ঢাকা ০২:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

বহুমাত্রিক ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ফসল হচ্ছে ভুট্টা

  • আপডেট সময় : ১০:৫১:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ এপ্রিল ২০২২
  • ৯৭ বার পড়া হয়েছে

কৃষি ও কৃষক ডেস্ক :কৃষির বিভিন্ন প্রয়োজনে চাহিদা ও গুরুত্ব বাড়ছে ভুট্টার। সাথে বাড়ছে চাষাবাদও। লালমনিরহাটের প্রধান অর্থকরী ফসল ভুট্টা। ভুট্টা চাষে বদলে গেছে লালমনিরহাট জেলার অর্থনীতি। ২৫ বছর ধরে ভুট্টা চাষ করে বদলে গেছে এখানকার মানুষের জীবনমান। এবছর ভুট্টা চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ভুট্টা রোপণের পর কয়েকবার বৃষ্টির ফলে কৃষকদের খরচও কমে গেছে। এরই মধ্যে তিস্তা ও ধরলা নদীর চর এলাকাগুলোতে ভুট্টা তোলার ধুম পড়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ভুট্টা তোলা শুরু হবে। তাই কৃষকরা এখন তাদের ভুট্টা ক্ষেতের গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলছেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চর অঞ্চলের নিন্ম আয়ের লোকজন ভুট্টার পাতা বিক্রি করে কিছুদিন ভালোভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
প্রতিবিঘা ভুট্টা ক্ষেতের পাতা ও গাছের মাথা কাটতে ২ জন করে শ্রমিক লাগে। এখন আর তা লাগছে না। নিন্ম আয়ের লোকজন বিনা মূল্যে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে কোনো ভুট্টার ক্ষতি হচ্ছে না। ভুট্টা তোলার ১৫-২০ দিন আগে গাছের পাতা ও মাথা কেটে দিতে হয়। এতে ভুট্টায় সূর্যের আলো পড়লে ভুট্টার রং ভালো হয়।
দিনমজুর শ্রেণির লোকজন পরিবারের সবাই মিলে ভুট্টার পাতা ছিঁড়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন। দামে কম হওয়ায় অনেকেই গোখাদ্য হিসেবে তা কিনছেন। এতে একদিকে নিন্ম আয়ের লোকজন যেমন আয় করছেন, অন্যদিকে কম দামে বিভিন্ন গরুর খামারিরা পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার ভুল্লারহাট, ভোটমারী, হাতীবান্ধা উপজেলার ঘুন্টি, পারুলিয়া, হাতীবান্ধাহাটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ভুট্টা পাতার হাট বসছে। সেখানে কিছু সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও ভুট্টার পাতা বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ হাটে প্রতি ভুট্টার পাতার আটি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা দরে। দামে কম তাই গরুর খামারিরা প্রায় ৩০ থেকে ৫০টি আটি কিনছেন তাদের কাছ থেকে। দেখা গেছে, তিস্তারচর থেকে কেউ মাথায়, কেউবা ঘাড়ে কেউ সাইকেলে করে ভুট্টার পাতা নিয়ে বাজারে ঢুকছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী এলাকার ভুট্টা চাষ আলাউদ্দিন (৫০) বলেন, বর্তমানে কোনো কাজ কাম হাতে নেই তাই তিস্তার চরে গিয়ে ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে এই ভোটমারি রেলস্টেশনে বিক্রি করতে আসছি। এতে একশ থেকে দেড়শ টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে বাজার করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব ডাউয়া বাড়ি আদর্শ নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অনন্ত বলেন, সকাল বেলায় স্কুলে যাই বিকেল বেলায় চরে গিয়ে পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করি। এতে যে টাকা পাই তা দিয়ে বই খাতা কলম কিনি। হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর বিছনদই গ্রামে কৃষক আজিজার মিয়া জানান, ভুট্টা চাষ করে আমরা দিনে দিনে লাভবান হচ্ছি। ভুট্টার গাছ, পাতা সবই মূল্যবান। ভুট্টা বিক্রির পাশাপাশি পাতা বিক্রি করেও আমাদের আয় হচ্ছে।
কথা হয় ভোটমারি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হুমায়ুন আলোর সঙ্গে, সে জানায় তার বাবা দিনমজুর ঠিকমতো বই-খাতা-কলম কিনে দিতে পারেন না। তাই চরে গিয়ে পাতা সংগ্রহ করে বন্ধুরা মিলে ভুট্টা পাতা বিক্রি করে। কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে শার্ট-প্যান্ট, কলম, খাতা কিনে নেয়। কালীগঞ্জ উপজেলার ভুল্লারহাটের ইউনুস আলী জানান, বর্তমানে জিনিসপত্রের যা দাম হামার গরিব মানুষের অবস্থা খারাপ। তাই প্রতিদিন তিস্তার চরে গিয়ে ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে যে টাকা হয় তা দিয়ে চাল-ডাল কিনে পরিবার নিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। লালমনিরহাট জেলার প্রাণিসম্পদ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম জানান, পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টার পাতা উত্তম খাবার। ভুট্টার পাতা গবাদি পশুকে খাওয়ালে কোনো ক্ষতি হয় না। খামারিরা ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে গরু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে বেশি লাভবান হবেন। লালমনিরহাট কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, তিস্তা ও ধরলা নদীর চরে এবছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হওয়ার আশা প্রকাশ করছি। কৃষকরা ভুট্টা চাষে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে কৃষকরা ভুট্টার পাতা বিক্রি করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
ফার্মে খাদ্যের যোগান দিতে বাড়ছে ভুট্টা চাষ : গাজীপুরের কালীগঞ্জে চলতি মৌসুমে ভুট্টা চাষে বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় চাষিরা। উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ওইসব ফার্মের খাদ্যের যোগান দিতে স্থানীয় কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তা ছাড়া, ভুট্টা চাষ সহজ ও লাভজনক। স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে উৎপাদন হবে দ্বিগুণ।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, কালীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার তুমলিয়া, নাগরী, বক্তারপুর, জাঙ্গালীয়া, মোক্তারপুর, জামালপুর ও বাহাদুরসাদী ইউনিয়নে ভুট্টার আবাদ হয়। তবে উপজেলার জামালপুর ইউনিনে ভূট্টার আবাদ একটু বেশি হয়। আর স্থানীভাবে উৎপাদিত ভুট্টার জাতগুলোর মধ্যে সুপার সাইন ২৭৬০, রাজলক্ষ্মী ৩৩৫৫। তবে এই দুটি জাতের মধ্য সুপার সাইন ২৭৬০ বেশি চাষ হয়। ভুট্টা চাষের মোট ২১ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ হেক্টর জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ চাষ হলে বাকী ২ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে রাজলক্ষ্মী ৩৩৫৫।
সূত্র আরও জানায়, স্থানীয় কৃষকরা গত বছর মাত্র ১২ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছে। সে বছর ওই পরিমাণ জমিতে ৮ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপন্ন হয়। কিন্তু এ বছর ২১ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করলেও গত বছরের উৎপাদনের তুলনায় চলতি বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছে স্থানীয় কৃষি অফিস।
উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের উত্তর খৈকড়া গ্রামের ভুট্টা চাষি মোক্তাজুল খান (৩৫) জানান, গত বছর তিনি কৃষি অফিসের সহযোগীতায় ১ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। ওই বছর ফলনও ভালো ছিল। প্রায় ৪৫ মণ উৎপাদিত ভুট্টা পুরোটাই তিনি গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবারও তিনি কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ২ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। আশা করছেন এ বছর বাম্পার ফলন হবে। আর ফলনকৃত ভুট্টার কিছু গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বাকিটা তিনি বিক্রি করে দেবেন।
জামালপুর ইউনিয়নের খাগড়াচর এলাকার ভুট্টা চাষি আবু তাহের (৪৭) বলেন, আমি গত বছর আধা বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। স্থানীয়ভাবে মাছ ও গরু খামারিদের কাছে ভুট্টার বেশি কদর থাকায় এবং দাম ভালো পাওয়ায় এবার আমি ১ বিঘা জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ জাতের ভুট্টার চাষ করেছি। এ ছাড়া, ওই ১ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করতে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে ডিএপি, এমওপি সার ও বীজ পেয়েছেন বলেও জানান তিনি। একই এলাকার ভুট্টা চাষি মোর্শদা বেগম (৪৫) জানান, তিনি গত বছর কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ১ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। এবারও তিনি একই পরিমাণ জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ জাতের ভুট্টার আবাদ করেছেন। তবে এ বছর তার পুরো জমিতে কৃষি অফিসের অধীনে রাজস্ব খাতের অর্থায়নে একটি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। আর তাতে তিনি বিনামূল্যে ডিএপি, এমওপি সার, বীজ ছাড়াও বালাইনাশক ও কীটনাশক পেয়েছেন।
উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের চুপাইর ব্লকের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শারমীন আক্তার বলেন, জামালপুর ইউনিয়নের খাগড়াচর এলাকার ভুট্টার ফলন উপজেলার অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে চোখে পড়ার মতো। তা ছাড়া, চাষিদের উৎপাদন করা ভুট্টা নিজেদের গরুর খামারে গরুর খাদ্য ও মৎস্য খামারে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। ভুট্টা চাষ সহজ ও লাভজনক হওয়ায় এখানকার কৃষকের মাঝে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানান তিনি। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, কালীগঞ্জে প্রচুর ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওইসব ফার্মের খাদ্যের জোগান দিতে কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আর ভুট্টা চাষ এগিয়ে নিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। আমরা প্রণোদনা কর্মসূচি ও রাজস্ব প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভুট্টার প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছি। এ বছর সরকারের কৃষি প্রণোদনা হিসেবে স্থানীয় ২শ কৃষককে বিনামূল্যে ২ কেজি করে ভুট্টার বীজ ও ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিতরণ করা হয়েছে। তা ছাড়াও, সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ১০টি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ব্লকের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত ভুট্টার ক্ষেত পরিদর্শনসহ কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর ভুট্টার ফলন যেভাবে দেখা যাচ্ছে, তাতে স্থানীয় কৃষক আগামী বছর ভুট্টা চাষে আরও বেশি আগ্রহী হবে। তবে এ বছর হেক্টর প্রতি সাড়ে ৮ থেকে ১০ টন করে ভুট্টার ফলন পাবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বহুমাত্রিক ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ফসল হচ্ছে ভুট্টা

আপডেট সময় : ১০:৫১:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ এপ্রিল ২০২২

কৃষি ও কৃষক ডেস্ক :কৃষির বিভিন্ন প্রয়োজনে চাহিদা ও গুরুত্ব বাড়ছে ভুট্টার। সাথে বাড়ছে চাষাবাদও। লালমনিরহাটের প্রধান অর্থকরী ফসল ভুট্টা। ভুট্টা চাষে বদলে গেছে লালমনিরহাট জেলার অর্থনীতি। ২৫ বছর ধরে ভুট্টা চাষ করে বদলে গেছে এখানকার মানুষের জীবনমান। এবছর ভুট্টা চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ভুট্টা রোপণের পর কয়েকবার বৃষ্টির ফলে কৃষকদের খরচও কমে গেছে। এরই মধ্যে তিস্তা ও ধরলা নদীর চর এলাকাগুলোতে ভুট্টা তোলার ধুম পড়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ভুট্টা তোলা শুরু হবে। তাই কৃষকরা এখন তাদের ভুট্টা ক্ষেতের গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলছেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চর অঞ্চলের নিন্ম আয়ের লোকজন ভুট্টার পাতা বিক্রি করে কিছুদিন ভালোভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
প্রতিবিঘা ভুট্টা ক্ষেতের পাতা ও গাছের মাথা কাটতে ২ জন করে শ্রমিক লাগে। এখন আর তা লাগছে না। নিন্ম আয়ের লোকজন বিনা মূল্যে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে কোনো ভুট্টার ক্ষতি হচ্ছে না। ভুট্টা তোলার ১৫-২০ দিন আগে গাছের পাতা ও মাথা কেটে দিতে হয়। এতে ভুট্টায় সূর্যের আলো পড়লে ভুট্টার রং ভালো হয়।
দিনমজুর শ্রেণির লোকজন পরিবারের সবাই মিলে ভুট্টার পাতা ছিঁড়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন। দামে কম হওয়ায় অনেকেই গোখাদ্য হিসেবে তা কিনছেন। এতে একদিকে নিন্ম আয়ের লোকজন যেমন আয় করছেন, অন্যদিকে কম দামে বিভিন্ন গরুর খামারিরা পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার ভুল্লারহাট, ভোটমারী, হাতীবান্ধা উপজেলার ঘুন্টি, পারুলিয়া, হাতীবান্ধাহাটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ভুট্টা পাতার হাট বসছে। সেখানে কিছু সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও ভুট্টার পাতা বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ হাটে প্রতি ভুট্টার পাতার আটি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা দরে। দামে কম তাই গরুর খামারিরা প্রায় ৩০ থেকে ৫০টি আটি কিনছেন তাদের কাছ থেকে। দেখা গেছে, তিস্তারচর থেকে কেউ মাথায়, কেউবা ঘাড়ে কেউ সাইকেলে করে ভুট্টার পাতা নিয়ে বাজারে ঢুকছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী এলাকার ভুট্টা চাষ আলাউদ্দিন (৫০) বলেন, বর্তমানে কোনো কাজ কাম হাতে নেই তাই তিস্তার চরে গিয়ে ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে এই ভোটমারি রেলস্টেশনে বিক্রি করতে আসছি। এতে একশ থেকে দেড়শ টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে বাজার করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। হাতীবান্ধা উপজেলার পূর্ব ডাউয়া বাড়ি আদর্শ নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অনন্ত বলেন, সকাল বেলায় স্কুলে যাই বিকেল বেলায় চরে গিয়ে পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করি। এতে যে টাকা পাই তা দিয়ে বই খাতা কলম কিনি। হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর বিছনদই গ্রামে কৃষক আজিজার মিয়া জানান, ভুট্টা চাষ করে আমরা দিনে দিনে লাভবান হচ্ছি। ভুট্টার গাছ, পাতা সবই মূল্যবান। ভুট্টা বিক্রির পাশাপাশি পাতা বিক্রি করেও আমাদের আয় হচ্ছে।
কথা হয় ভোটমারি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হুমায়ুন আলোর সঙ্গে, সে জানায় তার বাবা দিনমজুর ঠিকমতো বই-খাতা-কলম কিনে দিতে পারেন না। তাই চরে গিয়ে পাতা সংগ্রহ করে বন্ধুরা মিলে ভুট্টা পাতা বিক্রি করে। কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে শার্ট-প্যান্ট, কলম, খাতা কিনে নেয়। কালীগঞ্জ উপজেলার ভুল্লারহাটের ইউনুস আলী জানান, বর্তমানে জিনিসপত্রের যা দাম হামার গরিব মানুষের অবস্থা খারাপ। তাই প্রতিদিন তিস্তার চরে গিয়ে ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে যে টাকা হয় তা দিয়ে চাল-ডাল কিনে পরিবার নিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। লালমনিরহাট জেলার প্রাণিসম্পদ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম জানান, পশুখাদ্য হিসেবে ভুট্টার পাতা উত্তম খাবার। ভুট্টার পাতা গবাদি পশুকে খাওয়ালে কোনো ক্ষতি হয় না। খামারিরা ভুট্টার পাতা সংগ্রহ করে গরু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে বেশি লাভবান হবেন। লালমনিরহাট কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, তিস্তা ও ধরলা নদীর চরে এবছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হওয়ার আশা প্রকাশ করছি। কৃষকরা ভুট্টা চাষে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে কৃষকরা ভুট্টার পাতা বিক্রি করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
ফার্মে খাদ্যের যোগান দিতে বাড়ছে ভুট্টা চাষ : গাজীপুরের কালীগঞ্জে চলতি মৌসুমে ভুট্টা চাষে বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় চাষিরা। উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ওইসব ফার্মের খাদ্যের যোগান দিতে স্থানীয় কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তা ছাড়া, ভুট্টা চাষ সহজ ও লাভজনক। স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে উৎপাদন হবে দ্বিগুণ।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, কালীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার তুমলিয়া, নাগরী, বক্তারপুর, জাঙ্গালীয়া, মোক্তারপুর, জামালপুর ও বাহাদুরসাদী ইউনিয়নে ভুট্টার আবাদ হয়। তবে উপজেলার জামালপুর ইউনিনে ভূট্টার আবাদ একটু বেশি হয়। আর স্থানীভাবে উৎপাদিত ভুট্টার জাতগুলোর মধ্যে সুপার সাইন ২৭৬০, রাজলক্ষ্মী ৩৩৫৫। তবে এই দুটি জাতের মধ্য সুপার সাইন ২৭৬০ বেশি চাষ হয়। ভুট্টা চাষের মোট ২১ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ হেক্টর জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ চাষ হলে বাকী ২ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে রাজলক্ষ্মী ৩৩৫৫।
সূত্র আরও জানায়, স্থানীয় কৃষকরা গত বছর মাত্র ১২ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছে। সে বছর ওই পরিমাণ জমিতে ৮ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপন্ন হয়। কিন্তু এ বছর ২১ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। তবে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করলেও গত বছরের উৎপাদনের তুলনায় চলতি বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছে স্থানীয় কৃষি অফিস।
উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের উত্তর খৈকড়া গ্রামের ভুট্টা চাষি মোক্তাজুল খান (৩৫) জানান, গত বছর তিনি কৃষি অফিসের সহযোগীতায় ১ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। ওই বছর ফলনও ভালো ছিল। প্রায় ৪৫ মণ উৎপাদিত ভুট্টা পুরোটাই তিনি গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবারও তিনি কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ২ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। আশা করছেন এ বছর বাম্পার ফলন হবে। আর ফলনকৃত ভুট্টার কিছু গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে বাকিটা তিনি বিক্রি করে দেবেন।
জামালপুর ইউনিয়নের খাগড়াচর এলাকার ভুট্টা চাষি আবু তাহের (৪৭) বলেন, আমি গত বছর আধা বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। স্থানীয়ভাবে মাছ ও গরু খামারিদের কাছে ভুট্টার বেশি কদর থাকায় এবং দাম ভালো পাওয়ায় এবার আমি ১ বিঘা জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ জাতের ভুট্টার চাষ করেছি। এ ছাড়া, ওই ১ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করতে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে ডিএপি, এমওপি সার ও বীজ পেয়েছেন বলেও জানান তিনি। একই এলাকার ভুট্টা চাষি মোর্শদা বেগম (৪৫) জানান, তিনি গত বছর কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ১ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন। এবারও তিনি একই পরিমাণ জমিতে সুপার সাইন ২৭৬০ জাতের ভুট্টার আবাদ করেছেন। তবে এ বছর তার পুরো জমিতে কৃষি অফিসের অধীনে রাজস্ব খাতের অর্থায়নে একটি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। আর তাতে তিনি বিনামূল্যে ডিএপি, এমওপি সার, বীজ ছাড়াও বালাইনাশক ও কীটনাশক পেয়েছেন।
উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের চুপাইর ব্লকের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শারমীন আক্তার বলেন, জামালপুর ইউনিয়নের খাগড়াচর এলাকার ভুট্টার ফলন উপজেলার অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে চোখে পড়ার মতো। তা ছাড়া, চাষিদের উৎপাদন করা ভুট্টা নিজেদের গরুর খামারে গরুর খাদ্য ও মৎস্য খামারে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। ভুট্টা চাষ সহজ ও লাভজনক হওয়ায় এখানকার কৃষকের মাঝে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানান তিনি। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, কালীগঞ্জে প্রচুর ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওইসব ফার্মের খাদ্যের জোগান দিতে কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আর ভুট্টা চাষ এগিয়ে নিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। আমরা প্রণোদনা কর্মসূচি ও রাজস্ব প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভুট্টার প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করছি। এ বছর সরকারের কৃষি প্রণোদনা হিসেবে স্থানীয় ২শ কৃষককে বিনামূল্যে ২ কেজি করে ভুট্টার বীজ ও ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিতরণ করা হয়েছে। তা ছাড়াও, সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ১০টি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ব্লকের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত ভুট্টার ক্ষেত পরিদর্শনসহ কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর ভুট্টার ফলন যেভাবে দেখা যাচ্ছে, তাতে স্থানীয় কৃষক আগামী বছর ভুট্টা চাষে আরও বেশি আগ্রহী হবে। তবে এ বছর হেক্টর প্রতি সাড়ে ৮ থেকে ১০ টন করে ভুট্টার ফলন পাবেন বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।