ফারুক আফিনদী :বিশ্বের কোনো জাতির মধ্যে কোনো ভাষার মাস নেই। বাংলা ও বাঙালির কাছে এ বিশেষ মাস আসে বছর বছর বিশেষ একটা আবেগ নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে, অহংকার নিয়ে। ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির অনুশীলন, সর্বোপরি বিকাশের মাধ্যম। আমাদের এই ভাষার মাস, মানে ফেব্রুয়ারি অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে অস্তিত্বের মাসও। আমরা যে ডিসেম্বরকে চিনি এর মাতৃমাস হচ্ছে এই ফেব্রুয়ারি, যার ভেতরে রয়েছে অনন্য ঐতিহাসিকতা, ৮ ফাল্গুন। এই ফাল্গুনের কথা যখন আসে, তখন আমাদের ঐতিহ্যের কথা আসে, আনন্দের কথা আসে, ভালোবাসার কথা আসে- দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর ও ফুলের সৌরভের মতো। ফেব্রুয়ারিতে একই সঙ্গে আসে ভাষার গৌরব ও ফাগুনের ফুলের সৌরভ। ফেব্রুয়ারি তাই অনন্য।
কিন্তু এই যে এত কথা, বন্দনা, এর মানে কী? আমাদের ভাষা বা অহংকারের মাসটি এলে কী ঘটে মনে? ঘটে। ফেব্রুয়ারি এলেই বাঙালি মন একটু ভিজে ওঠে। না কোনো কান্নায় নয়, বিশেষ ভালোবাসার আবেগে। মননশীল মানুষের কাছে যেন বইবই একটা গন্ধ ভেসে আসে। আর বই মানে বই-ই, কাগজে ছাপা বই। ভাষার মাসের মূল আবেগ অমর একুশকে ঘিরে এ মাসে চলে মাসব্যাপী বইমেলা- আমাদের প্রাণের জরুরি মেলা।
প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হলেও এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৫ দিন পিছিয়ে মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে। চলবে অর্ধমাসজুড়ে। কিন্তু বই নিয়ে যে মেলা, আমাদের মধ্যে সেই বইয়ের অবস্থান এখন ঠিক কোথায় আছে?
আর অবশ্যই বই মানে মুদ্রিত যে বই। সে বই কত জন কিনছি, কী পরিমাণে কিনছি কত টাকা খরচ করছি বইয়ের পেছনে? এর পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই হতাশাজনক হবে।
আপনি প্রশ্ন করবেন, ‘আমরা কি ক্রমশ বইবিমুখ হয়ে পড়ছি’? ‘বই পাঠের প্রতি আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে আমাদের’? এর জবাব সরাসরি না দিলেও পাওয়া দুষ্কর নয়। শুধু এটুকু বললেই চলবে যে সারা বিশ্বে এখন স্মার্টফোনের দাপট বেড়ে গেছে। এর মানে ‘বই থেকে সরে আসছে অনেকেই’।
আমাদের তো একটা অতীত ছিল, বই পড়ার অতীত। রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ার অভ্যাস ছিল অনেক পরিবারেই। এখন অনেকটাই অতীত সেটা। রাতে বই পড়ার চেয়ে ওয়েব সিরিজ দেখার নেশায় মত্ত সবাই। এই যে স্মার্টফোন দখলে নিয়ে নিয়েছে আমাদের নেশা, মত্ততা- এর পরোক্ষ তথ্য হচ্ছে ‘বই নির্বাসিত প্রায়’।
বই পড়লে কী হয়- এমন প্রশ্ন যদি কেউ করে, কেউ হয়তো বিস্মিত হবেন। কিন্তু এর যে জবাব সেটা ভুলে যাবেননা যেন। হয়তো ‘বই মননকে শানিত করে, জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়’- এমন বিশ্বাস কাজেই আসছে না আর।
কিন্তু যদি বলা হয়, শরীর সুস্থ রাখতেও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে- তাহলে কী করবেন? চিকিৎসকরাও যে উড়িয়ে দিচ্ছেননা বইকে। বরং জোরই দিচ্ছেন বিষয়টির ওপর। বলছেন, বই পড়ার সময় আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে, যার প্রভাবে একাধিক রোগ-ব্যাধি দূর হয়। ঠিক কী কী ঘটে বই পড়ে? এটাও প্রশ্ন বটে। মানব জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিশক্তি। সেই স্মৃতিশক্তি বাড়তে পারে বইপাঠে। বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সেই অংশটি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়। তাই বই পড়লে মনে রাখার ক্ষমতা অনেকটাই বাড়ে।
আধুনিক জীবনাচারের কারণে ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন, এমন মানুষ খুঁজে কম মিলবেনা। রাতে ঘুম আসতে দেরি হয় কর্মজীবী অনেকেরই। বিশেষজ্ঞদের বিবেচনা, বই পড়ার সময় এমন কিছু হরমোনের ক্ষরণ হয়, যা ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে। তাই রাতে ভালো ঘুম ঘুমাতে কিছুক্ষণ বই পড়ে নিলে শান্তি মিলবে কিছুটা।
জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের বড় বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। বেশি কাজ, নানা জটিলতা- এসবের কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন অনেকেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বই হতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। মন এবং মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করবে বইপাঠ। কর্মক্ষেত্র বা ছাত্রজীবন-যেটাই হোক,পাঠ আমাদের ছাড়েনা। জীবনের উন্নতির জন্য মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করতে হয়, আর যারা বাস্তবতা বোঝেন, সেটাই করেন তারা। প্রতিদিন বই পড়লে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মনঃসংযোগের ক্ষমতারও উন্নতি ঘটে। আয়ু নিয়ে ভাবেন সব মানুষই। বেশি দিন বাঁচার ইচ্ছে নেই কার? ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’। বেশি দিন বাঁচতে অনেকেই স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে থাকেন। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে চলেন। আয়ু বাড়ানোর জন্য আর কী কী করেন আপনি? বই পড়েন? বই পড়লে আয়ু বাড়ে- শুনে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, আদৌ কী সম্ভব এটা? হ্যা, গবেষণায়ও এমনটা দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বই পড়েন তারা অন্যদের তুলনায় দীর্ঘজীবী হয়ে থাকেন। তবে, বই পড়তে গিয়ে সেই স্মার্টফোনেই ভরসা করবেন? না, সেটা করবেননা। এতে লক্ষ্যটাই ভেস্তে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এমন সতর্কতাই দিচ্ছেন। বলছেন, বই মানে কাগজে ছাপা বই-ই পড়তে হবে। মোবাইল বা ট্যাবের আলোকিত পর্দায় পড়লে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম।