ঢাকা ০২:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বর্জ্যের ভাগাড় সোনাদিয়া দ্বীপ

  • আপডেট সময় : ০১:০৭:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২২
  • ১১২ বার পড়া হয়েছে

কক্সবাজার সংবাদদাতা : স্তূপ আকারে জমে থাকা বর্জ্য সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্রকে গিলে খাচ্ছে। কক্সবাজার শহর থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়া। জীববৈচিত্রে ভরপুর সোনাদিয়া এখন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্যের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এই দ্বীপের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য। সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার। এই সৈকতের উচ্চ জোয়ার প্লাবিত অঞ্চল জুড়ে শুধুই খালি বোতল, ভাঙা বোতল, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, ব্যাগ, জাল ও মেডিক্যাল বর্জ্যসহ জৈব-অজৈব নানা ধরনের বর্জ্যের স্তূপ। সামুদ্রিক জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সোনাদিয়া দ্বীপে প্রায়ই নানা ধরনের বর্জ্য ভেসে আসলেও গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর জলোচ্ছ্বাসে টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য আচঁড়ে পড়েছে এই দ্বীপে। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের
(বোরি) পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, স্তূপ আকারে জমে থাকা বর্জ্যই সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্রকে গিলে খাচ্ছে। বিশেষ করে বর্জ্যের কারণে মাটিতে বিষক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এতে মাটির বন্ধন তৈরি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সৈকতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া সৈকতের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তৈরি হতে পারছে না বর্জ্যের কারণে। রোরি মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘মাটিতে প্লাস্টিক মিশে যাওয়ার কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে ভয়াবহ মাটি দূষণের ঘটনা ঘটতে পারে। এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে পানিতেও। আবার এই দ্বীপে ভেসে আসা প্লাস্টিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে ফের সাগরে মিশে যেতে পারে। আর এইভাবে মাটি ও পানি দূষণের কারণে কোনো কোনো প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার তৈরির কারখানাটি মাটি দূষণের কারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ২০২০ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের কলাতলী থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সৈকতজুড়ে দুই দফায় বর্জ্য-বন্যা দেখা দেয়। ওইসময় নানা বর্জ্যের সঙ্গে মরা কচ্ছপ, সাপসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসে সৈকতে। জেলা প্রশাসনের বিচকর্মী এবং স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর কর্মীরা সৈকত থেকে সেই বর্জ্য পরিষ্কার করলেও সোনাদিয়া দ্বীপের বর্জ্য পরিষ্কারে কারো কোনো টেনশন দেখা যায়নি। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কিংবা পরিবেশবাদী কোনো সংগঠনের তৎপরতা চোখে পড়েনি। সোনাদিয়ার মাঝেরভিটা এলাকার বাসিন্দা আমানউল্লাহ বলেন, ‘সাগর থেকে ভেসে আসা ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো পরিষ্কারের জন্য সোনাদিয়ায় কোনো সংস্থা কাজ করে না। ধীরে ধীরে সেই বর্জ্য টুকরো টুকরো হয়ে সৈকতের মাটিতেই মিশে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন কেটে ও সৈকতের সাগরলতা বন ধ্বংস করে প্রভাবশালীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও দখলবাজিতে মেতে রয়েছেন। তবে তাদের কাছে বর্জ্য পরিষ্কার করার কোনো লোক নেই।’ কক্সবাজার শহর ও মহেশখালী দ্বীপের মাঝখানে প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের জমি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গড়ে উঠেছে সোনাদিয়া দ্বীপ। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার চওড়া একটি চ্যানেল দ্বারা এই দ্বীপটি বিভক্ত। কক্সবাজার শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপটি ‘স্বর্ণ দ্বীপ’ নামেও পরিচিত। কথিত রয়েছে, এখানে একসময় স্বর্ণ পাওয়া যেতো। ভূ-তাত্ত্বিক জরীপে এখানকার বালিতে মোনাজাইটসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। বিশ্বে বিরল প্রজাতির চামচ ঠুঁটো বাটান পাখিসহ বৈচিত্র্যময় পশু-পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণীর আবাস হিসাবে চিহ্নিত সোনাদিয়া দ্বীপ। তবে গত বছর থেকে এই দ্বীপে অনেক পাখির দেখা মিলছে না বলে জানান স্থানীয়রা। মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘সোনাদিয়ায় পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়ার হারও আশংকাজনক হারে কমে গেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ এ দ্বীপে বছরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত ডিম পাড়তো। আর গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজারের কম। তাছাড়া চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ডিম পাড়তে আসেনি কোনো কচ্ছপ।’ সমুদ্রবিজ্ঞানী বেলাল হায়দার মনে করেন, ‘প্রায় ৩ যুগের ব্যবধানে সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য নব্বই ভাগের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর বিভিন্ন প্রাণীর ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্র ধ্বংস করার কারণেই সোনাদিয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে এখনও সোনাদিয়াকে রক্ষা করা এবং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বর্জ্যের ভাগাড় সোনাদিয়া দ্বীপ

আপডেট সময় : ০১:০৭:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২২

কক্সবাজার সংবাদদাতা : স্তূপ আকারে জমে থাকা বর্জ্য সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্রকে গিলে খাচ্ছে। কক্সবাজার শহর থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়া। জীববৈচিত্রে ভরপুর সোনাদিয়া এখন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্যের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এই দ্বীপের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য। সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম অংশ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার। এই সৈকতের উচ্চ জোয়ার প্লাবিত অঞ্চল জুড়ে শুধুই খালি বোতল, ভাঙা বোতল, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, ব্যাগ, জাল ও মেডিক্যাল বর্জ্যসহ জৈব-অজৈব নানা ধরনের বর্জ্যের স্তূপ। সামুদ্রিক জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সোনাদিয়া দ্বীপে প্রায়ই নানা ধরনের বর্জ্য ভেসে আসলেও গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর জলোচ্ছ্বাসে টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য আচঁড়ে পড়েছে এই দ্বীপে। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের
(বোরি) পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, স্তূপ আকারে জমে থাকা বর্জ্যই সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্রকে গিলে খাচ্ছে। বিশেষ করে বর্জ্যের কারণে মাটিতে বিষক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। এতে মাটির বন্ধন তৈরি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এবং সৈকতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া সৈকতের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তৈরি হতে পারছে না বর্জ্যের কারণে। রোরি মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘মাটিতে প্লাস্টিক মিশে যাওয়ার কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে ভয়াবহ মাটি দূষণের ঘটনা ঘটতে পারে। এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে পানিতেও। আবার এই দ্বীপে ভেসে আসা প্লাস্টিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে ফের সাগরে মিশে যেতে পারে। আর এইভাবে মাটি ও পানি দূষণের কারণে কোনো কোনো প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার তৈরির কারখানাটি মাটি দূষণের কারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ২০২০ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের কলাতলী থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সৈকতজুড়ে দুই দফায় বর্জ্য-বন্যা দেখা দেয়। ওইসময় নানা বর্জ্যের সঙ্গে মরা কচ্ছপ, সাপসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসে সৈকতে। জেলা প্রশাসনের বিচকর্মী এবং স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর কর্মীরা সৈকত থেকে সেই বর্জ্য পরিষ্কার করলেও সোনাদিয়া দ্বীপের বর্জ্য পরিষ্কারে কারো কোনো টেনশন দেখা যায়নি। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কিংবা পরিবেশবাদী কোনো সংগঠনের তৎপরতা চোখে পড়েনি। সোনাদিয়ার মাঝেরভিটা এলাকার বাসিন্দা আমানউল্লাহ বলেন, ‘সাগর থেকে ভেসে আসা ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো পরিষ্কারের জন্য সোনাদিয়ায় কোনো সংস্থা কাজ করে না। ধীরে ধীরে সেই বর্জ্য টুকরো টুকরো হয়ে সৈকতের মাটিতেই মিশে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন কেটে ও সৈকতের সাগরলতা বন ধ্বংস করে প্রভাবশালীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও দখলবাজিতে মেতে রয়েছেন। তবে তাদের কাছে বর্জ্য পরিষ্কার করার কোনো লোক নেই।’ কক্সবাজার শহর ও মহেশখালী দ্বীপের মাঝখানে প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের জমি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গড়ে উঠেছে সোনাদিয়া দ্বীপ। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার চওড়া একটি চ্যানেল দ্বারা এই দ্বীপটি বিভক্ত। কক্সবাজার শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপটি ‘স্বর্ণ দ্বীপ’ নামেও পরিচিত। কথিত রয়েছে, এখানে একসময় স্বর্ণ পাওয়া যেতো। ভূ-তাত্ত্বিক জরীপে এখানকার বালিতে মোনাজাইটসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। বিশ্বে বিরল প্রজাতির চামচ ঠুঁটো বাটান পাখিসহ বৈচিত্র্যময় পশু-পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণীর আবাস হিসাবে চিহ্নিত সোনাদিয়া দ্বীপ। তবে গত বছর থেকে এই দ্বীপে অনেক পাখির দেখা মিলছে না বলে জানান স্থানীয়রা। মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘সোনাদিয়ায় পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়ার হারও আশংকাজনক হারে কমে গেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক প্রজাতির কচ্ছপ এ দ্বীপে বছরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার পর্যন্ত ডিম পাড়তো। আর গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজারের কম। তাছাড়া চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ডিম পাড়তে আসেনি কোনো কচ্ছপ।’ সমুদ্রবিজ্ঞানী বেলাল হায়দার মনে করেন, ‘প্রায় ৩ যুগের ব্যবধানে সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য নব্বই ভাগের বেশি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর বিভিন্ন প্রাণীর ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্র ধ্বংস করার কারণেই সোনাদিয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিলে এখনও সোনাদিয়াকে রক্ষা করা এবং আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’