ঢাকা ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে

  • আপডেট সময় : ১২:০৫:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অগাস্ট ২০২৪
  • ৪৮ বার পড়া হয়েছে

আলী রেজা : গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে সারা দেশে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তা শুধু বিজয়ের আনন্দ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক ও অরুচিকর কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখা গেছে। বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে হাসিনা সরকারের এ পতনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেও প্রচার করেছেন। একটি দেশের সরকারপতনকে সে দেশের স্বাধীনতা বলাটা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। নব্বইয়ে সর্বদলীয় গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। তাই বলে সেটাকে ভুলেও কেউ স্বাধীনতা বলেনি। একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একরারই অর্জিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অর্জিত হয়েছিল একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
৫ আগস্ট একটি দলীয় সরকারের পতন হয়েছে, যে দলটি বারবার সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতায় থেকে দলটিকে একটি বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী, দুর্বৃত্ত ও জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ধারাবাহিক নিপীড়ন ও প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে অপরাজনীতি সেটিও সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে সাধারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ছাত্রআন্দোলন এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ পেয়েছে।
একটি সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সে সরকারের পতন কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। অনেক দেশেই এ ধরনের গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হতে দেখা যায়। জুলাই-আগস্টের এ গণআন্দোলনকে অনেকে গণবিপ্লব বলে আখ্যায়িত করতে চান। কিন্তু বিপ্লবের নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য আলাদা। বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার যে মৌলিক পরিবর্তন হয় তার সঙ্গে এ আন্দোলনের তুলনা করা চলে না।

৫ আগস্টের পর দেশে কোনো বিপ্লবী দল বা সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। খুবই স্বাভাবিকভাবে একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বতী সরকারে যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। যাহোক, সরকার পতনের পর আন্দোলনকারীরা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা দিয়েছে। এখন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার যদি আশানুরূপ সংস্কার করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাহলেই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তা না হলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হতে সময় লাগবে না।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উঠেছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আছে সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে যে- তারাও বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার করতে চান। দিনবদলের প্রেক্ষিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করতে চান। কিন্তু এটা করতে হলে সর্বাগ্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে বদলাতে হবে। প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি আর দেখতে চায় না বাংলাদেশ। সরকার পতনের পর প্রতিহিংসামূলক আচরণ প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রেক্ষিতে সারা দেশে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সরকার পতনের পর যে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও জীবনহানির ঘটনা ঘটেছে; তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বিএনপি, জামায়াত ও সমন্বয়কারীদের নিষেধ সত্ত্বেও এসব ঘটেছে। পতিত সরকারের বিরুদ্ধে নানা বক্তৃতা-বিবৃতির ফলে দুষ্কৃতকারীরা অতি উৎসাহী হয়ে এসব করেছে। এতে পতিত সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে দেশের ও দেশের মানুষের। কর্তৃপক্ষ আরো দায়িত্বশীল হলে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড এত লাগামহীনভাবে চলতে পারতো না। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের দাবি অনুযায়ী যদি বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিদ্যমান অসংগতিগুলো বদলে ফেলতে হয় তাহলে বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।
বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশকে একটি আদর্শহীন জায়গায় নিয়ে গেছে। বদলা নিতে গিয়ে প্রতিটি পরবর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্ম অনুসরণ করেছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। সংসদীয় সরকার তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিরা ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লুটপাটের এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে চলে আসলেও একানব্বই পরবর্তী সময়ে তা নতুন মাত্রা লাভ করে।
দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটতে থাকে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত। সরকার পরিবর্তনের ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আরো বেড়ে চলে। পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করে তলে তলে নিজেরা আরো বেশি অপকর্ম করতে থাকে। এভাবে প্রতিটি সরকার দুর্নীতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সর্বশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা দেড় দশকের শাসনামলে দেখা গেল দুর্নীতি ও অর্থপাচারের এক ভয়াবহ চিত্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শেয়ার বাজারসহ একে একে প্রতিটি খাতের লাগামহীন দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়া শুরু হলো। ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ছাড়লো সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির শিল্পপতিরা।
এখন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মিাণ করতে হলে একদিকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সকল দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, অন্যদিকে নিজেদেরকেও দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। মানুষের মনে একটি আশঙ্কা এখন বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও নিজেদের আখের গোছাবে। মানুষের মনের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এজন্য ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসার প্রত্যাশা করেন তাদেরকে বদলে যেতে হবে। বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পরিবর্তন বা রদবদল যেন ভালো কিছু বয়ে আনে। এ বদল যেন বদলা নেওয়ার মানসিকতা থেকে না হয়। কোনো পক্ষের হুজুগে দাবির প্রেক্ষিতে সুযোগ্য ও নিরপেক্ষ কাউকে সরিয়ে দেওয়াটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন সে বিভক্তি দূর করা জরুরি। দীর্ঘদিন যাবৎ এদেশের নতুন প্রজন্ম যে জিনিসটি দেখে এসেছে তাহলো বুদ্ধিজীবী ও সমাজচিন্তকগণের মধ্যে একটি অংশ ইনিয়ে-বিনিয়ে সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে শুধু ভালো কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। একচোখা এ বুদ্ধিজীবীগণ নির্বিচারে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। সরকারকে সমর্থনের পুরস্কারস্বরূপ অনেকেই কাঙ্ক্ষিত পদ-পদবি পেয়েছেন। নিজের যোগ্যতাবলে অনেকে যে পদ-পদবি পাননি তাঁর প্রমাণ মেলে গণপদত্যাগের অবস্থা দেখে। দলীয়করণ কোন পর্যায়ে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রশাসনের সবাইকে নিয়ে একযোগে পদত্যাগ করতে পারেন? এই দলীয়করণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা বড়োই কঠিন। শেখ হাসিনার আমলে বঞ্চিতদের ঢালাওভাবে পুনর্বাসন করার মধ্যেও ঝুঁকি আছে। এটা করা হলে তারাও তাদের মতাদর্শভুক্তদের নিয়ে আর একটি নতুন ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করবে। শুধু পুনর্বাসন নয়, প্রতিহত করার ক্ষেত্রেও নির্বিচারী হওয়া ঠিক নয়। এমনভাবে বদলা নেওয়া বা দমন করা উচিত হবে না, যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এক ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে আর এক ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন অর্থহীন হয়ে যাবে।
বর্তমানে অন্তর্র্বতী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এ সরকার এক সময় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিবে। তাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকে জনবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। পতিত সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক নয়। একানব্বই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থেকেছে। দু’দলই দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। নির্লজ্জ দলীয়করণ করেছে। সাধারণ মানুষ এদের কাউকেই পছন্দ করে না। কিন্তু উপযুক্ত বিকল্প না থাকার কারণে এরাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে। আন্দোলনকারীদের চাপে কিংবা অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশে যাঁরা পদত্যাগ করছেন কিংবা অপসারিত হচ্ছেন তারা সবাই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। একটি বড়ো অংশের ক্ষেত্রে একথা সত্য হলেও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ থাকতে পারেন। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আবার এসব পদে যাঁদেরকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বা হবে তাঁরাও যেন সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ হন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় বিবেচনায় একজনকে অপসারণ করে সেই একই দলীয় বিবেচনায় আর একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ দশা হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের মহান চিন্তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। যারা মনে করেন, এতদিন বঞ্চিত ছিলাম, এখন সবকিছু দখল করবো- তাদের দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। যারা মনে করেন, এতদিন নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছি, এখন সবকিছুর বদলা নেব- তাদের দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। যারা বদলা নেওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করে জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে নিজেকেই বদলে নিতে পারবে- ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তাদের কাছেই নিরাপদ থাকবে।
লেখক: কলামিস্ট, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফর: গুরুত্ব পাবে দক্ষ কর্মী পাঠানো ও বিনিয়োগ

বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে

আপডেট সময় : ১২:০৫:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অগাস্ট ২০২৪

আলী রেজা : গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে সারা দেশে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তা শুধু বিজয়ের আনন্দ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক ও অরুচিকর কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখা গেছে। বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে হাসিনা সরকারের এ পতনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেও প্রচার করেছেন। একটি দেশের সরকারপতনকে সে দেশের স্বাধীনতা বলাটা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। নব্বইয়ে সর্বদলীয় গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। তাই বলে সেটাকে ভুলেও কেউ স্বাধীনতা বলেনি। একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একরারই অর্জিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অর্জিত হয়েছিল একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
৫ আগস্ট একটি দলীয় সরকারের পতন হয়েছে, যে দলটি বারবার সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতায় থেকে দলটিকে একটি বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী, দুর্বৃত্ত ও জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ধারাবাহিক নিপীড়ন ও প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে অপরাজনীতি সেটিও সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে সাধারণ ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ছাত্রআন্দোলন এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ পেয়েছে।
একটি সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সে সরকারের পতন কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। অনেক দেশেই এ ধরনের গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হতে দেখা যায়। জুলাই-আগস্টের এ গণআন্দোলনকে অনেকে গণবিপ্লব বলে আখ্যায়িত করতে চান। কিন্তু বিপ্লবের নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য আলাদা। বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার যে মৌলিক পরিবর্তন হয় তার সঙ্গে এ আন্দোলনের তুলনা করা চলে না।

৫ আগস্টের পর দেশে কোনো বিপ্লবী দল বা সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। খুবই স্বাভাবিকভাবে একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বতী সরকারে যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। যাহোক, সরকার পতনের পর আন্দোলনকারীরা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা দিয়েছে। এখন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার যদি আশানুরূপ সংস্কার করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাহলেই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তা না হলে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হতে সময় লাগবে না।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উঠেছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আছে সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে যে- তারাও বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার করতে চান। দিনবদলের প্রেক্ষিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করতে চান। কিন্তু এটা করতে হলে সর্বাগ্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে বদলাতে হবে। প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি আর দেখতে চায় না বাংলাদেশ। সরকার পতনের পর প্রতিহিংসামূলক আচরণ প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রেক্ষিতে সারা দেশে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সরকার পতনের পর যে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও জীবনহানির ঘটনা ঘটেছে; তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বিএনপি, জামায়াত ও সমন্বয়কারীদের নিষেধ সত্ত্বেও এসব ঘটেছে। পতিত সরকারের বিরুদ্ধে নানা বক্তৃতা-বিবৃতির ফলে দুষ্কৃতকারীরা অতি উৎসাহী হয়ে এসব করেছে। এতে পতিত সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে দেশের ও দেশের মানুষের। কর্তৃপক্ষ আরো দায়িত্বশীল হলে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড এত লাগামহীনভাবে চলতে পারতো না। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের দাবি অনুযায়ী যদি বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিদ্যমান অসংগতিগুলো বদলে ফেলতে হয় তাহলে বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।
বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশকে একটি আদর্শহীন জায়গায় নিয়ে গেছে। বদলা নিতে গিয়ে প্রতিটি পরবর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্ম অনুসরণ করেছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। সংসদীয় সরকার তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিরা ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লুটপাটের এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে চলে আসলেও একানব্বই পরবর্তী সময়ে তা নতুন মাত্রা লাভ করে।
দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটতে থাকে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত। সরকার পরিবর্তনের ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আরো বেড়ে চলে। পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করে তলে তলে নিজেরা আরো বেশি অপকর্ম করতে থাকে। এভাবে প্রতিটি সরকার দুর্নীতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সর্বশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা দেড় দশকের শাসনামলে দেখা গেল দুর্নীতি ও অর্থপাচারের এক ভয়াবহ চিত্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শেয়ার বাজারসহ একে একে প্রতিটি খাতের লাগামহীন দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়া শুরু হলো। ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ছাড়লো সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির শিল্পপতিরা।
এখন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মিাণ করতে হলে একদিকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সকল দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, অন্যদিকে নিজেদেরকেও দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। মানুষের মনে একটি আশঙ্কা এখন বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও নিজেদের আখের গোছাবে। মানুষের মনের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এজন্য ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসার প্রত্যাশা করেন তাদেরকে বদলে যেতে হবে। বদলা নেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পরিবর্তন বা রদবদল যেন ভালো কিছু বয়ে আনে। এ বদল যেন বদলা নেওয়ার মানসিকতা থেকে না হয়। কোনো পক্ষের হুজুগে দাবির প্রেক্ষিতে সুযোগ্য ও নিরপেক্ষ কাউকে সরিয়ে দেওয়াটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন সে বিভক্তি দূর করা জরুরি। দীর্ঘদিন যাবৎ এদেশের নতুন প্রজন্ম যে জিনিসটি দেখে এসেছে তাহলো বুদ্ধিজীবী ও সমাজচিন্তকগণের মধ্যে একটি অংশ ইনিয়ে-বিনিয়ে সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে শুধু ভালো কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। একচোখা এ বুদ্ধিজীবীগণ নির্বিচারে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। সরকারকে সমর্থনের পুরস্কারস্বরূপ অনেকেই কাঙ্ক্ষিত পদ-পদবি পেয়েছেন। নিজের যোগ্যতাবলে অনেকে যে পদ-পদবি পাননি তাঁর প্রমাণ মেলে গণপদত্যাগের অবস্থা দেখে। দলীয়করণ কোন পর্যায়ে গেলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রশাসনের সবাইকে নিয়ে একযোগে পদত্যাগ করতে পারেন? এই দলীয়করণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা বড়োই কঠিন। শেখ হাসিনার আমলে বঞ্চিতদের ঢালাওভাবে পুনর্বাসন করার মধ্যেও ঝুঁকি আছে। এটা করা হলে তারাও তাদের মতাদর্শভুক্তদের নিয়ে আর একটি নতুন ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করবে। শুধু পুনর্বাসন নয়, প্রতিহত করার ক্ষেত্রেও নির্বিচারী হওয়া ঠিক নয়। এমনভাবে বদলা নেওয়া বা দমন করা উচিত হবে না, যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এক ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে আর এক ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন অর্থহীন হয়ে যাবে।
বর্তমানে অন্তর্র্বতী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এ সরকার এক সময় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিবে। তাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকে জনবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। পতিত সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক নয়। একানব্বই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থেকেছে। দু’দলই দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। নির্লজ্জ দলীয়করণ করেছে। সাধারণ মানুষ এদের কাউকেই পছন্দ করে না। কিন্তু উপযুক্ত বিকল্প না থাকার কারণে এরাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে। আন্দোলনকারীদের চাপে কিংবা অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশে যাঁরা পদত্যাগ করছেন কিংবা অপসারিত হচ্ছেন তারা সবাই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। একটি বড়ো অংশের ক্ষেত্রে একথা সত্য হলেও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ থাকতে পারেন। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আবার এসব পদে যাঁদেরকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বা হবে তাঁরাও যেন সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ হন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় বিবেচনায় একজনকে অপসারণ করে সেই একই দলীয় বিবেচনায় আর একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ দশা হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের মহান চিন্তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। যারা মনে করেন, এতদিন বঞ্চিত ছিলাম, এখন সবকিছু দখল করবো- তাদের দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। যারা মনে করেন, এতদিন নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছি, এখন সবকিছুর বদলা নেব- তাদের দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। যারা বদলা নেওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করে জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে নিজেকেই বদলে নিতে পারবে- ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তাদের কাছেই নিরাপদ থাকবে।
লেখক: কলামিস্ট, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়