ঢাকা ১১:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

বন্যা কতটা রাজনৈতিক কতটা প্রাকৃতিক?

  • আপডেট সময় : ১২:০৩:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৪
  • ১৯২ বার পড়া হয়েছে

ইমতিয়াজ মাহমুদ : প্রবল বন্যায় ডুবে গেছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোÑফেনী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়িতে বন্যার প্রকোপটা বেশি। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ফেনীতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে ওঠে। জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় উদ্ধারকর্মী বা ত্রাণকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবকরা পৌঁছাতে পারেনি।
বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণ জলে ডুবে আছে। তিন চারদিন ধরে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা ও দেশের বিচ্ছিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই ফেনীতে গিয়ে ভিড় করেছে, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই তাদের, পরিবারের সদস্যরা কোন অবস্থায় আছে, বেঁচে আছে কিনা সেটাও কেউ জানে না।
বাংলাদেশে মোট এগারোটি জেলায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। বন্যার উৎপত্তিটা যেহেতু ভারতের ত্রিপুরা থেকে হয়েছে এজন্যে ত্রিপুরার ভাটির জেলাগুলো, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ১৫ জন মানুষের মতো মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। বিস্তারিত জানা যাবে পানি নেমে যাওয়ার পর।
বন্যায় আক্রান্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও রাজ্যের কয়েকটি জেলা জলে ডুবে গেছে। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ত্রিপুরায় মৃতের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এরা উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদের সাথে যোগ দিয়েছে দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।
স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে বন্যা আক্রান্ত জায়গাগুলোয়। এছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাণ সংগ্রহ করে আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরা। জলে নিমগ্ন দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে নৌকা, স্পিডবোট ইত্যাদি নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং এই ধরনের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে অভ্যস্ত। এই ধরনের বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করে। সবসময় আমরা যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে নানা দলে বিভক্ত থাকি, ঝগড়াঝাঁটি করি, দেখা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সেইসব যেন মানুষ ভুলে যায়। এবারের বন্যায়ও তাই হয়েছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং সেই সাথে সমাজের সব অংশের মধ্যে একদিকে যেমন একটা দৃঢ় ঐক্যের তৈরি হয়েছে সেই সাথে আবার সদ্য সাবেক সরকারি দলের সমর্থক ও অন্যদের মধ্যে বৈরিতার বহিঃপ্রকাশও নানা জায়গায় নানাভাবে দেখা যাচ্ছে। বন্যার শুরুতেই সেসব বিরোধও যেন মানুষ ভুলে গেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার করার চেষ্টা করছে সবাই।
দুইটা কথা আলোচনায় এসেছে বন্যা শুরুর পর থেকেই। প্রথম কথাটি হচ্ছে যে এইরকম তীব্রতা নিয়ে বন্যা আমাদের দেশে এর আগে আর কখনো হয়েছে কিনা। আরেকটি কথা হচ্ছে, এই বন্যাটি কি ভারতের কারণে ঘটেছে?
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেককেই বলতে দেখা গেছে যে, ভারত বাংলাদেশকে না জানিয়ে বিনা নোটিশে ত্রিপুরার একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় আমাদের দেশে আকস্মিক এই বন্যাটা হয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পছন্দ করেন, ওদের কেউ কেউ একটু বাড়িয়ে গিয়ে বলতে চেষ্টা করেছেন যে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় ভারত বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশে মানুষের ওপর বন্যা লেলিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। একশ্রেণির মানুষ এইসব গুজব বা প্রোপাগান্ডা তৈরি করছে আবার আরেকশ্রেণির মানুষ গুজব বা প্রোপাগান্ডার বড় ভোক্তা হচ্ছে। আদতে তা ধোপে টিকছে না।
বন্যার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি হয়তো সবসময় এরকম হতো না, কিন্তু ফেনী, কুমিল্লা ও গোমতীর অববাহিকার অন্যান্য এলাকাগুলোয় বন্যা মাঝে মাঝেই হতো। কিছু কিছু এলাকায় বন্যা প্রায় প্রতিবছরই হতো, আর পাঁচ-সাতবছর পরপর বড় আকারে বন্যা হতো।
আমাদের দেশের শীর্ষ নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত আমাদের জানিয়েছেন যে, ৩০ বছর আগেও প্রায় প্রতিবছরই এখানে বন্যা হতো। পাঁচ-সাত বছর পরপর বড় আকারের বন্যা হতো। এ কারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। এখন বন্যা হয় না। কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে। এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল। চট্টগ্রাম-রাঙ্গুনিয়ায় আগে প্রতিবছরই বন্যা হতো, এখন হয় না। কারণ কাপ্তাই বাঁধ ওই পানি ধরে রাখে। ৩০ বছরেই আমরা কী করে ভুলে গেলাম যে প্রতিবছরই বন্যা হতো!
আইনুন নিশাত এই বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করার কোনো কারণ দেখেন না এবং বন্যার সাথে কোনো রাজনীতিও দেখতে পাচ্ছেন না। বন্যার শুরু হয়েছে উজানে অকস্মাৎ অতিবৃষ্টি থেকেÑএকটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে ত্রিপুরায় একদিনে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, গোটা আগস্ট মাস মিলেও এই সময়ের মতো এত পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা না। এই বিপুল জলের প্রবাহ আটকে রাখার কোনো উপায় ত্রিপুরার ছিল না। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ বা অন্য কোনো বাঁধেরই উপায় ছিল না জলের প্রবাহ ঠেকানোর।
আইনুন নিশাত সুস্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এই বন্যার সাথে তিনি কোনো রাজনীতি দেখতে পান না। ভারতের পক্ষ থেকেও ওদের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারÑদুই পক্ষ থেকেই স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে যে, ইচ্ছে করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের গেট খুলে দেওয়া নিয়ে যে কথাটা বলছেন কেউ কেউ সেই কথাটা সত্যি নয়।
ইচ্ছে করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যা হয়েছে বলে যারা বলছেন, ওদের কথাটা আসলেই ভুল। কেননা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের গেট খুলে দিলে যে পরিমাণ জল প্রবাহিত হবে তাতে ভাটিতে জলের প্রবাহ বাড়বে বটে, কিন্তু তার কারণে বন্যা হবে না। বন্যা হওয়ার মতো জল বাঁধের গেট দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না।
একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে, ভারতের ত্রিপুরা আমাদের উজানে, আর যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির কথা বিশেষভাবে বলা হচ্ছে সেই প্রকল্পটি ফেনীর ভারত-বাংলাদেশ সীমানা থেকে একশ বিশ মাইল দূরে। ফলে এই বন্যায় আমাদের মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আগে ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের মানুষ। স্পষ্টতই এই বন্যার মূল কারণ অকস্মাৎ অসময়ে অতিবৃষ্টি। এইরকম অতিবৃষ্টি যে এই সময়ে হবে সেটার সম্ভাবনার কথা আমাদের আবহাওয়া দপ্তরও জানতো।
ভারতে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে বলা হয়েছিল, এবার দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হবে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এবার বর্ষা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের এলাকাগুলোয় এবার বৃষ্টিও বেশি হবে। (প্রথম আলো, ০১ মে ২০২৪)
এই বন্যার জল হয়তো আগামী তিন চারদিনের মধ্যে নেমে যাবে, এর মধ্যে যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আশা করা যাচ্ছে যে, ২৫ আগস্ট ২০২৪-এর মধ্যেই পরিস্থিতি খানিকটা উন্নত হওয়া শুরু হবে। বন্যার জল নেমে গেলে শুরু করতে হয় পুনর্বাসন ও ত্রাণ কার্যক্রম, এইসব কর্মকাণ্ডে আমাদের দক্ষতা পরীক্ষিত।
ক্ষতি এর মধ্যে যা হয়েছে সেগুলো হয়তো আমরা একসময় সামলে নিতে পারব। কিন্তু এই প্রশ্নটা কাটার মতো আমাদের চিন্তায় দীর্ঘদিন রয়ে যাবে, ভারত কি আসলেই ইচ্ছে করে পানি ছেড়ে দিয়েছিল? আর ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, এই প্রশ্ন কোনো প্রকার যুক্তি তর্ক দিয়েই মুছে ফেলা যাবে না। এক শ্রেণির সুবিধাবাদীরা ক্ষণে ক্ষণে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকে দেবে।
যে কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে যে জায়গাটুকুর একটা অংশ নিয়ে আমাদের দেশ, এই অংশটুকুর উত্তরেও পাহাড় আর পূর্বেও পাহাড়। ঠিক বাংলাদেশ সীমানা পার হলেই পাহাড়। আর আমাদের দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এরকম নদী আছে ৫৪টা।
গোমতী নদী, এইরকম ৫৪টা নদীর মধ্যে একটা। কিছু কিছু নদী আছে যেগুলোর আবার উৎস চীনে। ব্রহ্মপুত্র নদের কথাই যদি ধরেন, তিব্বতের ছোট ছোট জলের ধারা মিলে তৈরি হয়েছে একটি ছোট নদী, সেই নদী অরুণাচল দিয়ে ভারতে প্রবেশে পর আসামের কাছাকাছি এসে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, সেই ব্রহ্মপুত্র এবং ব্রহ্মপুত্র থেকে আরও কয়েকটি ধারা আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এইসব নদীর দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা তাহলে কে করবে? চীন, ভারত না বাংলাদেশ?
এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আমাদের এখানে রাজনীতি যতটা হয় কাজ ততটা হয় না। ভারত বিরোধী আলাপ যতটা হয়, কাজের কথা ততটা হয় না। অথচ কথা ছিল যে, আমরা এইসব নদীর বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে নিজেদের প্রাপ্য ও করণীয় ঠিক করে নেব, সেই অনুযায়ী নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা হবে। এরকম আন্তর্জাতিক নদী যৌথভাবে ব্যবস্থাপনার উদাহরণ যে পৃথিবীতে আর নেই তাও কিন্তু নয়। ইউরোপের রাইন নদী (জযরহব জরাবৎ) বেশ কয়েকটা দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই নদীর ব্যবস্থাপনা করার জন্যে ওদের আছে যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি, যে কমিটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হলেও কাজ করে স্বাধীনভাবে।
কোনো রাষ্ট্র যদি তার নিজের অংশের নদীর উপর বা নদীর আশেপাশে কোনো স্থাপনা বা কোনো উন্নয়ন করতে চাইলে সেটা অনুমোদন করবে সেই কমিটি। আমাদের দেশের নদীগুলোর সাথে রাইন নদীর মতো এইরকম অনেক রাষ্ট্র জড়িত নয়।
আমাদের মূল সমস্যা দুই দেশের মধ্যে, ভারত ও বাংলাদেশÑকোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো চীনও যুক্ত হতে পারে। আমাদের নদীগুলোর এইরকম একটা সাধারণ যৌথ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী কাঠামো বাস্তবায়ন করতে না পারলে এইসব তর্ক আমরা করতে থাকবো বছরের পর বছর ধরে, আর তিক্ততা ছড়াবো দুই দেশের ভাতৃপ্রতিম মানুষের মধ্যে।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

‘ক্ষমতায় থাকতে’ ইউনূস মৌলবাদীদের ‘একখানে করেছেন’: গয়েশ্বর

বন্যা কতটা রাজনৈতিক কতটা প্রাকৃতিক?

আপডেট সময় : ১২:০৩:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৪

ইমতিয়াজ মাহমুদ : প্রবল বন্যায় ডুবে গেছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোÑফেনী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়িতে বন্যার প্রকোপটা বেশি। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ফেনীতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে ওঠে। জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় উদ্ধারকর্মী বা ত্রাণকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবকরা পৌঁছাতে পারেনি।
বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণ জলে ডুবে আছে। তিন চারদিন ধরে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা ও দেশের বিচ্ছিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই ফেনীতে গিয়ে ভিড় করেছে, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই তাদের, পরিবারের সদস্যরা কোন অবস্থায় আছে, বেঁচে আছে কিনা সেটাও কেউ জানে না।
বাংলাদেশে মোট এগারোটি জেলায় প্রায় পঁয়তাল্লিশ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। বন্যার উৎপত্তিটা যেহেতু ভারতের ত্রিপুরা থেকে হয়েছে এজন্যে ত্রিপুরার ভাটির জেলাগুলো, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ১৫ জন মানুষের মতো মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। বিস্তারিত জানা যাবে পানি নেমে যাওয়ার পর।
বন্যায় আক্রান্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও রাজ্যের কয়েকটি জেলা জলে ডুবে গেছে। ২৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ত্রিপুরায় মৃতের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এরা উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদের সাথে যোগ দিয়েছে দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীরা।
স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে বন্যা আক্রান্ত জায়গাগুলোয়। এছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাণ সংগ্রহ করে আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরা। জলে নিমগ্ন দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে নৌকা, স্পিডবোট ইত্যাদি নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং এই ধরনের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে অভ্যস্ত। এই ধরনের বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করে। সবসময় আমরা যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে নানা দলে বিভক্ত থাকি, ঝগড়াঝাঁটি করি, দেখা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সেইসব যেন মানুষ ভুলে যায়। এবারের বন্যায়ও তাই হয়েছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং সেই সাথে সমাজের সব অংশের মধ্যে একদিকে যেমন একটা দৃঢ় ঐক্যের তৈরি হয়েছে সেই সাথে আবার সদ্য সাবেক সরকারি দলের সমর্থক ও অন্যদের মধ্যে বৈরিতার বহিঃপ্রকাশও নানা জায়গায় নানাভাবে দেখা যাচ্ছে। বন্যার শুরুতেই সেসব বিরোধও যেন মানুষ ভুলে গেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার করার চেষ্টা করছে সবাই।
দুইটা কথা আলোচনায় এসেছে বন্যা শুরুর পর থেকেই। প্রথম কথাটি হচ্ছে যে এইরকম তীব্রতা নিয়ে বন্যা আমাদের দেশে এর আগে আর কখনো হয়েছে কিনা। আরেকটি কথা হচ্ছে, এই বন্যাটি কি ভারতের কারণে ঘটেছে?
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেককেই বলতে দেখা গেছে যে, ভারত বাংলাদেশকে না জানিয়ে বিনা নোটিশে ত্রিপুরার একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় আমাদের দেশে আকস্মিক এই বন্যাটা হয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পছন্দ করেন, ওদের কেউ কেউ একটু বাড়িয়ে গিয়ে বলতে চেষ্টা করেছেন যে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় ভারত বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশে মানুষের ওপর বন্যা লেলিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। একশ্রেণির মানুষ এইসব গুজব বা প্রোপাগান্ডা তৈরি করছে আবার আরেকশ্রেণির মানুষ গুজব বা প্রোপাগান্ডার বড় ভোক্তা হচ্ছে। আদতে তা ধোপে টিকছে না।
বন্যার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি হয়তো সবসময় এরকম হতো না, কিন্তু ফেনী, কুমিল্লা ও গোমতীর অববাহিকার অন্যান্য এলাকাগুলোয় বন্যা মাঝে মাঝেই হতো। কিছু কিছু এলাকায় বন্যা প্রায় প্রতিবছরই হতো, আর পাঁচ-সাতবছর পরপর বড় আকারে বন্যা হতো।
আমাদের দেশের শীর্ষ নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত আমাদের জানিয়েছেন যে, ৩০ বছর আগেও প্রায় প্রতিবছরই এখানে বন্যা হতো। পাঁচ-সাত বছর পরপর বড় আকারের বন্যা হতো। এ কারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। এখন বন্যা হয় না। কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে। এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল। চট্টগ্রাম-রাঙ্গুনিয়ায় আগে প্রতিবছরই বন্যা হতো, এখন হয় না। কারণ কাপ্তাই বাঁধ ওই পানি ধরে রাখে। ৩০ বছরেই আমরা কী করে ভুলে গেলাম যে প্রতিবছরই বন্যা হতো!
আইনুন নিশাত এই বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করার কোনো কারণ দেখেন না এবং বন্যার সাথে কোনো রাজনীতিও দেখতে পাচ্ছেন না। বন্যার শুরু হয়েছে উজানে অকস্মাৎ অতিবৃষ্টি থেকেÑএকটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে ত্রিপুরায় একদিনে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, গোটা আগস্ট মাস মিলেও এই সময়ের মতো এত পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা না। এই বিপুল জলের প্রবাহ আটকে রাখার কোনো উপায় ত্রিপুরার ছিল না। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ বা অন্য কোনো বাঁধেরই উপায় ছিল না জলের প্রবাহ ঠেকানোর।
আইনুন নিশাত সুস্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এই বন্যার সাথে তিনি কোনো রাজনীতি দেখতে পান না। ভারতের পক্ষ থেকেও ওদের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারÑদুই পক্ষ থেকেই স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে যে, ইচ্ছে করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের গেট খুলে দেওয়া নিয়ে যে কথাটা বলছেন কেউ কেউ সেই কথাটা সত্যি নয়।
ইচ্ছে করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যা হয়েছে বলে যারা বলছেন, ওদের কথাটা আসলেই ভুল। কেননা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের গেট খুলে দিলে যে পরিমাণ জল প্রবাহিত হবে তাতে ভাটিতে জলের প্রবাহ বাড়বে বটে, কিন্তু তার কারণে বন্যা হবে না। বন্যা হওয়ার মতো জল বাঁধের গেট দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না।
একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে, ভারতের ত্রিপুরা আমাদের উজানে, আর যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির কথা বিশেষভাবে বলা হচ্ছে সেই প্রকল্পটি ফেনীর ভারত-বাংলাদেশ সীমানা থেকে একশ বিশ মাইল দূরে। ফলে এই বন্যায় আমাদের মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আগে ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের মানুষ। স্পষ্টতই এই বন্যার মূল কারণ অকস্মাৎ অসময়ে অতিবৃষ্টি। এইরকম অতিবৃষ্টি যে এই সময়ে হবে সেটার সম্ভাবনার কথা আমাদের আবহাওয়া দপ্তরও জানতো।
ভারতে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে বলা হয়েছিল, এবার দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হবে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এবার বর্ষা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের এলাকাগুলোয় এবার বৃষ্টিও বেশি হবে। (প্রথম আলো, ০১ মে ২০২৪)
এই বন্যার জল হয়তো আগামী তিন চারদিনের মধ্যে নেমে যাবে, এর মধ্যে যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আশা করা যাচ্ছে যে, ২৫ আগস্ট ২০২৪-এর মধ্যেই পরিস্থিতি খানিকটা উন্নত হওয়া শুরু হবে। বন্যার জল নেমে গেলে শুরু করতে হয় পুনর্বাসন ও ত্রাণ কার্যক্রম, এইসব কর্মকাণ্ডে আমাদের দক্ষতা পরীক্ষিত।
ক্ষতি এর মধ্যে যা হয়েছে সেগুলো হয়তো আমরা একসময় সামলে নিতে পারব। কিন্তু এই প্রশ্নটা কাটার মতো আমাদের চিন্তায় দীর্ঘদিন রয়ে যাবে, ভারত কি আসলেই ইচ্ছে করে পানি ছেড়ে দিয়েছিল? আর ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, এই প্রশ্ন কোনো প্রকার যুক্তি তর্ক দিয়েই মুছে ফেলা যাবে না। এক শ্রেণির সুবিধাবাদীরা ক্ষণে ক্ষণে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকে দেবে।
যে কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে যে জায়গাটুকুর একটা অংশ নিয়ে আমাদের দেশ, এই অংশটুকুর উত্তরেও পাহাড় আর পূর্বেও পাহাড়। ঠিক বাংলাদেশ সীমানা পার হলেই পাহাড়। আর আমাদের দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এরকম নদী আছে ৫৪টা।
গোমতী নদী, এইরকম ৫৪টা নদীর মধ্যে একটা। কিছু কিছু নদী আছে যেগুলোর আবার উৎস চীনে। ব্রহ্মপুত্র নদের কথাই যদি ধরেন, তিব্বতের ছোট ছোট জলের ধারা মিলে তৈরি হয়েছে একটি ছোট নদী, সেই নদী অরুণাচল দিয়ে ভারতে প্রবেশে পর আসামের কাছাকাছি এসে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, সেই ব্রহ্মপুত্র এবং ব্রহ্মপুত্র থেকে আরও কয়েকটি ধারা আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এইসব নদীর দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা তাহলে কে করবে? চীন, ভারত না বাংলাদেশ?
এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আমাদের এখানে রাজনীতি যতটা হয় কাজ ততটা হয় না। ভারত বিরোধী আলাপ যতটা হয়, কাজের কথা ততটা হয় না। অথচ কথা ছিল যে, আমরা এইসব নদীর বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে নিজেদের প্রাপ্য ও করণীয় ঠিক করে নেব, সেই অনুযায়ী নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা হবে। এরকম আন্তর্জাতিক নদী যৌথভাবে ব্যবস্থাপনার উদাহরণ যে পৃথিবীতে আর নেই তাও কিন্তু নয়। ইউরোপের রাইন নদী (জযরহব জরাবৎ) বেশ কয়েকটা দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই নদীর ব্যবস্থাপনা করার জন্যে ওদের আছে যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি, যে কমিটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হলেও কাজ করে স্বাধীনভাবে।
কোনো রাষ্ট্র যদি তার নিজের অংশের নদীর উপর বা নদীর আশেপাশে কোনো স্থাপনা বা কোনো উন্নয়ন করতে চাইলে সেটা অনুমোদন করবে সেই কমিটি। আমাদের দেশের নদীগুলোর সাথে রাইন নদীর মতো এইরকম অনেক রাষ্ট্র জড়িত নয়।
আমাদের মূল সমস্যা দুই দেশের মধ্যে, ভারত ও বাংলাদেশÑকোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো চীনও যুক্ত হতে পারে। আমাদের নদীগুলোর এইরকম একটা সাধারণ যৌথ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী কাঠামো বাস্তবায়ন করতে না পারলে এইসব তর্ক আমরা করতে থাকবো বছরের পর বছর ধরে, আর তিক্ততা ছড়াবো দুই দেশের ভাতৃপ্রতিম মানুষের মধ্যে।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট