প্রত্যাশা ডেস্ক গত মঙ্গলবার ভোরের আগেও যে রঙিন কাপড়গুলো মোড়ানো ছিল স্বচ্ছ পলিব্যাগে, আজ সেই সব কাপড়ের রঙ একটাই, কালো। পরশু ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে যে বাজার ছিল জমজমাট আজ সেখানে ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার। নতুন কাপড়ের গন্ধের বদলে আজ সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ। বঙ্গবাজারের পাশপাশি ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের সাততলা এনেক্সকো টাওয়ারে। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও টাওয়ারের ৫ম তলা থেকে শুরু করে ওপরের তলাগুলোতে পানি ছিটাতে হচ্ছে। ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম তলা থেকে একের পর এক বস্তা ফেলা হচ্ছে নিচে। অগ্নিকা-ের পর অবশিষ্ট থাকা কাপড়সহ যেসব মালামাল রয়েছে সেগুলো বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির চেনা আবহের মধ্যেও অপরিচিত এক বঙ্গবাজার যেন দাঁড়িয়ে আছে; তার বুকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পাশেই থাকা ফায়ার সার্ভিস। পরে প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর থেকে পুরো বঙ্গবাজার এলাকার দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেছে।
বঙ্গবাজার মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটে কুলির কাজ করতেন আক্কাস আলী নামে একজন। তিনি বলেন, এখন ঈদের বাজার, এই সময় এসব মার্কেটে মানুষে গমগম করত। সারা দেশ থেকে বিক্রেতারা পাইকারি মাল নিতে আসত। খুচরা বিক্রিসহ বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা থাকত এসব মার্কেটে। সব দোকানে কাস্টমারদের ভিড় লেগে থাকত, আমরা তাদের মালামাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এনে দিতাম। কিন্তু আজ সব থেমে আছে, চারদিক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্রেতা বিক্রেতার কোনো ব্যস্ততা নেই। আমরাও আজ বেকার, সবার ক্ষতি। এনেক্সকো টাওয়ারের পাশেই অস্থায়ী চায়ের দোকান ছিল সাহাবুদ্দিন মিয়ার। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা লেগে থাকত। কিন্তু আজ সব পুড়ে গেছে, কিছুই নেই, নেওয়ার মতো আর কিছু নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার কারও ব্যস্ততাও নেই। আগুনে সব শেষ করে দিয়েছে এখানকার সবার। ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া আর কিছু নেই, ব্যবসায়ীরা পথে বসে গেছে। আগুনে বঙ্গবাজারসহ আশপাশের ৬টি মার্কেটের ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।
এনেক্সকো টাওয়ারে থেমে থেমে আগুন ও ধোঁয়া: রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সসংলগ্ন এনেক্সকো টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সে এখনো থেমে থেমে আগুন ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। সেখানে আগুন পুরোপুরি নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের সদস্যরা। সর্বশেষ বুধবার বেলা সোয়া চারটার দিকে এ চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির পঞ্চম থেকে সপ্তম তলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর কাজ করছেন। মার্কেটের ওই তিনটি তলায় মূলত কাপড়চোপড় রাখা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওই তিনটি তলায় বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো আগুনও জ্বলে উঠছে। আর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তা পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন।
মঙ্গলবার ভোর থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টার আগুনে পুড়ে গেছে ঢাকায় পোশাকের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারগুলোর অন্যতম বঙ্গবাজারের সব দোকান। এ সময় বঙ্গবাজারসংলগ্ন এই এনেক্সকো টাওয়ারসহ আশপাশের ভবনগুলোতেও আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও তা পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হননি। বুধবার সকালে এনেক্সকো টাওয়ারের কয়েকটি তলায় থেমে থেমে ধোঁয়া বের হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তা নেভাতে কাজ শুরু করেন। ওই মার্কেটের যেসব দোকানের পণ্য আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে, সেগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুন নেভানোর চেষ্টার মধ্যেই সকাল থেকে তাঁরা এ কাজ করছেন। শ্রমিকদের দিয়ে বস্তাভর্তি বিভিন্ন বস্ত্রপণ্য ও কম্বল ওপর থেকে নিচে ফেলা হচ্ছে। নিচে থাকা কর্মীরা সেগুলো ভ্যান কিংবা ট্রাকে করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছেন। এই তৎপরতা চলার মধ্যেই বেলা একটার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজারের পাশের বহুতল এনেক্সকো টাওয়ার ভবনে এখনো আগুন ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। আগুন নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস সেখানে কাজ করছে। ভবনের পাঁচ থেকে সাততলা পর্যন্ত গুদামে কাপড়চোপড় রয়েছে। অগ্নিনির্বাপণের কাজে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ভারী যন্ত্র (লেডার) এনেক্সকো টাওয়ারের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের রাস্তায় রাখা ছিল। এর মধ্যে পশ্চিম পাশের লেডার যুক্ত ছিল মার্কেটটির পঞ্চম তলার সঙ্গে। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এখনো কাজ করছেন। তবে আগুন নিভে গেছে। আংশিক পোড়া মালপত্র সরাতে গিয়ে কোনো কোনো জায়গায় ধোঁয়া বের হচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকান ও গুদামের সংখ্যা আজ বৃহস্পতিবার বলা যাবে।
যে যা পারছে নিয়ে যাচ্ছে: কথায় আছে ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’। এই প্রবাদ বাক্যের বাস্তব চিত্র যেন ফুটে উঠেছে বঙ্গবাজারে। সেখানে কাঠের মার্কেট পুড়ে ছাই। এরপরও ব্যবসায়ীরা এসেছেন কোনোকিছু অবশিষ্ট আছে কিনা দেখতে। তবে এই সুযোগে সেখানে ঢুকে পড়েছে সুযোগসন্ধানীরা। তারা জিনিসপত্র যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নিয়ে যাচ্ছে। কেউ এসে দেখলে মনে করবে এখানে হরিলুট চলছে।
বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে ওই পোড়া মার্কেটের সামনে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। পুলিশের চোখের সামনেই এসব কাজ করছে বিভিন্ন লোকজন। কেউ মাথায় করে, হাতে করে, কাঁধে করে, ভ্যানে করে যেভাবে পারছে ঠিক সেভাবে মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সব পণ্য তাদের নিজের না অন্য কারও, তার কোনও জবাবদিহি নেই। ধ্বংসস্তূপে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিলো এক শিশু। এগুলো নিয়ে কী করবে জানতে চাইলে সে বলে, বেচে দেবো।
এমনই একজন জসিম মিয়া। মালামালগুলো কার, এভাবে নিয়ে যাচ্ছেন কেন, কোথায় নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, আমি একা নিচ্ছি না। সবাই নিচ্ছে, তাই আমিও নিচ্ছি। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ভুক্তভোগী সালমা বেগম বলেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে যা দেখলাম এ বিষয়ে আর কী বলবো। দেখতেই তো পারছেন অনেকে এসে জিনিসপত্র খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবাজারের ওই স্পটে নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা পুলিশ কর্মকর্তা চকবাজার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশানার শাহিনুর যিয়াদ বলেন, মালামাল নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যাদেরই জিজ্ঞেস করেছি তারাই বলছে এখানে তার দোকানে রয়েছে। এজন্য সেভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। যাদের মালামাল তারাও নিচ্ছে। এদের ফাঁকে অন্যজনরাও নিচ্ছে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে বোঝা মুশকিল প্রকৃত মালিক কে।
বঙ্গবাজারে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর হাহাকার
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ