ন টিকা প্রয়োগের পথে হাঁটে চিলি, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। গত বছর পর্যন্ত বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশ সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম টিকা প্রয়োগ করছিল। যা আগের উপধরনগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
বেশিরভাগ দেশ বুস্টার ডোজ হিসেবে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্নার টিকা ব্যবহার করেছে। এফডিএ অনুমোদিত ফাইজার টিকা এখন বিশ্বের ১৫৬টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মডার্না ৮৮টি দেশে। ফাইজারের বুস্টার ডোজ গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে ৭০-৮০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় এবং মডার্নার বুস্টার ডোজ ওমিক্রন উপধরনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে ৮৮-৯৯ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে।
‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’ টিকার ফল কী? যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও স্পেনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ টিকা গ্রহণের ফলে কোভিডের বিরুদ্ধে উচ্চ সুরক্ষা পাওয়া যায়। নিষ্ক্রিয় টিকা (অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম) শরীরে শক্তিশালী টি-কোষের মাধ্যমে ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আর এমআরএনএ টিকা (ফাইজার ও মডার্না) উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
উভয় প্রযুক্তির টিকার মিশ্রণে টি-কোষ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা এবং যাদের ইমিউন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের টি-কোষ প্রতিক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক মানুষদের দুর্বল ইমিউন ব্যবস্থা রয়েছে এবং তাদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী টিকা ও বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়। নেচার মেডিসিন-এ প্রকাশিত দুটি মডেল গবেষণায় দেখা গেছে, চীনে প্রাক্কলিত উচ্চ মৃত্যুর হার ঠেকানো যাবে যদি জনগণের ৮৫ শতাংশ চতুর্থ ডোজ হিসেবে ভিন্ন টিকা গ্রহণ করে। বিশেষত, একটি এমআরএনএ টিকা, যা সংক্রমণের হার মন্থর করবে এবং মৃত্যু ও গুরুতর সংক্রমণ কমাবে। এর পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব ও বয়স্ক এবং গুরুতর রোগে আক্রান্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিয়ে মৃত্যু কমানো যেতে পারে ৩৫ শতাংশ। মজার ব্যাপার হলো, ওই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে চীনে ষাটোর্ধ্ব ২৬০ মিলিয়ন মানুষ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকার তৃতীয় ডোজ গ্রহণ করেছেন। এরমধ্যে ৬০ বছর বা বেশি বয়সীদের ৭০ শতাংশ এবং ৮০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের মাত্র ৪০ শতাংশ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। ফলে, চীনের বিশাল ৮০ বা তার বেশি বয়সী সংবেদনশীল মানুষের কম কার্যকর টিকার কম সংখ্যক ডোজ গ্রহণে উদ্বেগ রয়েছে। তারা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার বড় ঝুঁকিতে আছে।
আমরা যদি তুলনা করি তাহলে বাংলাদেশ যে চীনের চেয়ে অনেক বেশি জীবন ও জীবিকাকেন্দ্রিক পথে চালিত হয়েছে তা বলা কি নিরাপদ হবে? এক বছরের বেশি সময় আগে ফাইজারের টিকাকে স্বীকৃতি দিলেও চীন স্বনির্ভরতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। তারা এখনও ফাইজারের টিকা প্রয়োগের অনুমোদন দেয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর কয়েক দশকের গবেষণার ফলে এমআরএনএ টিকা উদ্ভাবিত হয়েছে। আর চীন এখনও এই টিকার নিজেদের সংস্করণ উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে পশ্চিমা টিকার বুস্টার ডোজ গ্রহণ করলে দেশটির জনগণ উপকৃত হবে। কারণ, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সুরক্ষা দেয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে চীনে বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করার পর জার্মান সরকার দেশটিকে পরামর্শ দিয়েছে মহামারি থেকে বের হতে পশ্চিমা এমআরএনএ টিকা প্রয়োগ শুরুর করার জন্য। খুব সম্প্রতি চীন ফাইজারের উৎপাদিত করোনার ওষুধ পাক্সলোভিড জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কঠোর লকডাউনের ফলে মানুষের ক্রস ইমিউনটি ও স্বাভাবিক ইমিউনিট গড়ে ওঠায় বাধা তৈরি করেছে। যা টিকার ওপর নির্ভরশীলতাকে গুরুতর করে তুলেছে। অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ শুরু থেকেই মহামারি নিয়ে সতর্ক ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে টিকা কেনার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ। দেশের পুরো জনগণকে বিনামূল্যে টিকা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ একটি করে বুস্টার ডোজ নিয়েছেন এবং ৮৮ হাজার ৩৪৬ জনকে চতুর্থ ডোজ দেওয়া হয়েছে।
ডব্লিউএইচও পরামর্শ দিয়েছিল যে টিকা পাওয়া যায় তা প্রয়োগ করতে। বাংলাদেশ এই কৌশল অবলম্বন করে। সরকার ভারতের কাছ থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের কাছ থেকে সিনোফার্ম কিনেছিল। এছাড়া ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রচুর টিকা গ্রহণ করেছে কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে। যে উদ্যোগে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান টিকা দান করেছে। টিকা প্রয়োগ কৌশলেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বয়স ও ঝুঁকির বিষয়টি। শুরুতে বয়স্ক ও দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষদের টিকা দেওয়া হয়। পরে দেওয়া হয় মধ্য বয়সীদের। শেষে শিশুদের জন্য নিরাপদ টিকা প্রয়োগ করা হয়। কয়েক দশকের সফল ইপিআই কর্মসূচির অভিজ্ঞতা মসৃণভাবে কোভিড টিকা প্রদানে সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের তারুণ্যনির্ভর একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে। অসংখ্য উপসর্গহীন আক্রান্ত মানুষ ছিলেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড অ্যান্টিবডি থাকা ৬০-৭০ শতাংশ মূলত উপসর্গহীন আক্রান্ত থাকার ফল। ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি পৃথক ধাপের লকডাউন প্রতিবার সংক্রমণ চেইন ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
লকডাউনে থাকার সময় সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের অক্সিজেন সরবরাহের সামর্থ্য বৃদ্ধি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো, পরীক্ষার সক্ষমতার বিস্তৃতি, মাস্ক পরার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা, চিকিৎসার হালনাগাদ বিধিগুলো প্রচার এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের উৎপাদন বাড়িয়েছে। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী মানুষের বাণিজ্য ও জীবিকায় সহযোগিতার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকায় বিস্তৃত করেন। ডিজিটাল কানেক্টিভিটি টিকার নিবন্ধন, অনলাইন শিক্ষা, টেলিমেডিসিন, দৈনন্দিন অফিসের কাজ, মুদিপণ্য কেনাকাটা, মোবাইল ব্যাংকিং এবং বিচার ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করেছে।
অপরদিকে, সাম্প্রতিক সংক্রমণ ঢেউয়ের কারণে ‘করোনার সঙ্গে বসবাস’-এর চীনানীতি ছিল স্বল্পস্থায়ী। গত সপ্তাহে চীন থেকে চার ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত শনাক্তের পর আবারও বাংলাদেশ সতর্কতা অবলম্বন করেছে। যখনই নতুন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের একটি দেশের নেতৃত্ব সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষকে রক্ষা করেছে, এটি প্রশংসার যোগ্য। তাই করোনাভাইরাস মহামারিকে মোকাবিলায় সফলতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বারবার প্রশংসিত হওয়া ন্যায্য। চীনকে নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের জনগণের সুরক্ষায় আরও বেশি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বত্র এই মহামারি অবসানের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।
লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।