ঢাকা ১২:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশ কি করোনা যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের কাছেও হেরে যাচ্ছে?

  • আপডেট সময় : ১১:৩৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অগাস্ট ২০২১
  • ১২৭ বার পড়া হয়েছে

আবদুল মান্নান : যদিও এটিকে কোনও বিশ্বযুদ্ধ বলা যাবে না তথাপি সারা বিশ্ব একটি অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে গত প্রায় দেড় বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং এই লড়াইয়ে এখনও বিজয়ী হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এই যুদ্ধ একটি অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে; যাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছে কোভিড-১৯ আর সাধারণ মানুষ তাকে করোনা হিসেবে জানে। এই রোগে এখন পর্যন্ত প্রায় চুয়াল্লিশ লাখের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে সবার উপরে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারপর আমাদের পাশের দেশ ভারত। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার মানুর এই রোগে মারা গেছেন। আর সেই তুলনায় ভারতে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে চার লাখ মানুষের। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সাথে লাগোয়া ভারতের একটি রাজ্য। একসময় দুই বাংলা একটি প্রদেশ ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের ভুল পদক্ষেপে ১৯৪৭ সালে দুই বাংলা পৃথক হলো কিন্তু দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ের টানকে পৃথক করা যায়নি। এখনও স্বাভাবিক সময় বছরে প্রায় পনেরো লাখ বাংলাদেশের বাঙালি বৈধভাবে ভারতে যায় যার বড় সংখ্যা যায় পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায়। কেউ কলকাতায় গেলে মনে করে না ঢাকার বাইরে গিয়েছে। একই কথা কলকাতার মানুষ যখন ঢাকায় আসে তাদের বেলায়ও সত্য।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটি, জেলা ২৩ টি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর জেলা আছে ৬৪ টি। ভারতের এই রাজ্যে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে নয় হাজারের কিছু বেশি মানুষ বাস করে আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় তেরশত। এখন কলকাতার সাথে ঢাকার তুলনা করা যাক। কলকাতার মেট্রো এলাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৪১ লাখের কিছু বেশি। দিনের বেলায় কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে আনুমানিক ২৫ লাখ মানুষ ট্রেন বা বাসে কলকাতা মহানগরে পেশাগত কাজে প্রবেশ করে। আবার বিকাল চারটা হতে তাদের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়। সেই তুলনায় ঢাকা মহানগর এলাকার জনসংখ্যা দুই কোটি দশ লক্ষের কিছু বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হচ্ছে ঢাকা। এই শহরের সাথে কলকাতার একটি মৌলিক তফাৎ হচ্ছে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ পেশাগত কারণে ঢাকার বাইরে, যেমন গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, কেরানিগঞ্জ, কাঁচপুর প্রভৃতি এলাকায় চলে যায়। ঢাকায় কত মানুষ প্রবেশ করে তার কোনও সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবছর আগে হিসেব করে বলেছে এই সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি হবে না।

ভারত এবং বাংলাদেশে প্রায় কাছাকাছি সময়ে করোনা মহামারি আঘাত হেনেছে। প্রথম দিকে ভারতে মৃত্যু বা সংক্রমণের সংখ্যা তেমন একটা বেশি ছিল না। মানুষও তাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। ঠিক এই সময় গত এপ্রিল মাসে উত্তরপ্রদেশে হয়ে গেলো কুম্ভ মেলা যেখানে প্রায় বস্ত্রবিহীন শরীর নিয়ে কোটি খানেক সাধু (কম বেশিও হতে পারে) গঙ্গা স্নানে গেলো কোনোরকমের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া। এই সাধুরা আবার প্রায় কেউই করোনা বলে কোনও রোগ আছে তা বিশ্বাস করে না। ঠিক একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের পাঁচটি রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো রাজ্যবিধান সভার নির্বাচন। নির্বাচনি জনসভাগুলোতে ছিল না কোনও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বালাই। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। সপ্তাহ দু’একের মধ্যে সারা ভারতে করোনা ছড়িয়ে পড়লো অতিমারি রূপে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে শ্মশানে শব দেহ পোড়ানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না পেয়ে অনেকে বাড়ির আঙ্গিনায় বা ছাদে তা পোড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কবরস্থানে একটি কবরের ওপর একাধিক লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করা হলো। পরে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছালো যে মানুষ লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া শুরু করলো। অনেক স্থানে দেখা গেলো কুকুর মরদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের রাজধানী দিল্লির হাসপাতালে কোনও সিট খালি না পেয়ে দেখা গেলো এক সিটে তিনজন রোগী। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।

ভারতের এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র বিজেপি সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ক্ষমতায় ঠিকে গেলো মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার। শপথ গ্রহণ করার পর মমতা নজর দিলেন করোনা সমস্যা মোকাবিলায়। আগে হতে বন্ধ ছিল কলকাতায় আসার সকল লোকাল ট্রেন। বেঁধে দেওয়া হলো সকল দোকানপাট খোলার সময় সীমা। গণপরিবহনে মাস্ক ছাড়া ওঠা একেবারেই বারণ। এই সব ব্যবস্থা শুধু হুকুম দিয়ে বা প্রজ্ঞাপন জারি করে মমতা শেষ করেননি। তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলেছেন জনগণকে নিরাপদ রাখার জন্য যত রকমের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা যেন বাস্তবায়ন কারা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে। তিনি জনগণকে সচেতন করার সকল ধরনের ব্যবস্থা নিলেন।

সেদিন আমার কলকাতার বন্ধু অমলেন্দুর কাছে জানতে চাইলাম কী যাদুমন্ত্র বলে পশ্চিমবঙ্গে করোনাজনিত কারণে মৃত্যু এক বা দুই অংকের ঘরে নেমে এসেছে? সে জানালো এটির সিংহভাগ কৃতিত্ব স্বয়ং মূখ্যমন্ত্রীর আর জনগণকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সচেতন করে তুলতে পারা। সে নিজের একটা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললো একদিন সে মাস্ক নিতে ভুলে গিয়েছিল। উঠেছিল বাসে। সঙ্গে সঙ্গে বাসের যাত্রীরা তাকে বাস হতে নেমে যেতে বাধ্য করে। রাস্তায় কোনও মানুষকে মাস্ক ছাড়া চলতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে না। সে আরও একটা মজার কথা বললো। বললো পশ্চিমবঙ্গে তো কোনও তৈরি পোশাক কারখানা নেই। এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হতে বিরত থাকি। জানালো কলকাতার মেট্রোরেলও অনেক দিন বন্ধ ছিল। পরে যখন খুলে দেওয়া হলো তখন কাউকে মেট্রো স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হলো না মাস্ক ছাড়া। কঠোরভাবে মানা হলো সামাজিক দূরত্ব। এসব ব্যবস্থা নিয়ে কোনও মহল থেকে কোনও প্রতিবাদ নেই। কেউ বলেনি জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটু সংবেদনশীল হতে হবে। কেন্দ্রের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্পর্ক ভালো না থাকাতে মমতার দাবি অনুযায়ী তারা পর্যাপ্ত টিকা পাচ্ছিল না। সেখানেও টিকা নিয়ে রাজনীতি।

মমতা অনেকটা তীব্র প্রতিবাদ আর ঝগড়াঝাটি করে টিকার ব্যবস্থা করলেন। প্রথম দিকে শুধু সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে এই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করলো পরে তা কিছু নির্বাচিত বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিডোজ আটশত রূপি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। করোনার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে এই সব ব্যবস্থার ফলাফল গিয়ে দাঁড়ালো এই মঙ্গলবার এই রাজ্যে করোনায় মৃত্যু হয়েছে এগার জনের আর মোট আক্রান্ত কমেছে পনের ভাগ। কয়েক সপ্তাহ আগে এই সংখ্যা পাঁচে নেমে এসেছিল। মোট সংক্রমণের নিরিখে মঙ্গলবার মৃত্যুর হার মাত্র ১.১৯ শতাংশ। আঠারোটা জেলায় কোনও মৃত্যু নেই।

এই যখন ঢাকার পাশের শহর কলকাতার জীবনযাত্রার হাল তখন বাংলাদেশে দুই ঈদের প্রতিটিতে দেড় কোটির মতো মানুষ শুধু ঢাকা ছাড়লো। কিসের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি। ওগুলো কিতাবে আছে। গ্রামের মানুষ বলে কিসের করোনা? ওটাতো শহরের রোগ। এখন ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সিংহভাগ রোগী গ্রামের। কোরবানির পশুর মতো যখন মানুষ ফেরি দিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছিল তখন তাদের অনেকেই সাংবাদিকদের জানালো তারা পরিবার নিয়ে বাবা মায়ের সাথে ঈদ করতে যাচ্ছে। যেন একবার বা দু’বার এই ঝুঁকি নিয়ে ঈদ না করলে ঈদ হবে না। এর ফল হলো দেশে গিয়ে বয়স্ক বাবা মাকে অনেকেই করোনা রোগের ভাইরাস ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসলো। তারা বুঝলো না বয়স্কদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কত কম।

এগারো তারিখ হতে বাংলাদেশে সব কিছু পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে বলে আশংকা করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না মানুষের মাঝে টিকা নেওয়ার হার বেড়েছে। তবে সব দেশের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন টিকা কাউকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে না। প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে হলে মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হোক প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সকল নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার। দেশের মানুষ যে ভাষায় বুঝেন সেই ভাষায় কথা বলতে হবে। সম্পৃক্ত করতে হবে জনপ্রতিনিধিদের। এনজিওগুলো অনেক ক্ষেত্রে বসে বসে তামাশা দেখছে। তাদের মাঠে নামাতে হবে। বয় ও রোভার স্কাউটদের কাজে লাগাতে হবে। প্রচার করতে হবে যখন কোনও হাসপাতালে কোনও সিট খালি নেই তখন করোনা আক্রান্ত হলে কী হতে পারে। রোগীর মৃত্যুর হতে পারে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ এই দেশে ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি দেখতে চায় না। দেশটাতে গড়ে প্রতিদিন দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই পর্যন্ত এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানুষের করোনায় মৃত্যু হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? বাংলাদেশের এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়ের ভয়াবহ অভাব। যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের এটি চিন্তা করার দেশে বাস্তবমুখী ও বাস্তবায়নযোগ্য এখন চিন্তা সম্ভবত একজনই করতে পারেন আর তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশ কি করোনা যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের কাছেও হেরে যাচ্ছে?

আপডেট সময় : ১১:৩৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অগাস্ট ২০২১

আবদুল মান্নান : যদিও এটিকে কোনও বিশ্বযুদ্ধ বলা যাবে না তথাপি সারা বিশ্ব একটি অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে গত প্রায় দেড় বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং এই লড়াইয়ে এখনও বিজয়ী হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এই যুদ্ধ একটি অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে; যাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছে কোভিড-১৯ আর সাধারণ মানুষ তাকে করোনা হিসেবে জানে। এই রোগে এখন পর্যন্ত প্রায় চুয়াল্লিশ লাখের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে সবার উপরে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারপর আমাদের পাশের দেশ ভারত। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার মানুর এই রোগে মারা গেছেন। আর সেই তুলনায় ভারতে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে চার লাখ মানুষের। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সাথে লাগোয়া ভারতের একটি রাজ্য। একসময় দুই বাংলা একটি প্রদেশ ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের ভুল পদক্ষেপে ১৯৪৭ সালে দুই বাংলা পৃথক হলো কিন্তু দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ের টানকে পৃথক করা যায়নি। এখনও স্বাভাবিক সময় বছরে প্রায় পনেরো লাখ বাংলাদেশের বাঙালি বৈধভাবে ভারতে যায় যার বড় সংখ্যা যায় পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায়। কেউ কলকাতায় গেলে মনে করে না ঢাকার বাইরে গিয়েছে। একই কথা কলকাতার মানুষ যখন ঢাকায় আসে তাদের বেলায়ও সত্য।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটি, জেলা ২৩ টি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর জেলা আছে ৬৪ টি। ভারতের এই রাজ্যে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে নয় হাজারের কিছু বেশি মানুষ বাস করে আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় তেরশত। এখন কলকাতার সাথে ঢাকার তুলনা করা যাক। কলকাতার মেট্রো এলাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৪১ লাখের কিছু বেশি। দিনের বেলায় কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে আনুমানিক ২৫ লাখ মানুষ ট্রেন বা বাসে কলকাতা মহানগরে পেশাগত কাজে প্রবেশ করে। আবার বিকাল চারটা হতে তাদের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়। সেই তুলনায় ঢাকা মহানগর এলাকার জনসংখ্যা দুই কোটি দশ লক্ষের কিছু বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হচ্ছে ঢাকা। এই শহরের সাথে কলকাতার একটি মৌলিক তফাৎ হচ্ছে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ পেশাগত কারণে ঢাকার বাইরে, যেমন গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, কেরানিগঞ্জ, কাঁচপুর প্রভৃতি এলাকায় চলে যায়। ঢাকায় কত মানুষ প্রবেশ করে তার কোনও সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবছর আগে হিসেব করে বলেছে এই সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি হবে না।

ভারত এবং বাংলাদেশে প্রায় কাছাকাছি সময়ে করোনা মহামারি আঘাত হেনেছে। প্রথম দিকে ভারতে মৃত্যু বা সংক্রমণের সংখ্যা তেমন একটা বেশি ছিল না। মানুষও তাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। ঠিক এই সময় গত এপ্রিল মাসে উত্তরপ্রদেশে হয়ে গেলো কুম্ভ মেলা যেখানে প্রায় বস্ত্রবিহীন শরীর নিয়ে কোটি খানেক সাধু (কম বেশিও হতে পারে) গঙ্গা স্নানে গেলো কোনোরকমের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া। এই সাধুরা আবার প্রায় কেউই করোনা বলে কোনও রোগ আছে তা বিশ্বাস করে না। ঠিক একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের পাঁচটি রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো রাজ্যবিধান সভার নির্বাচন। নির্বাচনি জনসভাগুলোতে ছিল না কোনও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বালাই। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। সপ্তাহ দু’একের মধ্যে সারা ভারতে করোনা ছড়িয়ে পড়লো অতিমারি রূপে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে শ্মশানে শব দেহ পোড়ানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না পেয়ে অনেকে বাড়ির আঙ্গিনায় বা ছাদে তা পোড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কবরস্থানে একটি কবরের ওপর একাধিক লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করা হলো। পরে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছালো যে মানুষ লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া শুরু করলো। অনেক স্থানে দেখা গেলো কুকুর মরদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের রাজধানী দিল্লির হাসপাতালে কোনও সিট খালি না পেয়ে দেখা গেলো এক সিটে তিনজন রোগী। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।

ভারতের এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র বিজেপি সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ক্ষমতায় ঠিকে গেলো মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার। শপথ গ্রহণ করার পর মমতা নজর দিলেন করোনা সমস্যা মোকাবিলায়। আগে হতে বন্ধ ছিল কলকাতায় আসার সকল লোকাল ট্রেন। বেঁধে দেওয়া হলো সকল দোকানপাট খোলার সময় সীমা। গণপরিবহনে মাস্ক ছাড়া ওঠা একেবারেই বারণ। এই সব ব্যবস্থা শুধু হুকুম দিয়ে বা প্রজ্ঞাপন জারি করে মমতা শেষ করেননি। তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলেছেন জনগণকে নিরাপদ রাখার জন্য যত রকমের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা যেন বাস্তবায়ন কারা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে। তিনি জনগণকে সচেতন করার সকল ধরনের ব্যবস্থা নিলেন।

সেদিন আমার কলকাতার বন্ধু অমলেন্দুর কাছে জানতে চাইলাম কী যাদুমন্ত্র বলে পশ্চিমবঙ্গে করোনাজনিত কারণে মৃত্যু এক বা দুই অংকের ঘরে নেমে এসেছে? সে জানালো এটির সিংহভাগ কৃতিত্ব স্বয়ং মূখ্যমন্ত্রীর আর জনগণকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সচেতন করে তুলতে পারা। সে নিজের একটা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললো একদিন সে মাস্ক নিতে ভুলে গিয়েছিল। উঠেছিল বাসে। সঙ্গে সঙ্গে বাসের যাত্রীরা তাকে বাস হতে নেমে যেতে বাধ্য করে। রাস্তায় কোনও মানুষকে মাস্ক ছাড়া চলতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে না। সে আরও একটা মজার কথা বললো। বললো পশ্চিমবঙ্গে তো কোনও তৈরি পোশাক কারখানা নেই। এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হতে বিরত থাকি। জানালো কলকাতার মেট্রোরেলও অনেক দিন বন্ধ ছিল। পরে যখন খুলে দেওয়া হলো তখন কাউকে মেট্রো স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হলো না মাস্ক ছাড়া। কঠোরভাবে মানা হলো সামাজিক দূরত্ব। এসব ব্যবস্থা নিয়ে কোনও মহল থেকে কোনও প্রতিবাদ নেই। কেউ বলেনি জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটু সংবেদনশীল হতে হবে। কেন্দ্রের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্পর্ক ভালো না থাকাতে মমতার দাবি অনুযায়ী তারা পর্যাপ্ত টিকা পাচ্ছিল না। সেখানেও টিকা নিয়ে রাজনীতি।

মমতা অনেকটা তীব্র প্রতিবাদ আর ঝগড়াঝাটি করে টিকার ব্যবস্থা করলেন। প্রথম দিকে শুধু সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে এই টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করলো পরে তা কিছু নির্বাচিত বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিডোজ আটশত রূপি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। করোনার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে এই সব ব্যবস্থার ফলাফল গিয়ে দাঁড়ালো এই মঙ্গলবার এই রাজ্যে করোনায় মৃত্যু হয়েছে এগার জনের আর মোট আক্রান্ত কমেছে পনের ভাগ। কয়েক সপ্তাহ আগে এই সংখ্যা পাঁচে নেমে এসেছিল। মোট সংক্রমণের নিরিখে মঙ্গলবার মৃত্যুর হার মাত্র ১.১৯ শতাংশ। আঠারোটা জেলায় কোনও মৃত্যু নেই।

এই যখন ঢাকার পাশের শহর কলকাতার জীবনযাত্রার হাল তখন বাংলাদেশে দুই ঈদের প্রতিটিতে দেড় কোটির মতো মানুষ শুধু ঢাকা ছাড়লো। কিসের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি। ওগুলো কিতাবে আছে। গ্রামের মানুষ বলে কিসের করোনা? ওটাতো শহরের রোগ। এখন ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সিংহভাগ রোগী গ্রামের। কোরবানির পশুর মতো যখন মানুষ ফেরি দিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছিল তখন তাদের অনেকেই সাংবাদিকদের জানালো তারা পরিবার নিয়ে বাবা মায়ের সাথে ঈদ করতে যাচ্ছে। যেন একবার বা দু’বার এই ঝুঁকি নিয়ে ঈদ না করলে ঈদ হবে না। এর ফল হলো দেশে গিয়ে বয়স্ক বাবা মাকে অনেকেই করোনা রোগের ভাইরাস ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসলো। তারা বুঝলো না বয়স্কদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কত কম।

এগারো তারিখ হতে বাংলাদেশে সব কিছু পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে বলে আশংকা করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না মানুষের মাঝে টিকা নেওয়ার হার বেড়েছে। তবে সব দেশের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন টিকা কাউকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবে না। প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে হলে মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হোক প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সকল নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার। দেশের মানুষ যে ভাষায় বুঝেন সেই ভাষায় কথা বলতে হবে। সম্পৃক্ত করতে হবে জনপ্রতিনিধিদের। এনজিওগুলো অনেক ক্ষেত্রে বসে বসে তামাশা দেখছে। তাদের মাঠে নামাতে হবে। বয় ও রোভার স্কাউটদের কাজে লাগাতে হবে। প্রচার করতে হবে যখন কোনও হাসপাতালে কোনও সিট খালি নেই তখন করোনা আক্রান্ত হলে কী হতে পারে। রোগীর মৃত্যুর হতে পারে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ এই দেশে ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি দেখতে চায় না। দেশটাতে গড়ে প্রতিদিন দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই পর্যন্ত এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানুষের করোনায় মৃত্যু হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? বাংলাদেশের এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়ের ভয়াবহ অভাব। যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের এটি চিন্তা করার দেশে বাস্তবমুখী ও বাস্তবায়নযোগ্য এখন চিন্তা সম্ভবত একজনই করতে পারেন আর তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক