ঢাকা ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে ওমিক্রন ঝুঁকি কতটুকু?

  • আপডেট সময় : ০৯:০৬:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২১
  • ১০২ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রথমে আফ্রিকা, এরপর ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে এবার বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতেও শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। গত ৮ নভেম্বর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্টটি এরই মধ্যে ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সচেতন না হলে বাংলাদেশেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি।
মারাত্মক পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। গত ১ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিক্যাবল ডিজেসেস (এনআইসিডি) জানায়, দেশটিতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮ হাজার ৫৬১ জন সংক্রমিত হয়েছে। দেশটিতে এখন সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
দক্ষিণ আফ্রিকান সংস্থাটি জানিয়েছে, গত মাসে জিনগতভাবে বিশ্লেষণ করা নমুনার ৭৪ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এক সপ্তাহ আগে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। যে নমুনায় প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যায় তা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশ থেকে ৮ নভেম্বর সংগ্রহ করা। গত মঙ্গলবারের তুলনায় দেশটিতে বুধবার আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা এক প্রাথমিক গবেষণায় দেখেছেন, ডেলটা ও বেটা ধরনের তুলনায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় সংক্রমিত করার ক্ষমতা তিনগুণ বেশি। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, আগে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে অনলাইনে, তবে এর রিভিউ এখনও সম্পন্ন হয়নি।
বাংলাদেশে ওমিক্রন সতর্কতায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ওমিক্রন নিয়ে বৈঠকের পর এ বিষয়ে ১৫ নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর অধিদফতর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওমিক্রন শনাক্ত দেশ থেকে প্রবাসীদের এই মুহূর্তে দেশে না ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কিন্তু এতসব পদক্ষেপ ক্ষেত্রেও দেশের সবচেয়ে কাছের দেশে যখন অতিসংক্রমণশীল ওমিক্রন শনাক্ত হয়, তখন সেটা রীতিমতো শঙ্কার বিষয়। কেননা, এর আগে ভারত থেকে আসা ডেল্টার কারণেই গত মধ্য জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত এর ভয়ংকর বিধ্বংসী রূপ দেখতে হয়েছে দেশকে। এই সময়ের মধ্যেই করোনা মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়, শনাক্তের হার ওঠে ৩২ শতাংশে।
দেশে গত ২৪ মে থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী সাত এলাকায় বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। তার আগেই বেপরোয়া ঈদযাত্রায় করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে সতর্ক করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করেছে ঈদের পরপরই সংক্রমণের নতুন মাত্রা। দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩০টি। এরমধ্যে গত মে মাসে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে সাত জেলায়। এই জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরপর সেখান থেকে পুরো দেশেই ছড়িয়ে পরে ডেল্টা।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেল্টা ঠেকানো যায়নি, এবার ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সেটা আজ কিংবা কাল অবশ্যই বাংলাদেশে আসবে। আর এজন্য সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। এবারে যেন ডেল্টার মতো পদক্ষেপে গাফিলতি যেন না হয় এবং দেশের ভেতরে যেন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হয় সেই বিষয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে।
ডেল্টার মতো ওমিক্রন বাংলাদেশের কতটা কাছে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের এখন ‘রিস্ক বেসইড অ্যাপ্রোচ’ অর্থাৎ ঝুঁকি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন যেসব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এর প্রতিবেশী দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে সেসব দেশ, যাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি বর্ডার নেই, সেসব দেশ থেকে কেউ এলে তাদের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। কিন্তু যেসব দেশে একজন দুই জন করে শনাক্ত হয়েছে সেসব দেশ থেকে এলে হয় হোম কোয়ারেন্টিন অথবা তিন থেকে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এরপর তাদের করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ হলে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টিন কি বাংলাদেশের মতো দেশে সম্ভব কিনা প্রশ্নে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মনিটরিং না করলে হোম কোয়ারেন্টিন আসলে কোনও দেশেই কার্যকর হয় না। তবে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নাই, এমন দেশ থেকে এলে তাদের কোনও একটা বিধিনিষেধের মধ্যে রাখা উচিত। এখন দেখা যাক সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
ভারতে শনাক্ত হবার ফলে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারত এখন সেই ক্যাটাগরিতে পড়বে যেখানে ‘স্পোরাডিক ট্রান্সমিন অব ওমিক্রন’ (বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমিত হওয়া)। একটা ক্রাইটেরিয়া ছাড়া তো কোনও স্পেশাল ব্যবস্থা নিতে পারি না, স্পেশাল রিলাক্সও করতে পারি না, স্পেশাল কড়াকড়িও নিতে পারি না। তবে এ বিষয়ে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক মোটিভেশন দরকার রয়েছে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেহেতু কর্ণাটকে ধরা পড়েছে রোগী, তাই ওখান থেকে কেউ এলে তাদের অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে। সেই সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেল্টাকে ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। ভারতে শনাক্ত হওয়া মানে আমরা ওমিক্রনের খুব কাছাকাছি। ভারতে যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়, তখন একে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ঠেকানো যায়নি। ‘যদিও তখন পদক্ষেপ গ্রহণে শিথিলতা ছিল কিংবা যেভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা হয়নি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সঙ্গে বৈধ উপায়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভারতে অবৈধ কিংবা ছোট ছোট অনেক পথ রয়েছে, যেখান দিয়ে দুই দেশের মানুষের যাতায়াত রয়েছে। আবার বর্ডার সিল করার মধ্যেও তখন অনেক ঘাটতি ছিল। সেটা যদি এবার নাও হয়, তাহলে হয়তো কিছুটা ডিলে হবে, কিন্তু ওমিক্রন ঠেকানো যাবে না, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। ‘সেই সঙ্গে পাসপোর্ট ছাড়া মানুষের যাওয়া ঠেকানো যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে ওমিক্রন আসবেই। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত, ভারতে আসা মানেই বাংলাদেশে আসা, এটা এখন কেবল ম্যাটার অব উইক’, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
আফ্রিকার ৭ দেশ থেকে ফিরলে নিজ খরচে কোয়ারেন্টিন : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে আফ্রিকার ৭ দেশের যাত্রীদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিনের কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বৃহস্পতিবার এক সার্কুলারে জানিয়েছে, ওই সাত দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের নিজ খরচে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বাংলাদেশ সময় আজ শনিবার দুপুর ১২টা থেকে এ নিয়ম কার্যকর হবে বলে বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের ওই সার্কুলারে জানানো হয়েছে। আফ্রিকার এই সাত দেশ হল: বতসোয়ানা, লেসোথো, ইসোয়াতিনি, ঘানা, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে। এসব দেশ থেকে সরাসরি বাংলাদেশে এলে, অথবা গত ১৪ দিনের মধ্যে এসব দেশের কোনোটিতে ভ্রমণ করে থাকলে বাংলাদেশে আসার পর ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ওই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কোয়ারেন্টিনের ওই দুই সপ্তাহ সরকার নির্ধারিত কিছু হোটেলে নিজ খরচে থাকতে হবে তাদের। সেজন্য বাংলাদেশের পথে রওনা হওয়ার আগেই হোটেল বুকিং দিতে হবে। সেই সঙ্গে যাত্রা শুরুর আগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্তের আরটিপিসিআর পরীক্ষা করিয়ে ‘কোভিডমুক্ত’ সনদ নিয়ে আসতে হবে। তবে ১২ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা থাকবে না। বাংলাদেশে আসার পর হোটেলে থাকা অবস্থায় সপ্তম ও চতুর্দশ দিনে করোনাভাইরাস শনাক্তের আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে। সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হবে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থাপিত বিদেশগামীদের করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষাগার পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কোয়ারেন্টিন থেকে কেউ পালালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত বছর দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে বিদেশ থেকে ফিরলে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তখন কোয়ারেন্টিন থেকে পালানোর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। মহামারীর মধ্যে দেড় বছর পর করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ ঠেকাতে আবার আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ফিরলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে, তাদের পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হবে। কোনো হোটেল থেকে পালিয়ে গেলে ওই হোটেলকেও জরিমানা করা হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশে ওমিক্রন ঝুঁকি কতটুকু?

আপডেট সময় : ০৯:০৬:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রথমে আফ্রিকা, এরপর ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে এবার বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতেও শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। গত ৮ নভেম্বর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্টটি এরই মধ্যে ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সচেতন না হলে বাংলাদেশেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি।
মারাত্মক পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। গত ১ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিক্যাবল ডিজেসেস (এনআইসিডি) জানায়, দেশটিতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮ হাজার ৫৬১ জন সংক্রমিত হয়েছে। দেশটিতে এখন সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন।
দক্ষিণ আফ্রিকান সংস্থাটি জানিয়েছে, গত মাসে জিনগতভাবে বিশ্লেষণ করা নমুনার ৭৪ শতাংশই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এক সপ্তাহ আগে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। যে নমুনায় প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যায় তা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল গৌতেং প্রদেশ থেকে ৮ নভেম্বর সংগ্রহ করা। গত মঙ্গলবারের তুলনায় দেশটিতে বুধবার আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা এক প্রাথমিক গবেষণায় দেখেছেন, ডেলটা ও বেটা ধরনের তুলনায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় সংক্রমিত করার ক্ষমতা তিনগুণ বেশি। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, আগে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে অনলাইনে, তবে এর রিভিউ এখনও সম্পন্ন হয়নি।
বাংলাদেশে ওমিক্রন সতর্কতায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ওমিক্রন নিয়ে বৈঠকের পর এ বিষয়ে ১৫ নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর অধিদফতর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওমিক্রন শনাক্ত দেশ থেকে প্রবাসীদের এই মুহূর্তে দেশে না ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কিন্তু এতসব পদক্ষেপ ক্ষেত্রেও দেশের সবচেয়ে কাছের দেশে যখন অতিসংক্রমণশীল ওমিক্রন শনাক্ত হয়, তখন সেটা রীতিমতো শঙ্কার বিষয়। কেননা, এর আগে ভারত থেকে আসা ডেল্টার কারণেই গত মধ্য জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত এর ভয়ংকর বিধ্বংসী রূপ দেখতে হয়েছে দেশকে। এই সময়ের মধ্যেই করোনা মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়, শনাক্তের হার ওঠে ৩২ শতাংশে।
দেশে গত ২৪ মে থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী সাত এলাকায় বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। তার আগেই বেপরোয়া ঈদযাত্রায় করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে সতর্ক করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করেছে ঈদের পরপরই সংক্রমণের নতুন মাত্রা। দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩০টি। এরমধ্যে গত মে মাসে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে সাত জেলায়। এই জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরপর সেখান থেকে পুরো দেশেই ছড়িয়ে পরে ডেল্টা।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেল্টা ঠেকানো যায়নি, এবার ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। সেটা আজ কিংবা কাল অবশ্যই বাংলাদেশে আসবে। আর এজন্য সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। এবারে যেন ডেল্টার মতো পদক্ষেপে গাফিলতি যেন না হয় এবং দেশের ভেতরে যেন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হয় সেই বিষয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে।
ডেল্টার মতো ওমিক্রন বাংলাদেশের কতটা কাছে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের এখন ‘রিস্ক বেসইড অ্যাপ্রোচ’ অর্থাৎ ঝুঁকি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন যেসব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এর প্রতিবেশী দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে সেসব দেশ, যাদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি বর্ডার নেই, সেসব দেশ থেকে কেউ এলে তাদের বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। কিন্তু যেসব দেশে একজন দুই জন করে শনাক্ত হয়েছে সেসব দেশ থেকে এলে হয় হোম কোয়ারেন্টিন অথবা তিন থেকে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এরপর তাদের করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ হলে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু হোম কোয়ারেন্টিন কি বাংলাদেশের মতো দেশে সম্ভব কিনা প্রশ্নে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মনিটরিং না করলে হোম কোয়ারেন্টিন আসলে কোনও দেশেই কার্যকর হয় না। তবে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নাই, এমন দেশ থেকে এলে তাদের কোনও একটা বিধিনিষেধের মধ্যে রাখা উচিত। এখন দেখা যাক সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
ভারতে শনাক্ত হবার ফলে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারত এখন সেই ক্যাটাগরিতে পড়বে যেখানে ‘স্পোরাডিক ট্রান্সমিন অব ওমিক্রন’ (বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমিত হওয়া)। একটা ক্রাইটেরিয়া ছাড়া তো কোনও স্পেশাল ব্যবস্থা নিতে পারি না, স্পেশাল রিলাক্সও করতে পারি না, স্পেশাল কড়াকড়িও নিতে পারি না। তবে এ বিষয়ে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক মোটিভেশন দরকার রয়েছে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেহেতু কর্ণাটকে ধরা পড়েছে রোগী, তাই ওখান থেকে কেউ এলে তাদের অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে। সেই সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেল্টাকে ঠেকানো যায়নি, ওমিক্রনও ঠেকানো যাবে না। ভারতে শনাক্ত হওয়া মানে আমরা ওমিক্রনের খুব কাছাকাছি। ভারতে যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়, তখন একে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ঠেকানো যায়নি। ‘যদিও তখন পদক্ষেপ গ্রহণে শিথিলতা ছিল কিংবা যেভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা হয়নি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সঙ্গে বৈধ উপায়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভারতে অবৈধ কিংবা ছোট ছোট অনেক পথ রয়েছে, যেখান দিয়ে দুই দেশের মানুষের যাতায়াত রয়েছে। আবার বর্ডার সিল করার মধ্যেও তখন অনেক ঘাটতি ছিল। সেটা যদি এবার নাও হয়, তাহলে হয়তো কিছুটা ডিলে হবে, কিন্তু ওমিক্রন ঠেকানো যাবে না, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। ‘সেই সঙ্গে পাসপোর্ট ছাড়া মানুষের যাওয়া ঠেকানো যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে ওমিক্রন আসবেই। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত, ভারতে আসা মানেই বাংলাদেশে আসা, এটা এখন কেবল ম্যাটার অব উইক’, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
আফ্রিকার ৭ দেশ থেকে ফিরলে নিজ খরচে কোয়ারেন্টিন : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে আফ্রিকার ৭ দেশের যাত্রীদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিনের কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বৃহস্পতিবার এক সার্কুলারে জানিয়েছে, ওই সাত দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের নিজ খরচে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বাংলাদেশ সময় আজ শনিবার দুপুর ১২টা থেকে এ নিয়ম কার্যকর হবে বলে বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের ওই সার্কুলারে জানানো হয়েছে। আফ্রিকার এই সাত দেশ হল: বতসোয়ানা, লেসোথো, ইসোয়াতিনি, ঘানা, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে। এসব দেশ থেকে সরাসরি বাংলাদেশে এলে, অথবা গত ১৪ দিনের মধ্যে এসব দেশের কোনোটিতে ভ্রমণ করে থাকলে বাংলাদেশে আসার পর ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ওই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কোয়ারেন্টিনের ওই দুই সপ্তাহ সরকার নির্ধারিত কিছু হোটেলে নিজ খরচে থাকতে হবে তাদের। সেজন্য বাংলাদেশের পথে রওনা হওয়ার আগেই হোটেল বুকিং দিতে হবে। সেই সঙ্গে যাত্রা শুরুর আগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্তের আরটিপিসিআর পরীক্ষা করিয়ে ‘কোভিডমুক্ত’ সনদ নিয়ে আসতে হবে। তবে ১২ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা থাকবে না। বাংলাদেশে আসার পর হোটেলে থাকা অবস্থায় সপ্তম ও চতুর্দশ দিনে করোনাভাইরাস শনাক্তের আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে। সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হবে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থাপিত বিদেশগামীদের করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষাগার পরিদর্শনে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কোয়ারেন্টিন থেকে কেউ পালালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত বছর দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে বিদেশ থেকে ফিরলে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তখন কোয়ারেন্টিন থেকে পালানোর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। মহামারীর মধ্যে দেড় বছর পর করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ ঠেকাতে আবার আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ফিরলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে, তাদের পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হবে। কোনো হোটেল থেকে পালিয়ে গেলে ওই হোটেলকেও জরিমানা করা হবে।