ঢাকা ১২:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বিতর্ক: রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে

  • আপডেট সময় : ০৩:৫১:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৭ বার পড়া হয়েছে

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বলতে কাদের বোঝায় এখন পর্যন্ত সে বিতর্ক অমীমাংসিত রয়ে গেছে। কিংবা সেটা অমীমাংসিত রাখা হয়েছে। কিন্তু এ বিতর্ক জিইয়ে রেখে এবং এটাকে অমীমাংসিত রেখে আখেরে কার লাভ? কী লাভ? সেটি কি আমরা কখনো গভীর মনোযোগের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছি? একটা হুজুগ আমাদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটাকে নানান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রঙ দিয়ে আমরা অন্যকে নিপীড়ন ও দমনের ডিসকোর্সে পরিণত করি। ফলে, সমাজে একটা অশান্তি বিরাজ করে। এবং এ অশান্তির রাজনীতি এস্তেমাল করে কিছু মানুষ শান্তি পায়। এটাই শান্তি-অশান্তির চতুর গ্যাঁড়াকল যেখান আমরা বুঝে কিংবা না-বুঝে নিজের মন, মাথা ও মগজ ঢুকিয়ে বসে থাকি। তারপর অন্যরা ‘যেমনে নাচায়, আমরা তেমনে নাচি’। বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক এখন এরকম একটি চতুর গ্যাঁড়াকলে ফেলে মানুষকে ‘যেমনে ইচ্ছে তেমনে নাচাচ্ছে’।

মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে দুটিÑ এক. আদিবাসীর সংজ্ঞা কী? দুই. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আদিবাসী বলতে যা বোঝায়, সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না? আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের জাতীয় পরিচয় ও অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে এবং সেটা অদ্যাবধি জারি আছে। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্ষদে ও বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনার পরে আদিবাসীদের ব্যাপারে পৃথিবীর সব দেশের জন্য প্রযোজ্য সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি বিধায় ‘সেলফ ডেফিনিশন’ বা আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব-সংজ্ঞায়নের হাতে আদিবাসী সংজ্ঞায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে একটা মতৈক্য হয়েছে যে, সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের আগে যারা বসবাস করতো (এটা ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত; যা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং এখনো করে। তাদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু, যাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে; যা জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং যাদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আছে এবং যারা রাষ্ট্রের কাঠামোয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক তারাই আদিবাসী হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

এসব বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশে বসবাসকারী সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা, ওরাং, মণিপুরি, হাজং, পাত্র, জৈন্তা, খাসিয়া, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, খুমি, লুসাই, পাংখোয়া প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে। এখানে রাষ্ট্র একটি ভুল তাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী আছে কী নাই’ তা নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বসে আছে।
রাষ্ট্র যে জায়গাটায় ভুল করেছে সেটি হচ্ছে, ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’র মধ্যকার তফাত না-বুঝতে পারা। ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’ যে এক নয় এটা রাষ্ট্রবাদী চিন্তার কাঠামোই আমরা বহু চেষ্টা করেও ঢুকাতে পারিনি। এখানে মনে রাখা জরুরি যে ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অর্থ ‘আদিবাসী’ যেটা একটি সাংস্কৃতিক ক্যাটাগরি আর ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’ অর্থ হচ্ছে ‘আদি বাসিন্দা’ যেটা একটি জনতাত্ত্বিক ক্যাটেগরি। তাছাড়া বাঙালিরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং তারা বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এ দেশের আধিপত্যশীল শ্রেণি। ফলে তারাই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, যেখানে সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু জনগণ, আদিবাসীরা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে। নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে যদি বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
যুক্তির খাতিরে কিংবা শুধু তর্কের জন্য যদি ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’কেও প্যারামিটার হিসাবে ধরে নিই, তাতেও এ অঞ্চলে আদি বাসিন্দা এসব আদিবাসীই। এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে আর্য ও অনার্য দুটি ভাগে ভাগ করে ইতিহাসবিদরা মানুষের বসতি স্থাপনের ইতিহাস আলোচনা করেন। অনার্য পর্বে এ অঞ্চলে প্রথমে আসে নিগ্রিটো, তারপর আসে অস্ট্রিক, এরপর দ্রাবিড় এবং পরে আসে মঙ্গোলীয়রা। পরবর্তীতে আর্য পর্বে আসে ককোশয়েডরা। প্রথম মানববসতি স্থাপন করা জনগোষ্ঠী নিগ্রিটোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সাঁওতাল, মুন্ডা এবং ভিলস প্রভৃতি জনগোষ্ঠী। আর বাঙালির উত্তরাধিকার এসেছে অস্ট্রিক ও দ্রাবিডিয়ানদের জেনিটিক্যাল লাইনআপ থেকে। তাই প্রথম মানব-বসতির ইতিহাস বিবেচনায়ও এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা মোটাদাগে এসব আদিবাসীরাই। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে মানব বসতির ইতিহাস বোঝার জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আদমশুমারি অনুযায়ী কেবল দেড়শ’ বছর আগে ১৮৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর পাহাড়ির সংখ্যা ছিল ৯৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা কারা? সুতরাং ‘আদি বাসিন্দা’র বিচারেও এ অঞ্চলের ‘আদিবাসী’ এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী পূর্ব প্রজন্মের মানুষরাই। তবে কোনো অঞ্চলের ‘আদি বাসিন্দা’ কে, তা নিয়ে আদিবাসীর সংজ্ঞায়ন হয় না। যারা বুঝে কিংবা না বুঝে তর্ক করেন, তাদের জন্য কেবল তর্কের খাতিরে এ যুক্তি দিলাম। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সাংবিধানিক পরিভাষায় ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই’; এমনকি সাংবিধানিক কাঠামোতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতিসত্তার মানুষকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকারই করে না। কেননা বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। অর্থাৎ বাঙালিরাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালি ছাড়া ভিন্ন কোনো জাতির মানুষ (সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো প্রভৃতি) বাংলাদেশের নাগরিক নন।
সংবিধানের আটিক্যাল ২৩-এ গিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে জাতি হিসাবে নয় বরং ভিন্ন নামে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাঙালি ছাড়া ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব মানুষ বাংলাদেশে বাস করে তারা রাষ্ট্রের ভাষায় ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, এবং সম্প্রদায়’ (বাংলাদেশ সংবিধান ২৩/ক) হিসাবে পরিচিত। তাই আজ যখন গোটা দুনিয়া বহু ভাষাভাষী মানুষের এবং বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আদিবাসী মানুষদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে একটি মডার্ন-লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ও ইনক্লুসিভ সমাজের চর্চা করছে, তখন বাংলাদেশে তারা তাদের সাংবিধানিক এবং আইনি অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিজেদের আত্মপরিচয়ের এ সংকট আজকে নতুন নয়। একাত্তরে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই তারা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ৬(২) ধারায় বাংলাদেশকে যেমন ‘বাঙালির দেশ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তেমনি ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘এদেশের নাগরিক বাঙালি বলিয়া গণ্য হইবে’ বলে সকল ‘অবাঙালি’ জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে; যার অর্থ দাঁড়ায় বিগত পাঁচ দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য কিন্তু ‘আদিবাসীদের’ স্বীকৃতি এবং অধিকার বিষয়ের রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই আজকে যে আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পিটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে বাঙালিগিরি দেখাচ্ছি, এটা হচ্ছে মোটা দাগে বিগত পাঁচ দশক ধরে আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক ও কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফল।
আদিবাসী সংক্রান্ত আলোচনায় এবং বিদ্যমান আদিবাসী বিষয়ক বিতর্কটি মোটাদাগে কিছু পপুলার ভুল বোঝাবুঝির ওপর দাঁড়িয়ে আছে; যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট এখানে আলোকপাত করছি।
এক. বাংলাদেশে আদিবাসীর প্রশ্ন উঠলেই বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা এবং অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষই কেবল আদিবাসী। কিন্তু সেটা একেবারেই ভুল। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৮টি জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওয়াং, কোড়া, কাদর প্রভৃতি জাতিসত্তা, টাঙ্গাইল-মধুপুর-ভাওয়াল অঞ্চলের গারো জাতি কিংবা সিলেট-মৌলভীবাজার-সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জের মণিপুরী, খাসিয়া, জৈন্তা, পাত্র প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের দাবি রাখে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি-ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ ছাড়াও সমতলের আদিবাসীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে ‘আদিবাসী মানেই চাকমা নয়’!
দুই. আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বললে রাষ্ট্রের কী কী অসুবিধা, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা কোনো সময়েই দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে যখন আদিবাসীদের অধিকার সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তখন চারটি দেশ (আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড) এর বিরোধিতা করেছিল তাদের কুৎসিত কলোনিয়াল অতীতের কারণে এবং ১১টি দেশ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। বাংলাদেশ সে ১১টি দেশের মধ্যে একটি। কিন্তু তখন যুক্তি ছিল, আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল একটি অনির্বাচিত সরকার (ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার)। এরপর রাজনৈতিক সরকার এলো সত্যি কিন্তু আদিবাসী অধিকার সনদ স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু কেন করেনি, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এখনো দেওয়া হয়নি।
তিন. অনেকে মনে করেন, আদিবাসী কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নাম। বিষয়টি একেবারেই তা নয়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, খুমি, ম্রো, খেয়াং, লুসাই, পাংখোয় প্রভৃতি জাতিসত্তা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নামেই পরিচিত এবং প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নিয়েই বাঁচতে চায়। কিন্তু আদিবাসী হচ্ছে একটি কালেক্টিভ আইডেন্টিটি বা আমব্রেলা কনসেপ্ট, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি-ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তা একটি নিজস্ব বৃহত্তর পরিচয়ের মেলবন্ধনে পরিচিত হতে চায়। এই যে নিজেরা একটা সামষ্টিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ে একীভূত হয়ে একটা কালেক্টিভিটির দর্শনে মিলিত হতে চায়, এটা কি তাদের অপরাধ? অন্যায়? আমরা কি কখনো বিষয়টিকে একটি সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের আলোয় দেখার চেষ্টা করেছি? নাকি অন্ধ স্বাজাত্যাবোধে ৫৩ বছর ডুবে থেকেছি? এর উত্তর জানা জরুরি।
চার. ‘আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং এদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাবে’- এরকম একটি ডিসকোর্স বাজারে জারি আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে আসিবাসীরা অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। আর্টিক্যাল ৬(খ) দিয়ে আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ও আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলো। কিন্তু তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে দেওয়া হলো না। তাহলে, বিচ্ছিন্নতাবাদ কারা অনুসরণ করেছে? প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, অন্তর্ভুক্তিবাদী। রাষ্ট্রই একরৈখিক জাতি-নির্মাণ (ন্যাশন-বিল্ডিং) ও মেজরিটারিয়ান দর্শনে রাষ্ট্র-গঠনের (স্টেট ফরমেশন) প্রক্রিয়ায় ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
পাঁচ. পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য কিছু মানুষ আন্দোলন করলো। আন্দোলন করার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। একইভাবে আদিবাসী শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আদিবাসীরাও আন্দোলন করলো। আদিবাসী শব্দটি বাদ দেওয়ার দাবিতে যদি আন্দোলন করা যায়, তাহলে সেটা অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন করা যাবে না কেন? এ জন্য তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে হবে কেন? আবার এ রক্তাক্ত করার প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের জলকামান দিয়ে, টিয়ার গ্যাস দিয়ে, সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে দমন করতে হবে কেন? রাষ্ট্র আসলে কার পাহারাদার?
ছয়. এখানে যে জিনিসটা মনে রাখা জরুরি সেটা হচ্ছে, আদিবাসী-বাঙালি দ্বৈরথ তৈরি করে আখেরে কারা লাভবান হচ্ছে? আমার ধারণা যারা আদিবাসীদের আদিবাসী বলা যাবে না বলে তাদের মাথা ফাটাচ্ছে, তাদের অনেকেই জানেন না আদিবাসীদের আদিবাসী বললে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বাঙালিদের কী ক্ষতি।
পরিশেষে বলবো, আমাদের মনে রাখতে হবে প্রত্যেক মানুষের তার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। বাঙালিদের যেমন আছে, তেমনি আদিবাসীদেরও আছে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আর্থিক খাতের ‘ডাকাতি’ খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান :ড. ইউনূস

বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বিতর্ক: রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে

আপডেট সময় : ০৩:৫১:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বলতে কাদের বোঝায় এখন পর্যন্ত সে বিতর্ক অমীমাংসিত রয়ে গেছে। কিংবা সেটা অমীমাংসিত রাখা হয়েছে। কিন্তু এ বিতর্ক জিইয়ে রেখে এবং এটাকে অমীমাংসিত রেখে আখেরে কার লাভ? কী লাভ? সেটি কি আমরা কখনো গভীর মনোযোগের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছি? একটা হুজুগ আমাদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটাকে নানান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রঙ দিয়ে আমরা অন্যকে নিপীড়ন ও দমনের ডিসকোর্সে পরিণত করি। ফলে, সমাজে একটা অশান্তি বিরাজ করে। এবং এ অশান্তির রাজনীতি এস্তেমাল করে কিছু মানুষ শান্তি পায়। এটাই শান্তি-অশান্তির চতুর গ্যাঁড়াকল যেখান আমরা বুঝে কিংবা না-বুঝে নিজের মন, মাথা ও মগজ ঢুকিয়ে বসে থাকি। তারপর অন্যরা ‘যেমনে নাচায়, আমরা তেমনে নাচি’। বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক এখন এরকম একটি চতুর গ্যাঁড়াকলে ফেলে মানুষকে ‘যেমনে ইচ্ছে তেমনে নাচাচ্ছে’।

মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে দুটিÑ এক. আদিবাসীর সংজ্ঞা কী? দুই. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আদিবাসী বলতে যা বোঝায়, সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না? আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের জাতীয় পরিচয় ও অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে এবং সেটা অদ্যাবধি জারি আছে। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্ষদে ও বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনার পরে আদিবাসীদের ব্যাপারে পৃথিবীর সব দেশের জন্য প্রযোজ্য সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি বিধায় ‘সেলফ ডেফিনিশন’ বা আদিবাসী জাতিসমূহের স্ব-সংজ্ঞায়নের হাতে আদিবাসী সংজ্ঞায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে একটা মতৈক্য হয়েছে যে, সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের আগে যারা বসবাস করতো (এটা ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত; যা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং এখনো করে। তাদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু, যাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে; যা জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং যাদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আছে এবং যারা রাষ্ট্রের কাঠামোয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক তারাই আদিবাসী হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

এসব বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটা সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশে বসবাসকারী সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা, ওরাং, মণিপুরি, হাজং, পাত্র, জৈন্তা, খাসিয়া, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, খুমি, লুসাই, পাংখোয়া প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে। এখানে রাষ্ট্র একটি ভুল তাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী আছে কী নাই’ তা নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বসে আছে।
রাষ্ট্র যে জায়গাটায় ভুল করেছে সেটি হচ্ছে, ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’র মধ্যকার তফাত না-বুঝতে পারা। ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’ যে এক নয় এটা রাষ্ট্রবাদী চিন্তার কাঠামোই আমরা বহু চেষ্টা করেও ঢুকাতে পারিনি। এখানে মনে রাখা জরুরি যে ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের অর্থ ‘আদিবাসী’ যেটা একটি সাংস্কৃতিক ক্যাটাগরি আর ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’ অর্থ হচ্ছে ‘আদি বাসিন্দা’ যেটা একটি জনতাত্ত্বিক ক্যাটেগরি। তাছাড়া বাঙালিরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং তারা বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এ দেশের আধিপত্যশীল শ্রেণি। ফলে তারাই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, যেখানে সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু জনগণ, আদিবাসীরা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে। নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে যদি বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
যুক্তির খাতিরে কিংবা শুধু তর্কের জন্য যদি ‘আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস’কেও প্যারামিটার হিসাবে ধরে নিই, তাতেও এ অঞ্চলে আদি বাসিন্দা এসব আদিবাসীই। এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে আর্য ও অনার্য দুটি ভাগে ভাগ করে ইতিহাসবিদরা মানুষের বসতি স্থাপনের ইতিহাস আলোচনা করেন। অনার্য পর্বে এ অঞ্চলে প্রথমে আসে নিগ্রিটো, তারপর আসে অস্ট্রিক, এরপর দ্রাবিড় এবং পরে আসে মঙ্গোলীয়রা। পরবর্তীতে আর্য পর্বে আসে ককোশয়েডরা। প্রথম মানববসতি স্থাপন করা জনগোষ্ঠী নিগ্রিটোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সাঁওতাল, মুন্ডা এবং ভিলস প্রভৃতি জনগোষ্ঠী। আর বাঙালির উত্তরাধিকার এসেছে অস্ট্রিক ও দ্রাবিডিয়ানদের জেনিটিক্যাল লাইনআপ থেকে। তাই প্রথম মানব-বসতির ইতিহাস বিবেচনায়ও এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা মোটাদাগে এসব আদিবাসীরাই। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামে মানব বসতির ইতিহাস বোঝার জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আদমশুমারি অনুযায়ী কেবল দেড়শ’ বছর আগে ১৮৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর পাহাড়ির সংখ্যা ছিল ৯৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা কারা? সুতরাং ‘আদি বাসিন্দা’র বিচারেও এ অঞ্চলের ‘আদিবাসী’ এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী পূর্ব প্রজন্মের মানুষরাই। তবে কোনো অঞ্চলের ‘আদি বাসিন্দা’ কে, তা নিয়ে আদিবাসীর সংজ্ঞায়ন হয় না। যারা বুঝে কিংবা না বুঝে তর্ক করেন, তাদের জন্য কেবল তর্কের খাতিরে এ যুক্তি দিলাম। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সাংবিধানিক পরিভাষায় ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই’; এমনকি সাংবিধানিক কাঠামোতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতিসত্তার মানুষকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকারই করে না। কেননা বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। অর্থাৎ বাঙালিরাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালি ছাড়া ভিন্ন কোনো জাতির মানুষ (সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো প্রভৃতি) বাংলাদেশের নাগরিক নন।
সংবিধানের আটিক্যাল ২৩-এ গিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে জাতি হিসাবে নয় বরং ভিন্ন নামে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাঙালি ছাড়া ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব মানুষ বাংলাদেশে বাস করে তারা রাষ্ট্রের ভাষায় ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, এবং সম্প্রদায়’ (বাংলাদেশ সংবিধান ২৩/ক) হিসাবে পরিচিত। তাই আজ যখন গোটা দুনিয়া বহু ভাষাভাষী মানুষের এবং বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আদিবাসী মানুষদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে একটি মডার্ন-লিবারেল ডেমোক্র্যাসি ও ইনক্লুসিভ সমাজের চর্চা করছে, তখন বাংলাদেশে তারা তাদের সাংবিধানিক এবং আইনি অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিজেদের আত্মপরিচয়ের এ সংকট আজকে নতুন নয়। একাত্তরে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই তারা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ৬(২) ধারায় বাংলাদেশকে যেমন ‘বাঙালির দেশ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তেমনি ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘এদেশের নাগরিক বাঙালি বলিয়া গণ্য হইবে’ বলে সকল ‘অবাঙালি’ জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে; যার অর্থ দাঁড়ায় বিগত পাঁচ দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য কিন্তু ‘আদিবাসীদের’ স্বীকৃতি এবং অধিকার বিষয়ের রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই আজকে যে আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পিটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে বাঙালিগিরি দেখাচ্ছি, এটা হচ্ছে মোটা দাগে বিগত পাঁচ দশক ধরে আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক ও কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফল।
আদিবাসী সংক্রান্ত আলোচনায় এবং বিদ্যমান আদিবাসী বিষয়ক বিতর্কটি মোটাদাগে কিছু পপুলার ভুল বোঝাবুঝির ওপর দাঁড়িয়ে আছে; যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট এখানে আলোকপাত করছি।
এক. বাংলাদেশে আদিবাসীর প্রশ্ন উঠলেই বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা এবং অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষই কেবল আদিবাসী। কিন্তু সেটা একেবারেই ভুল। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৮টি জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওয়াং, কোড়া, কাদর প্রভৃতি জাতিসত্তা, টাঙ্গাইল-মধুপুর-ভাওয়াল অঞ্চলের গারো জাতি কিংবা সিলেট-মৌলভীবাজার-সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জের মণিপুরী, খাসিয়া, জৈন্তা, পাত্র প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের দাবি রাখে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি-ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ ছাড়াও সমতলের আদিবাসীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে ‘আদিবাসী মানেই চাকমা নয়’!
দুই. আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বললে রাষ্ট্রের কী কী অসুবিধা, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা কোনো সময়েই দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে যখন আদিবাসীদের অধিকার সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তখন চারটি দেশ (আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড) এর বিরোধিতা করেছিল তাদের কুৎসিত কলোনিয়াল অতীতের কারণে এবং ১১টি দেশ স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। বাংলাদেশ সে ১১টি দেশের মধ্যে একটি। কিন্তু তখন যুক্তি ছিল, আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল একটি অনির্বাচিত সরকার (ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার)। এরপর রাজনৈতিক সরকার এলো সত্যি কিন্তু আদিবাসী অধিকার সনদ স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু কেন করেনি, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এখনো দেওয়া হয়নি।
তিন. অনেকে মনে করেন, আদিবাসী কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নাম। বিষয়টি একেবারেই তা নয়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, খুমি, ম্রো, খেয়াং, লুসাই, পাংখোয় প্রভৃতি জাতিসত্তা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নামেই পরিচিত এবং প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নিয়েই বাঁচতে চায়। কিন্তু আদিবাসী হচ্ছে একটি কালেক্টিভ আইডেন্টিটি বা আমব্রেলা কনসেপ্ট, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি-ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তা একটি নিজস্ব বৃহত্তর পরিচয়ের মেলবন্ধনে পরিচিত হতে চায়। এই যে নিজেরা একটা সামষ্টিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ে একীভূত হয়ে একটা কালেক্টিভিটির দর্শনে মিলিত হতে চায়, এটা কি তাদের অপরাধ? অন্যায়? আমরা কি কখনো বিষয়টিকে একটি সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের আলোয় দেখার চেষ্টা করেছি? নাকি অন্ধ স্বাজাত্যাবোধে ৫৩ বছর ডুবে থেকেছি? এর উত্তর জানা জরুরি।
চার. ‘আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং এদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাবে’- এরকম একটি ডিসকোর্স বাজারে জারি আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে আসিবাসীরা অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। আর্টিক্যাল ৬(খ) দিয়ে আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ও আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলো। কিন্তু তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে দেওয়া হলো না। তাহলে, বিচ্ছিন্নতাবাদ কারা অনুসরণ করেছে? প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, অন্তর্ভুক্তিবাদী। রাষ্ট্রই একরৈখিক জাতি-নির্মাণ (ন্যাশন-বিল্ডিং) ও মেজরিটারিয়ান দর্শনে রাষ্ট্র-গঠনের (স্টেট ফরমেশন) প্রক্রিয়ায় ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
পাঁচ. পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য কিছু মানুষ আন্দোলন করলো। আন্দোলন করার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। একইভাবে আদিবাসী শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আদিবাসীরাও আন্দোলন করলো। আদিবাসী শব্দটি বাদ দেওয়ার দাবিতে যদি আন্দোলন করা যায়, তাহলে সেটা অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন করা যাবে না কেন? এ জন্য তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে হবে কেন? আবার এ রক্তাক্ত করার প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের জলকামান দিয়ে, টিয়ার গ্যাস দিয়ে, সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে দমন করতে হবে কেন? রাষ্ট্র আসলে কার পাহারাদার?
ছয়. এখানে যে জিনিসটা মনে রাখা জরুরি সেটা হচ্ছে, আদিবাসী-বাঙালি দ্বৈরথ তৈরি করে আখেরে কারা লাভবান হচ্ছে? আমার ধারণা যারা আদিবাসীদের আদিবাসী বলা যাবে না বলে তাদের মাথা ফাটাচ্ছে, তাদের অনেকেই জানেন না আদিবাসীদের আদিবাসী বললে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বাঙালিদের কী ক্ষতি।
পরিশেষে বলবো, আমাদের মনে রাখতে হবে প্রত্যেক মানুষের তার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। বাঙালিদের যেমন আছে, তেমনি আদিবাসীদেরও আছে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।