ঢাকা ০১:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বন্যায় ভাসে মানুষের স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ, সমাধান কী?

  • আপডেট সময় : ০৫:২৬:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
  • ৩৪ বার পড়া হয়েছে
  • সমীরণ বিশ্বাস

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নেমে আসে বন্যার ভয়াবহতা। বন্যার পানিতে শুধু ঘরবাড়ি নয়, ভেসে যায় মানুষের জীবন, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ!
এ যেন এক নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি। বছর, বছর একই দৃশ্য। তবে নেই কোনো প্রস্তুতি বা টেকসই সমাধান। প্রতিবারই আমরা প্রস্তুত হই। প্রতিবারই হাজার পরিবার সব হারিয়ে ফেলে।

ত্রাণ নয়, পরিত্রাণ চাই। এটা কি শুধু কথা আর শ্লোগানেই থেমে থাকবে? চলতি বছরেও বর্ষার শুরুতেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অতিবৃষ্টি, নদী ভাঙন এবং বন্যার ঝুঁকি। এখনো অনেক অঞ্চলে উপযুক্ত বাঁধ নেই, নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা দুর্যোগপূর্ণ প্রস্তুতি।

কখনো নদীর পানি উপচে পড়ে, কখনো পাহাড়ি ঢল বা অতিবৃষ্টির কারণে নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় মুহূর্তেই। ফলে বারবারই ভেসে যায় সাধারণ মানুষের স্বপ্ন।

প্রশ্ন জাগে, এই সমস্যার টেকসই সমাধান কী? বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নিয়মিত ও আকস্মিক বন্যার ফলে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল, পশুসম্পদ ও জীবন, স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের নিম্নআয়ের মানুষ পর্যন্ত, সব শ্রেণির মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশেষ করে নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারানো মানুষগুলো বারবার গৃহহীন হয়, তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন বারবার পানিতে ভেসে যায়।

প্রকৃতপক্ষে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং খাল-বিল দখলের ফলে বন্যার প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকা এবং দুর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে এই সমস্যার কোনো অমীমাংসিত সমাধান নেই। টেকসই ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নদী ড্রেজিং, বাঁধ উন্নয়ন, সঠিক বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থা, জলাধার সংরক্ষণ, গ্রামীণ অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যা মোকাবিলার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব।

ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার সতর্কবার্তা: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। ৮ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝারি থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফেনী ও কুমিল্লায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতির প্রবল আশঙ্কা। এছাড়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা শেরপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ এবং সিলেটে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে বসবাসরত জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

বন্যার প্রকৃতি ও প্রভাব: বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি এমন যে এখানে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। তিন দিক দিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের পানি নেমে এসে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে। একদিকে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, অন্যদিকে হিমালয়ের বরফ গলে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রতি বছরই বন্যার কবলে পড়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল। এতে চাষাবাদ নষ্ট হয়, খাদ্য ঘাটতি তৈরি হয়, মানুষের ঘরছাড়া হওয়া, শিশুদের শিক্ষার ক্ষতি এবং নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে।

প্রতিবারই কেন ভেসে যায় স্বপ্ন: বন্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো; আমরা এখনো বন্যা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান নিতে পারিনি। প্রতিবছর কিছু ত্রাণ, সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র, আর মিডিয়ার দৃষ্টি, এর বাইরে কার্যকর কিছু হয় না। ফলে মানুষ একই সংকটে বারবার পড়ে। কৃষকের ধান গাছ ডুবে গেলে তার সারা বছরের শ্রম বৃথা যায়, দিনমজুর কাজ হারায়, গৃহিণী গরু-ছাগল হারিয়ে ফেলে, শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে না। এভাবে বন্যা শুধু জমি বা বাড়ি নয়, মানুষের আশা-ভরসাও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

টেকসই সমাধানের দিকনির্দেশনা: ১. বন্যা পূর্বাভাস ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা: আধুনিক প্রযুক্তি (অও এবং ওড়ঞ) ব্যবহার করে বন্যা পূর্বাভাস আরো নিখুঁত করা যায়। কৃষক বা সাধারণ মানুষ যদি আগেভাগে জানতে পারে যে বন্যা আসছে, তবে তারা ফসল কেটে ফেলতে পারে, গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরাতে পারে।

২. উঁচু মঞ্চ ও আশ্রয়কেন্দ্র: বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোয় উঁচু জমিতে ঘর বানানো, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। বিশেষত গবাদি পশুর জন্য আলাদা আশ্রয় ব্যবস্থা থাকা দরকার।

৩. নদী খনন ও পানি নিষ্কাশন: অনেক নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, যার ফলে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারে না। নদী খনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ বন্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

৪. টেকসই কৃষি ব্যবস্থা: বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভাসমান বাগান, উচ্চফলনশীল ও জল-সহনশীল ফসল চাষ, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ ইত্যাদি টেকসই কৃষির অংশ হতে পারে।

৫. নিরাপদ বাসস্থান ও পুনর্বাসন নীতি: যারা প্রতিবছরই ঘর হারায়, তাদের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসন জরুরি। সরকারি সহায়তায় উঁচু জমিতে বাড়ি, জলরোধী নির্মাণ সামগ্রী এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা উচিত।

বন্যার অর্থনৈতিক সংকট ও চ্যালেঞ্জসমূহ: ৬. সচেতনতা ও স্থানীয় উদ্যোগ: গ্রাম পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল, নারী নেতৃত্বে বন্যা ব্যবস্থাপনা, বিদ্যালয়ে বন্যা প্রস্তুতি বিষয়ক পাঠ, এসব সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর।

বন্যা হয়তো পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, যদি আমরা পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। বারবার ত্রাণ নয়-আমরা চাই টেকসই সমাধান। কারণ, প্রতিবার শুধু ঘর নয়, ভেসে যায় জীবন গড়ার স্বপ্ন।

এই স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত বন্যা ব্যবস্থাপনা। এই পটভূমিতে এখন প্রয়োজন সবার সমন্বিত উদ্যোগ, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, গবেষক, কৃষক ও নাগরিক সমাজকে একসাথে কাজ করে বন্যা প্রবণ এলাকাগুলো আরো সহনশীল ও টেকসই করে গড়ে তোলা। তাহলেই বন্যা আর স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক না হয়ে বরং সুপরিকল্পিত অভিযোজনের মাধ্যমে উন্নয়নের একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উদাহরণ হবে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

এবার ‘কাকতাড়ুয়া দহন’ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন কারিগরির শিক্ষার্থীরা

বন্যায় ভাসে মানুষের স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ, সমাধান কী?

আপডেট সময় : ০৫:২৬:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
  • সমীরণ বিশ্বাস

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নেমে আসে বন্যার ভয়াবহতা। বন্যার পানিতে শুধু ঘরবাড়ি নয়, ভেসে যায় মানুষের জীবন, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ!
এ যেন এক নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি। বছর, বছর একই দৃশ্য। তবে নেই কোনো প্রস্তুতি বা টেকসই সমাধান। প্রতিবারই আমরা প্রস্তুত হই। প্রতিবারই হাজার পরিবার সব হারিয়ে ফেলে।

ত্রাণ নয়, পরিত্রাণ চাই। এটা কি শুধু কথা আর শ্লোগানেই থেমে থাকবে? চলতি বছরেও বর্ষার শুরুতেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অতিবৃষ্টি, নদী ভাঙন এবং বন্যার ঝুঁকি। এখনো অনেক অঞ্চলে উপযুক্ত বাঁধ নেই, নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা দুর্যোগপূর্ণ প্রস্তুতি।

কখনো নদীর পানি উপচে পড়ে, কখনো পাহাড়ি ঢল বা অতিবৃষ্টির কারণে নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় মুহূর্তেই। ফলে বারবারই ভেসে যায় সাধারণ মানুষের স্বপ্ন।

প্রশ্ন জাগে, এই সমস্যার টেকসই সমাধান কী? বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নিয়মিত ও আকস্মিক বন্যার ফলে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল, পশুসম্পদ ও জীবন, স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের নিম্নআয়ের মানুষ পর্যন্ত, সব শ্রেণির মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশেষ করে নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারানো মানুষগুলো বারবার গৃহহীন হয়, তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন বারবার পানিতে ভেসে যায়।

প্রকৃতপক্ষে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং খাল-বিল দখলের ফলে বন্যার প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকা এবং দুর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে এই সমস্যার কোনো অমীমাংসিত সমাধান নেই। টেকসই ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, নদী ড্রেজিং, বাঁধ উন্নয়ন, সঠিক বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থা, জলাধার সংরক্ষণ, গ্রামীণ অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যা মোকাবিলার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব।

ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার সতর্কবার্তা: দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। ৮ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝারি থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফেনী ও কুমিল্লায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতির প্রবল আশঙ্কা। এছাড়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা শেরপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ এবং সিলেটে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে বসবাসরত জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

বন্যার প্রকৃতি ও প্রভাব: বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি এমন যে এখানে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। তিন দিক দিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের পানি নেমে এসে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে। একদিকে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, অন্যদিকে হিমালয়ের বরফ গলে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রতি বছরই বন্যার কবলে পড়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল। এতে চাষাবাদ নষ্ট হয়, খাদ্য ঘাটতি তৈরি হয়, মানুষের ঘরছাড়া হওয়া, শিশুদের শিক্ষার ক্ষতি এবং নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে।

প্রতিবারই কেন ভেসে যায় স্বপ্ন: বন্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো; আমরা এখনো বন্যা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান নিতে পারিনি। প্রতিবছর কিছু ত্রাণ, সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র, আর মিডিয়ার দৃষ্টি, এর বাইরে কার্যকর কিছু হয় না। ফলে মানুষ একই সংকটে বারবার পড়ে। কৃষকের ধান গাছ ডুবে গেলে তার সারা বছরের শ্রম বৃথা যায়, দিনমজুর কাজ হারায়, গৃহিণী গরু-ছাগল হারিয়ে ফেলে, শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে না। এভাবে বন্যা শুধু জমি বা বাড়ি নয়, মানুষের আশা-ভরসাও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

টেকসই সমাধানের দিকনির্দেশনা: ১. বন্যা পূর্বাভাস ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা: আধুনিক প্রযুক্তি (অও এবং ওড়ঞ) ব্যবহার করে বন্যা পূর্বাভাস আরো নিখুঁত করা যায়। কৃষক বা সাধারণ মানুষ যদি আগেভাগে জানতে পারে যে বন্যা আসছে, তবে তারা ফসল কেটে ফেলতে পারে, গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে সরাতে পারে।

২. উঁচু মঞ্চ ও আশ্রয়কেন্দ্র: বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোয় উঁচু জমিতে ঘর বানানো, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। বিশেষত গবাদি পশুর জন্য আলাদা আশ্রয় ব্যবস্থা থাকা দরকার।

৩. নদী খনন ও পানি নিষ্কাশন: অনেক নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, যার ফলে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারে না। নদী খনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ বন্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

৪. টেকসই কৃষি ব্যবস্থা: বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভাসমান বাগান, উচ্চফলনশীল ও জল-সহনশীল ফসল চাষ, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ ইত্যাদি টেকসই কৃষির অংশ হতে পারে।

৫. নিরাপদ বাসস্থান ও পুনর্বাসন নীতি: যারা প্রতিবছরই ঘর হারায়, তাদের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসন জরুরি। সরকারি সহায়তায় উঁচু জমিতে বাড়ি, জলরোধী নির্মাণ সামগ্রী এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা উচিত।

বন্যার অর্থনৈতিক সংকট ও চ্যালেঞ্জসমূহ: ৬. সচেতনতা ও স্থানীয় উদ্যোগ: গ্রাম পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল, নারী নেতৃত্বে বন্যা ব্যবস্থাপনা, বিদ্যালয়ে বন্যা প্রস্তুতি বিষয়ক পাঠ, এসব সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর।

বন্যা হয়তো পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, যদি আমরা পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। বারবার ত্রাণ নয়-আমরা চাই টেকসই সমাধান। কারণ, প্রতিবার শুধু ঘর নয়, ভেসে যায় জীবন গড়ার স্বপ্ন।

এই স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত বন্যা ব্যবস্থাপনা। এই পটভূমিতে এখন প্রয়োজন সবার সমন্বিত উদ্যোগ, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, গবেষক, কৃষক ও নাগরিক সমাজকে একসাথে কাজ করে বন্যা প্রবণ এলাকাগুলো আরো সহনশীল ও টেকসই করে গড়ে তোলা। তাহলেই বন্যা আর স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক না হয়ে বরং সুপরিকল্পিত অভিযোজনের মাধ্যমে উন্নয়নের একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উদাহরণ হবে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ