ড. মো.শফিকুল ইসলাম : শোকাবহ আগস্ট মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।বর্তমানে দেশে যে অবস্থা বিরাজমান তা কেউ প্রত্যাশা করে না। এই অবস্থা থেকে দ্রুত আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসতে হবে। শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে অধিকাংশ মানুষ শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিল।এখন দেখা যাচ্ছে নানা স্বার্থান্বেষী মহল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছিল। কিন্তু তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে। সাধারণ মানুষসহ শিক্ষার্থী, শ্রমিক আহত ও নিহত হয়েছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসদাচরণের নিন্দা এবং একই সাথে এ সব ঘটনার তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানাই।
কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহতদের প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। তবে এই মুহূর্তে সরকারের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে যেমন-ক) সাম্প্রতিক সময়ে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশ করতে হবে। খ) ঘটনাগুলোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে হবে। গ) সরকার বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছে,এই কমিশনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে,যার মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারে। ঘ) হামলা-সহিংসতায় সকল শিক্ষার্থী ও অন্যান্য সকলের প্রাণহানির ঘটনার কঠোর বিচার করবে সরকারকে এবিষয়ে আশ্বাস দিতে হবে। ঙ) বিশেষ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নিহত হয়েছে,যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে।চ)দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন সময় নিরপরাধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচরণ,নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। ছ) একইসাথে শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যার মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির অনেকাংশ পূরণ হয়ে গেলে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তা থেকে ঘরে ফিরবে।
এছাড়া দেশের শান্তির জন্য বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দল আওয়ামী লীগকে সরকারে থাকতে হলে,সরকারের দায়িত্বশীল শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী দেশের জনগণের নিকট দুঃখ প্রকাশ করতে পারে। আহত সকলের চিকিৎসা এবং নিহত সকলের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। যদিও জীবনের মূল্য কোন কিছুই দিয়ে পূরণ করা যায় না,নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনিতি কিছুদিনের জন্য হলেও বন্ধ রাখতে হবে। সরকার প্রধান সরাসরি শিক্ষার্থীদেরকে গণভবনে ডেকে সংলাপের আয়োজন করতে পারে,সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা যেতে পারে। কারণ তারা কেউ আবেগের বশত বা কারো উস্কানিতে অন্যায় কাজ করতে পারে। তবে সারাদেশে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে পর্যায়ক্রমে।
কোটা সংস্কারের ইতিবাচক সমাধান হওয়ার পরও আন্দোলন চলছে। অর্থাৎ বুঝতে হবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। এই ষড়যন্ত্র আমাদের প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। কেউ কেউ সরকার পতনের ডাক দিচ্ছে,যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সরকার এমন কোন কাজ করেনি যে সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ না রেখে কোন উপায় ছিল না। কারণ আন্দোলন থেকে এখান থেকে শুরু। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত। এই সংকটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করলে আরও বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া খুব কঠিন। আন্দোলনের ধাক্কা লেগেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন এখনও চলমান। তাই সরকারের উচিত হবে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। কারণ ক্লাস কার্যক্রম চলমান থাকলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বা অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। দেশের ২৪টি (গুচ্ছভুক্ত) সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান অবস্থায় শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থগিত হয়ে যায় এ সংক্রান্ত কার্যক্রম।এমনকি কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ সার্বিকভাবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ভর্তি বিলম্বিত হতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ শিক্ষকরা কর্মবিরতি বন্ধ না করলে, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে না।
সাময়িক সময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করলে অনেক সেশনজট কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে প্রজেক্ট বা গবেষণা পেপার উপস্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ২০২৪ সালে যাদের পড়াশুনা সম্পন্ন হওয়ার কথা,তাদের যথাসময়ে ডিগ্রি ও সনদপত্র না পাওয়ার আশংকা রয়েছে।
করোনা মহামারির মতো আরেকটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা অনিশ্চিত। দ্রুত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আসুক। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে অনলাইন ক্লাস একটি ভাল সমাধান হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকায় শিক্ষক,শিক্ষার্থীদের কোন অফিসিয়াল কাজকর্ম না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছে। আর সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা ধরণের গুজব দেখছে এবং কেউ কেউ আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে এরকম অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে নানাবিধ পড়াশুনা সংক্রান্ত কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে তারা ব্যস্ত থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে এবং কারো উস্কানিতে মনোযোগ দেওয়ার সময়ও কম পাবে। করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে ছিল সরকার। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত। এখন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার জন্য কোন চ্যালেঞ্জ আসবে না। যেখানে শিক্ষকরা ক্লাস,ক্লাস টেস্ট, টার্মপেপার, সাপ্তাহিক পরীক্ষা নিতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীদের সেশনজট কমে আসবে।
দেশের সকল প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দিতে হবে যাতে তারা অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার পূর্বে শিক্ষকদের আন্দোলনকে যেভাবেই হোক দ্রুত ইতিবাচক ভাবে সমাধান করতে হবে। আর দেরি নয়। কারণ শিক্ষকদের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাতে হবে,যেখানে শিক্ষকরা সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে যেতে পারে। দেশের এই সংকট মুহূর্তে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্ব রয়েছে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সন্তানদের যেন অন্য কারো রাজনীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার হতে না দেয়।
সার্বিক পরিস্থিতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহল ধৈর্য, সহনশীলতা, বিচক্ষণতার সাথে উদ্ভুত এই পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেষ্ট এবং সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।