ঢাকা ১২:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রাজনীতি

  • আপডেট সময় : ১০:৩৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ১১৫ বার পড়া হয়েছে

মো. জাকির হোসেন : বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহী রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভারত যুক্তিসঙ্গত কারণেই অন্য প্রতিবেশীর চেয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। চীন একসময় বৈরী থাকলেও এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বৃহস্পতি তুঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ সময় থেকেই রাশিয়া বাংলাদেশের খুব কাছের বন্ধু।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ডেনমার্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল নায়রুপ রাসমুসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ডেনিশ সরকার এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। তবে আগ্রহের দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার কোনো অসুখ-বিসুখ হলে, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অনিয়ম হলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘুম হারাম। দুশ্চিন্তা-উদ্বেগে কালবিলম্ব না করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের সঙ্গে বাতচিত করেন। মানবাধিকারের প্রতি ইশক-মহব্বতের টানে সমবেদনা জানাতে কারও কারও বাসায় চলে যান।
বাংলাদেশকে নসিহত করতে, নির্বাচন-গণতন্ত্র-মানবাধিকার ফেরি করতে, রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি মার্কিন মন্ত্রী, সহকারী মন্ত্রীরা ১৩ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আকাশ পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে ছুটে আসেন। অথচ ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই আর পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গত সাত বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের আবাসভূমি। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ইকোনমিস্ট’-এর ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলো, পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ২০২২ সালে ১৬৭টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত র‌্যাংকিংয়ে দেখা যায়, বিশ্বের ১২.৬ শতাংশ রাষ্ট্রে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু রয়েছে। পূর্ণ গণতান্ত্রিক ১২.৬ শতাংশ রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেই। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্যান্য যেসব পশ্চিমা রাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকিত এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ২০২২ সালের গণতান্ত্রিক র‌্যাংকিংয়ে ত্রুটিপূর্ণ।
র‌্যাংকিংয়ে পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে- এক. এই রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার ও মৌলিক রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়; দুই. সরকারের ক্ষমতার মধ্যে চেক ও ব্যালেন্সের বৈধ ব্যবস্থা বিদ্যমান; তিন. গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সীমিত সমস্যা রয়েছে এবং চার. গণমাধ্যম বৈচিত্র্যময় ও স্বাধীন।
তার মানে যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার, সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সীমিতের চেয়ে বেশি সমস্যা রয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ব্যর্থতা রয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জাতিগত বৈষম্যসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার, পরিবেশ, নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার, মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসসহ বিভিন্ন সংস্থা ও মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তান ও ইরাক ছাড়াও ২৮টি দেশে মার্কিন সরকারের গোপন কারাগারের সন্ধান মিলেছে।
এই দেশগুলো হলো, আলজেরিয়া, আজারবাইজান, জিবুতি, মিসর, ইথিওপিয়া, গ্যাম্বিয়া, ইসরায়েল, জর্ডান, কেনিয়া, কসোভো, লিবিয়া, লিথুয়ানিয়া, মৌরিতানিয়া, মরোক্কো, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, কাতার, রোমানিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া। স্থল কারাগার ছাড়াও অন্তত ১৭টি জাহাজকে ভাসমান কারাগার হিসেবে ব্যবহারের একাধিক রিপোর্ট রয়েছে। এসব স্থল ও জল কারাগারের মধ্যে বাগরাম, আবুগারিব, গুয়ান্তানামোসহ বেশ ক’টি কারাগার বন্দি নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। ভবিষ্যতে আমেরিকার জন্য বিপদ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে এই অজুহাতে মার্কিন প্রশাসন অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ড্রোন হামলা চালিয়ে অন্ততপক্ষে ৭০০ জন বেসামরিক নাগরিককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আনোয়ার-আল-আওলাকি, সমীর খান ও আওলাকির ১৬ বছরের পুত্র আবদুল রহমানকে ড্রোন হামলা চালিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার বিষয়ে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন সিআইএ, এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা দায়ের করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা যুক্তরাষ্ট্রে নৈমিত্তিক ঘটনা। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১ হাজার ১৪ জন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা চার বছর ধরে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজারের কাছাকাছি।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৮ সালে পুলিশের গুলিতে ৯৯৬ জন নিহত হয়েছেন, যেখানে ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন, ২০১৬ সালে ৯৬৩ জন এবং ২০১৫ সালে ৯৯৫ জন। ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেশটির ১ হাজার ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। টার্কিশ মিডিয়া আউটলেট (টিআরটি ওয়ার্ল্ড)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১ জুন, ২০২০-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মোট ৭ হাজার ৬৬৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। ‘অপারেশন গেট্টো স্টর্ম’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ২৮ ঘণ্টায় একজন কালো চামড়ার পুরুষ, নারী বা শিশুকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই তো সেদিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সাইদ ফয়সালকে আমেরিকান পুলিশ বিচারবহির্ভূতভাবে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করেছে। গত ৭ জানুয়ারি জর্জ ফ্লয়েড কায়দায় আরেক কৃষ্ণাঙ্গ মেম্ফিসে টায়ার নিকোলসকে হত্যা করেছে মার্কিন পুলিশ। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় সড়কে ফেলে চরম নির্মমতা চালানো হয় তার ওপর। এ সময় তার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয় পুলিশ। চরম মারধরের সময় যখন তিনি মা মা বলে চিৎকার করছিলেন, তখন তার মুখ চেপে ধরে পুলিশ সদস্যরা।
টানা নির্যাতনের একপর্যায়ে লুটিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই যুবককে। বিচারবহির্ভূত হত্যার এমন ভয়ংকর রেকর্ড যার দখলে সেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। প্রবাদে আছে, ‘চালুনি বলে সুচ, তোর কেন এত বড় ফুটো’। বন্দিদের ওপর পুলিশ ও কারা কর্মকর্তাদের নিষ্ঠুর আচরণ, জাতিগত বৈষম্য, নারী বন্দিদের ওপর যৌন নিপীড়ন, পুলিশ কর্তৃক বৈদ্যুতিক শক ও রেস্ট্রেইন্ট চেয়ার ব্যবহারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নানা নির্যাতনমূলক কৌশল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জাতিসংঘের নিপীড়নবিরোধী কমিটি মত দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভয়ানক পরস্পরবিরোধী।
ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া ও বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আমেরিকা অতি উৎসাহী হলেও ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে তারা আত্মরক্ষার অধিকার মনে করে। কানাডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ঈবহঃৎব ভড়ৎ জবংবধৎপয ড়হ এষড়নধষরুধঃরড়হ (এষড়নধষ জবংবধৎপয)-এর গবেষক ঔধসবং অ. খঁপধং তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭টি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ মিলিয়ন তথা ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নিজ রাষ্ট্রের শাসকের প্রতি ক্ষোভ, রাগ, অভিমানে শাসককে শায়েস্তা করতে যেসব রাষ্ট্রের মানুষরা যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেসব রাষ্ট্র স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসব রাষ্ট্র এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র।
এরূপ আশ্রিত, ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র খুঁজতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে না। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে মাত্র ৩টি অনুসমর্থন করেছে আর ৬টি এখনও অনুমোদন করেনি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে ৫টি শর্তসংরক্ষণ, ৫টি বোঝাপড়া ও ৪টি ঘোষণা সাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্র অনুসমর্থন করলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুসমর্থন করেনি।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র দুটি রাষ্ট্র নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি, আর অপরটি সুদান। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সংবিধিতে তো স্বাক্ষর করেইনি, উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে এই মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বাধ্য করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনা সদস্য গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে না। ইরাকের একটি প্রখ্যাত শহরের নাম ফালুজা। যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনার সীমিত পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে এই ফালুজায়।
২০০৪ সালে ফালুজার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্বল্প তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও সাদা ফসফরাস বর্ষণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতা সেখানেই থেমে থাকেনি। গত ২০ বছর ধরে সেখানে অগণিত ত্রুটিযুক্ত বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়। বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন মান্দেলা বলেছেন, “ওভ ঃযবৎব রং ধ পড়ঁহঃৎু ঃযধঃ যধং পড়সসরঃঃবফ ঁহংঢ়বধশধনষব ধঃৎড়পরঃরবং রহ ঃযব ড়িৎষফ, রঃ রং ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং ড়ভ অসবৎরপধ. ঞযবু ফড়হ’ঃ পধৎব ভড়ৎ যঁসধহ নবরহমং.”
ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ও ভয়ংকর মানবাধিকার রেকর্ড যে দেশের সেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে প্রস্তাব দিয়েছে, বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তারা বাংলাদেশকে পাশে চায়। তবে শর্ত হলো, বেইজিং ও মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব রেখে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্র আমাদের, কিন্তু সেই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিসহ অন্যান্য বিষয় নির্ধারণ করবে ওয়াশিংটন! প্রস্তাবটি কি সুইট, তাই না?
বিষয়টি অনেকটা এরকম, ‘স্ত্রী আমার, কিন্তু তিনি কীভাবে সাজবেন তা নির্ধারণ করবে পরপুরুষ’। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা যাবে না। এই একই শর্ত প্রতিবেশী ভারতের ওপর আরোপ করার মুরোদ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। কিছু নষ্ট রাজনীতিক ও পচে যাওয়া সুধী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের বিষয়ে পশ্চিমা কিছু রাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত ও বিপজ্জনক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ‘মামা বাড়ির আবদার’ তো রীতিমতো সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। এর সঙ্গে গণতন্ত্র মানবাধিকারের কোন সম্পর্ক, এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যসহ ১৭ জনকে হত্যা করার পর হত্যার বিচার বন্ধে খুনিদের দায়মুক্তি দিতে দায়মুক্তি আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিল? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জেলখানার ভেতর উপ-রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের ২ জন কর্মরত মন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কি তখন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল?
প্রবাদ আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। হরিণের মাংস সুস্বাদু বলে শিকারি তার পেছনে তীর হাতে ছোটে। হরিণের মাংস বিস্বাদ হলে শিকারি হরিণের দিকে চোখ তুলে চেয়েও দেখতো না। কাজেই হরিণ নিজেই নিজের শত্রু। ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান ও তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ক্রমেই সম্পদশালী হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের অবস্থাও ওই হরিণের মতো। বিদেশিদের মাত্রাতিরিক্ত ও বিপজ্জনক আগ্রহ এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রাজনীতি থেকে তাই সাবধান।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রাজনীতি

আপডেট সময় : ১০:৩৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

মো. জাকির হোসেন : বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহী রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভারত যুক্তিসঙ্গত কারণেই অন্য প্রতিবেশীর চেয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। চীন একসময় বৈরী থাকলেও এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বৃহস্পতি তুঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ সময় থেকেই রাশিয়া বাংলাদেশের খুব কাছের বন্ধু।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ডেনমার্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল নায়রুপ রাসমুসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ডেনিশ সরকার এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। তবে আগ্রহের দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার কোনো অসুখ-বিসুখ হলে, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অনিয়ম হলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘুম হারাম। দুশ্চিন্তা-উদ্বেগে কালবিলম্ব না করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের সঙ্গে বাতচিত করেন। মানবাধিকারের প্রতি ইশক-মহব্বতের টানে সমবেদনা জানাতে কারও কারও বাসায় চলে যান।
বাংলাদেশকে নসিহত করতে, নির্বাচন-গণতন্ত্র-মানবাধিকার ফেরি করতে, রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি মার্কিন মন্ত্রী, সহকারী মন্ত্রীরা ১৩ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আকাশ পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে ছুটে আসেন। অথচ ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই আর পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গত সাত বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের আবাসভূমি। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ইকোনমিস্ট’-এর ‘ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলো, পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ২০২২ সালে ১৬৭টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত র‌্যাংকিংয়ে দেখা যায়, বিশ্বের ১২.৬ শতাংশ রাষ্ট্রে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু রয়েছে। পূর্ণ গণতান্ত্রিক ১২.৬ শতাংশ রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেই। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্যান্য যেসব পশ্চিমা রাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উচ্চকিত এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ২০২২ সালের গণতান্ত্রিক র‌্যাংকিংয়ে ত্রুটিপূর্ণ।
র‌্যাংকিংয়ে পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে- এক. এই রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার ও মৌলিক রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়; দুই. সরকারের ক্ষমতার মধ্যে চেক ও ব্যালেন্সের বৈধ ব্যবস্থা বিদ্যমান; তিন. গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সীমিত সমস্যা রয়েছে এবং চার. গণমাধ্যম বৈচিত্র্যময় ও স্বাধীন।
তার মানে যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার, সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সীমিতের চেয়ে বেশি সমস্যা রয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ব্যর্থতা রয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জাতিগত বৈষম্যসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার, পরিবেশ, নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার, মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসসহ বিভিন্ন সংস্থা ও মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তান ও ইরাক ছাড়াও ২৮টি দেশে মার্কিন সরকারের গোপন কারাগারের সন্ধান মিলেছে।
এই দেশগুলো হলো, আলজেরিয়া, আজারবাইজান, জিবুতি, মিসর, ইথিওপিয়া, গ্যাম্বিয়া, ইসরায়েল, জর্ডান, কেনিয়া, কসোভো, লিবিয়া, লিথুয়ানিয়া, মৌরিতানিয়া, মরোক্কো, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, কাতার, রোমানিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া। স্থল কারাগার ছাড়াও অন্তত ১৭টি জাহাজকে ভাসমান কারাগার হিসেবে ব্যবহারের একাধিক রিপোর্ট রয়েছে। এসব স্থল ও জল কারাগারের মধ্যে বাগরাম, আবুগারিব, গুয়ান্তানামোসহ বেশ ক’টি কারাগার বন্দি নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। ভবিষ্যতে আমেরিকার জন্য বিপদ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে এই অজুহাতে মার্কিন প্রশাসন অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ড্রোন হামলা চালিয়ে অন্ততপক্ষে ৭০০ জন বেসামরিক নাগরিককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আনোয়ার-আল-আওলাকি, সমীর খান ও আওলাকির ১৬ বছরের পুত্র আবদুল রহমানকে ড্রোন হামলা চালিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার বিষয়ে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন সিআইএ, এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা দায়ের করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা যুক্তরাষ্ট্রে নৈমিত্তিক ঘটনা। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১ হাজার ১৪ জন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা চার বছর ধরে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১ হাজারের কাছাকাছি।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৮ সালে পুলিশের গুলিতে ৯৯৬ জন নিহত হয়েছেন, যেখানে ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৮৭ জন, ২০১৬ সালে ৯৬৩ জন এবং ২০১৫ সালে ৯৯৫ জন। ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেশটির ১ হাজার ১৭৬ জন নিহত হয়েছেন। টার্কিশ মিডিয়া আউটলেট (টিআরটি ওয়ার্ল্ড)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শীর্ষে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১ জুন, ২০২০-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মোট ৭ হাজার ৬৬৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। ‘অপারেশন গেট্টো স্টর্ম’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ২৮ ঘণ্টায় একজন কালো চামড়ার পুরুষ, নারী বা শিশুকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই তো সেদিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সাইদ ফয়সালকে আমেরিকান পুলিশ বিচারবহির্ভূতভাবে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করেছে। গত ৭ জানুয়ারি জর্জ ফ্লয়েড কায়দায় আরেক কৃষ্ণাঙ্গ মেম্ফিসে টায়ার নিকোলসকে হত্যা করেছে মার্কিন পুলিশ। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় সড়কে ফেলে চরম নির্মমতা চালানো হয় তার ওপর। এ সময় তার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয় পুলিশ। চরম মারধরের সময় যখন তিনি মা মা বলে চিৎকার করছিলেন, তখন তার মুখ চেপে ধরে পুলিশ সদস্যরা।
টানা নির্যাতনের একপর্যায়ে লুটিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই যুবককে। বিচারবহির্ভূত হত্যার এমন ভয়ংকর রেকর্ড যার দখলে সেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। প্রবাদে আছে, ‘চালুনি বলে সুচ, তোর কেন এত বড় ফুটো’। বন্দিদের ওপর পুলিশ ও কারা কর্মকর্তাদের নিষ্ঠুর আচরণ, জাতিগত বৈষম্য, নারী বন্দিদের ওপর যৌন নিপীড়ন, পুলিশ কর্তৃক বৈদ্যুতিক শক ও রেস্ট্রেইন্ট চেয়ার ব্যবহারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নানা নির্যাতনমূলক কৌশল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জাতিসংঘের নিপীড়নবিরোধী কমিটি মত দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভয়ানক পরস্পরবিরোধী।
ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া ও বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে আমেরিকা অতি উৎসাহী হলেও ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে তারা আত্মরক্ষার অধিকার মনে করে। কানাডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ঈবহঃৎব ভড়ৎ জবংবধৎপয ড়হ এষড়নধষরুধঃরড়হ (এষড়নধষ জবংবধৎপয)-এর গবেষক ঔধসবং অ. খঁপধং তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭টি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ মিলিয়ন তথা ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নিজ রাষ্ট্রের শাসকের প্রতি ক্ষোভ, রাগ, অভিমানে শাসককে শায়েস্তা করতে যেসব রাষ্ট্রের মানুষরা যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেসব রাষ্ট্র স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসব রাষ্ট্র এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র।
এরূপ আশ্রিত, ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র খুঁজতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে না। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে মাত্র ৩টি অনুসমর্থন করেছে আর ৬টি এখনও অনুমোদন করেনি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে ৫টি শর্তসংরক্ষণ, ৫টি বোঝাপড়া ও ৪টি ঘোষণা সাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্র অনুসমর্থন করলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুসমর্থন করেনি।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র দুটি রাষ্ট্র নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি, আর অপরটি সুদান। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সংবিধিতে তো স্বাক্ষর করেইনি, উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে এই মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বাধ্য করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনা সদস্য গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে না। ইরাকের একটি প্রখ্যাত শহরের নাম ফালুজা। যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনার সীমিত পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে এই ফালুজায়।
২০০৪ সালে ফালুজার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্বল্প তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও সাদা ফসফরাস বর্ষণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতা সেখানেই থেমে থাকেনি। গত ২০ বছর ধরে সেখানে অগণিত ত্রুটিযুক্ত বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়। বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন মান্দেলা বলেছেন, “ওভ ঃযবৎব রং ধ পড়ঁহঃৎু ঃযধঃ যধং পড়সসরঃঃবফ ঁহংঢ়বধশধনষব ধঃৎড়পরঃরবং রহ ঃযব ড়িৎষফ, রঃ রং ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং ড়ভ অসবৎরপধ. ঞযবু ফড়হ’ঃ পধৎব ভড়ৎ যঁসধহ নবরহমং.”
ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ও ভয়ংকর মানবাধিকার রেকর্ড যে দেশের সেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে প্রস্তাব দিয়েছে, বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তারা বাংলাদেশকে পাশে চায়। তবে শর্ত হলো, বেইজিং ও মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব রেখে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্র আমাদের, কিন্তু সেই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিসহ অন্যান্য বিষয় নির্ধারণ করবে ওয়াশিংটন! প্রস্তাবটি কি সুইট, তাই না?
বিষয়টি অনেকটা এরকম, ‘স্ত্রী আমার, কিন্তু তিনি কীভাবে সাজবেন তা নির্ধারণ করবে পরপুরুষ’। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা যাবে না। এই একই শর্ত প্রতিবেশী ভারতের ওপর আরোপ করার মুরোদ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। কিছু নষ্ট রাজনীতিক ও পচে যাওয়া সুধী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের বিষয়ে পশ্চিমা কিছু রাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত ও বিপজ্জনক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ‘মামা বাড়ির আবদার’ তো রীতিমতো সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। এর সঙ্গে গণতন্ত্র মানবাধিকারের কোন সম্পর্ক, এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যসহ ১৭ জনকে হত্যা করার পর হত্যার বিচার বন্ধে খুনিদের দায়মুক্তি দিতে দায়মুক্তি আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিল? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জেলখানার ভেতর উপ-রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের ২ জন কর্মরত মন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কি তখন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল?
প্রবাদ আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। হরিণের মাংস সুস্বাদু বলে শিকারি তার পেছনে তীর হাতে ছোটে। হরিণের মাংস বিস্বাদ হলে শিকারি হরিণের দিকে চোখ তুলে চেয়েও দেখতো না। কাজেই হরিণ নিজেই নিজের শত্রু। ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান ও তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে ক্রমেই সম্পদশালী হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের অবস্থাও ওই হরিণের মতো। বিদেশিদের মাত্রাতিরিক্ত ও বিপজ্জনক আগ্রহ এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রাজনীতি থেকে তাই সাবধান।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।