নিজস্ব প্রতিবেদক : ভারতের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বার্তা দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, “আমরা সকলে বন্ধুত্ব চাই, সহযোগিতা চাই।”
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠা দলটির নেতা গতকাল বুধবার দুপুরে গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় আলোচনায় উঠে ভারত প্রসঙ্গও। তুমুল গণ-আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। তবে ৫ আগস্ট থেকে জামায়াত প্রকাশ্যে চলে আসে। তারা সেদিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করে, ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথেও উপস্থিল ছিল দলটির প্রতিনিধিরা। নিষিদ্ধ হওয়ার ২৮ দিনের মাথায় সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়ে যায় গতকাল বুধবার, একই দিন দলটির আমির এই মত বিনিময়ের আয়োজন করেন। ভারত প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন বলেন, ‘‘আমরা কেউ বিপদে পড়তে চাই না। আমরা চাই সকলেই সকলের সম্মানিত প্রতিবেশী হিসেবে বাস করুক। এটা শুধু ভারত দিয়ে কথা নয়ৃ সকলের ক্ষেত্রে আমাদের একই কথা।”
‘‘বন্ধু হিসেবে আমাদের সাহায্য করুন, কিন্তু মেহেরবানি করে কেউ আমাদেরকে বাধ্য করার চেষ্টা করবেন না। ডিসিশনটা আমাদের জনগণকে নিতে দিন। জনগণ যখন ডিসিশন নেবে তখন সেই ডিসিশন জনকল্যাণমূলক হবে, এটাই হবে গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের অধিকারের পক্ষে। কিন্তু অন্য জায়গা থেকে যদি আমাদেরকে বাধ্য করার চেষ্টা করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। জামায়াতের আমির বলেন, “আপনার স্বভাব বদলান তাহলে প্রতিবেশী বদলানোর দরকার পড়বে না। প্রতিবেশীকে প্রতিবেশী হিসেবে আপনি রিসিভ করুন, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন।
“আপনি যখন কাউকে সম্মান করবেন, ভালোবাসবেন, আপনার পাওনা হয়ে যাবে তার থেকে ভালোবাসা পাওয়া, সম্মান পাওয়া। এজন্য ধৈর্য ধরতে হবে, অস্থির হওয়ার কিছু নেই।” গুলশানের হোটেল লেকশোরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক, প্রধান নির্বাহী, বার্তা সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদকদের সঙ্গে এই মতবিনিময় হয়। নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, মানব জমিনের নির্বাহী সম্পাদক শামীমুল হক, এটিএন বাংলার পরিচালক (বার্তা) হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, বাংলা ভিশনের প্রধান সম্পাদক আবদুল হাই সিদ্দিক, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, সাংবাদিক নেতা আবদুল হাই শিকদার, এমএ আজিজ, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু এই মত বিনিময়ে ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
রাজাকার শব্দে কষ্ট লাগে: মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে রাজাকার, আলবদর বাহিনী গড়ে তুলে গণহত্যায় সহযোগিতা করা জামায়াতের আমির বলেন, “আমার খুব ব্যথা লাগে যখন একদল বলে ‘পাকিস্তানি রাজাকার’, আরেক দল বলে ‘হিন্দুস্থানি রাজাকার’ৃ খুব কষ্ট লাগে। “আমার দেশের জনগণকে আরেক দেশের দালাল বানাচ্ছি, রাজাকার বানাচ্ছিৃ কেন এটা করছি?” এটা যারা করে তাদের ‘মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে জাতি নিজের নাগরিকের স্বীকৃতিই দেয় না সেই জাতি বিশ্বের দরবারে সম্মানটা পাবে কীভাবে? আপনাদের মত আমারও কিছু কিছু দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেই দেশের লোকেরা তাদের ভাষার বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় নাৃ ইন্টারন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ দুই একটা আছে সেটা তারা জানে কিন্তু বলে না। তাদের জাতীয়তাবাদ এতটাই দৃঢ়। আমরা দেখি যে, জাতীয় জীবনে কোনো মুহূর্ত আসলে তারা এক হয়ে যায়।”
গণহারে মামলায় শতবার চিন্তার পরামর্শ: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক হত্যা মামলায় দল ও শরিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদেরকে আসামি করার বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন জামায়াত আমির। তিনি বলেন, ‘‘গণহারে একটা হত্যা মামলায় পাঁচশ জনকে আসামি করা হয়-এটা কতটুকু যৌক্তিক এটা শতবার চিন্তা করা উচিত। তবে এর আড়ালে কিন্তু মূল ব্যক্তিটির বেঁচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। “আমরা বলেছি, আমরা সবার চাইতে মজলুম বেশি-এত মামলার প্রয়োজন নেই। সিম্বলিক কিছু মামলাই মানুষের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট। “কিন্তু সেই মামলায় একজনও নিরপরাধ মানুষ যাতে অভিযুক্ত না হয় সে ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে। ১০ জন ঠিক আছে, একজন বেঠিক। এই একজনের ওপরে যদি জুলুম হয়ৃআমরা জুলুম করতে চাই না। তারপরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো ভুল হয়ে যায়, আপনাদের কাছে ধরা পড়ে আমাদেরকে বলে দেবেন আমরা সংশোধিত হবৃকথা দিচ্ছি।”
প্রতিহিংসা নয়: জামায়াত দেশ থেকে হিংসা-বিভক্তি রাজনীতির অবসান চায় বলেও মন্তব্য করেন শফিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘‘আমরা হিংসা রাজনীতির কবর চাইৃ. এটা আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠুক, আমরা বিভক্তি রাজনীতির কবর চাইৃ এটাও মাথাচাড়া দিয়ে না উঠুক। “কোনো বিষয়ে আমরা জাতির বিভক্তি চাই না। সকল ক্ষেত্রে আমরা চাই, জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকুক।”
রাজনৈতিক দল হিসেবে কারো কোনো ক্ষোভ নেই মন্তব্য করে জামায়াতের আমির বলেন, “আমরা সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু যিনি সুনির্দিষ্ট ক্রাইম করেছেন, তার ওই নির্দিষ্ট ক্রাইমের বিচার যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে সমাজ সংশোধন হবে না। ৃ তা অন্য রকম হয়ে যাবে, বেপরোয়া হয়ে যাবে। এজন্য এটা ন্যায্যতা দাবি, ন্যায় বিচারের দাবি, সভ্যতার দাবি, সামাজিকতার দাবি, শান্তির দাবি।” জামায়াত ‘মজলুম’ দাবি করে শফিকুর বলেন, “ভবিষ্যতে আমরা যখন সুযোগ পাব, আমরাই যাতে আবার আরেক জনের ওপর জুলুম না করি সেটা আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।” ধর্মীয় ভিত্তিতে কাউকে কিছু করতে দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার যদি এ দেশে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার থাকে তাহলে অন্য সকল ধর্মের মানুষের একই অধিকার আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একটা শব্দ চালু আছে এটার মাধ্যমে সমাজটাকে বিভক্ত করা হয়েছে।”
জামায়াতের নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা মহানগরের দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি মতিউর রহমান আখন্দও মত বিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন।