- আলমগীর খান
এটি এ দেশের নয়, অন্যদেশের, এক কাল্পনিক ভিনদেশের গল্প-যে দেশে ফেল-করারাই শিক্ষাপ্রণেতা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করে মরা ছাড়া কোনো গতি আছে? কিন্তু আমাদের এ সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামল বাংলাদেশে ভিন্ন ব্যাপার। এখানে শুধু শিক্ষাপ্রণেতারাই নন, এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া সকলেই যেন মহাপ্রতিভা-শিক্ষা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা। কিন্তু ওই কাল্পনিক দেশের মতো এ দেশেও শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর আত্মহত্যা করে। না করে উপায় কী? এই মহাপ্রতিভারা তো পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই ফেল করিয়ে ছেড়েছেন। এইসব মহাপ্রতিভাধর শিক্ষাপ্রণেতাদের বাল্যকালের সব পরীক্ষায় অর্জিত সোনালি ফলও তাদেরকে বাংলাদেশের একটা শিক্ষাব্যবস্থা ভালোভাবে চালানোর পরীক্ষায় পাশ করাল না, সেটাই আশ্চর্যের!
কারণটা কি এই নয় যে, হরিপদ কাপালী এ প্লাস পাননি, কিন্তু হরিধান উদ্ভাবন করেছেন। আর সোনালি এ প্লাস পাওয়া-ওয়ালারা হরিধান দূরে থাক, বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে জীবনযাপনের বাইরে একটা নতুন কাউনের বিচিও উদ্ভাবন করতে পারেনি। অথচ এই দেশে এ প্লাস আর গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে কী উদ্ভট রুচিসম্পন্ন লাফালাফি হয়! ভালো রেজাল্ট বলতেই মিডিয়া অজ্ঞান। সাংবাদিকরা ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে ছুটে যায় ওই বিস্ময় বালক ও বালিকার দরোজায় যে বা যারা উচ্চ নম্বরে বিশ্বচমক দেখিয়েছে। একাধিক শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম আছে যারা এই বিশ্বচমকওয়ালাদের নিয়ে সবংর্ধনা-পুরস্কারসহ নানা আদিখ্যেতা শুরু করে দেয়। স্পষ্টতই ওইসব সংবাদমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরাও বাল্যজীবনে উচ্চ নম্বর পাওয়ার চমক দেখিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।
কিন্তু এই যে বিস্ময়বালকরা বাংলাদেশের সবকিছুতেই উচ্চস্থান দখল করে আছেন- ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আমলাগিরি, সংবাদবাণিজ্য, ভিসিগিরি কী নয়- বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তাদের ভূমিকা কী। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আমলেই বা তাদের ভূমিকা কী ছিল, কী ছিল তাদের ভূমিকা জূলাই গণঅভ্যুত্থানে? যারা বিগত সরকারের সঙ্গে আপসকামিতার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন ও যাদের নামে পত্রপত্রিকায় মুখরোচক সব সংবাদ বেরোয় তাদের বড় অংশটা তো বাল্যের সোনালি ফলধারী মহাপ্রতিভাই।
এসএসসি পরীক্ষায় আহামরি ফল অর্জন করায় যেসব সংবাদমাধ্যম, সমাজকর্তা ও অভিভাবক বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে এই নাচানাচি করেন, তারাই প্রকৃতপক্ষে এই ছেলেমেয়েগুলোকে চিরতরে নষ্ট করে দেন। তারা এই ছেলেমেয়েদের মনে ভালো রেজাল্ট নিয়ে এক অহমবোধ তৈরি করেন যা তাকে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য- মানুষ হওয়ার লক্ষ্য থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। জীবনে সর্বোচ্চ বৈদ্য, মিস্ত্রি, আমলা, ভিসি হওয়ার চেয়ে বড় কেনো স্বপ্নই তারা দেখতে শেখে না।
আমাদের ডাক্তার, প্রকৌশলী, আমলা, ভিসিদের চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল বিদ্যা, শাসনতন্ত্র, শিক্ষাবিজ্ঞান ইত্যাদিতে স্মরণীয় অবদান কী কী? নিজ পরিবারের জন্য একটা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জীবনযাপন নিশ্চিত করা অবশ্যই একটা সাফল্য, স্যালুট তাদের। কিন্তু তা নিয়ে পুরো জাতিকে নাচতে হবে কেন? অন্যদিকে যারা স্বপ্ন দেখে বা দেখতে পারে, রাষ্ট্রের অবজ্ঞার বুলডোজার দিয়ে তাদের স্বপ্নগুলো হয় মেরে ফেলা হয় বা তারা স্বপ্নের কঙ্কাল নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে। বাংলাদেশ স্বপ্নের, আবিষ্কারের ও উদ্ভাবনের দেশ নয়, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার দেশ।
আমাদের দেশে যেসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে সেগুলো হলো: দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌকা-লঞ্চডুবি, লম্বা ছুটির সময়ে দূরের যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, সাম্প্রতিক কালে বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতে- এরসঙ্গে যুক্ত হতে পারে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওযার পর আত্মহত্যা। অন্যান্য দুর্যোগের মতো এও এক দুর্যোগ যা জরুরি অবস্থা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য না হয় তালগাছ লাগানো যায়, এক্ষেত্রে করণীয় কী?
এবার যেসব টগবগে তাজাপ্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তাদের মধ্যে আছে ঢাকায় গেন্ডারিয়ার নাগমণি, নাটোরে বাগাতিপাড়ার জেসমিন, পিরোজপুরে নেছারাবাদের সুমাইয়া, হবিগঞ্জে নজরপুরের ফারজানা, বগুড়ায় শেরপুরের সুমাইয়া, ঠাকুরগাঁওয়ে বালিয়াডাঙ্গির মিতু, দিনাজপুরে নবাবগঞ্জের রিতা, কুমিল্লায় দাউদকান্দির শ্রাবন্তী, গাইবান্ধায় সদরের দিশা ও নুরপুরের লাবণ্য, কক্সবাজারে রুদ্রসহ আরো হয়তো অজানা কেউ কেউ। এটা কি পরীক্ষাব্যবস্থা না মৃত্যুপুরী? এ নিয়ে কোনো মনঃপীড়া আছে কি আমাদের শিক্ষাপ্রণেতাদের? তারা কি সম্পূর্ণ দায়হীন? পৃথিবীর কোন কোন সভ্য দেশে এমনতর ঘটে? যারা ঘটা করে গোল্ডেন ছেলেমেয়েদের সবংর্ধনা দেন, এ দায় কি তাদেরও নয়?
যারা সবংর্ধনা নেয় তারা কি এটুকু বোঝে না যে, এই ফলাফলের ১০০ মিটার দৌড়ে তাদের কৃতিত্ব সামান্যই, শুধু এটুকু ছাড়া যে তারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও সুবিধাভোগী পরিবারে জন্মেছে, ভালো স্কুলে পড়েছে, ভালো ফলাফলের জন্য স্বার্থপরের মতো পড়াশোনা করেছে, মাত্র ১০/১২টি পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোথাও তাকায়নি, সারাদিন কোচিং আর প্রাইভেট পড়ে অন্যের দেওয়া তথ্য মগজে ঢুকিয়েছে এবং ভালো খাওয়া-দাওয়া করেছে। এটুকু বোঝার ক্ষমতা যার বা যাদের নেই সেই তাদেরকেও মেধাবী বলতে হবে? অন্তত এটুকু বুঝলে ও স্বীকার করলেও না হয় মেধাবী বলা যেত- সক্রেটিসের ওই অনুধাবনের মতো: আমি অন্তত এটুকু জানি যে, আমি কিছুই জানি না।
নিশ্চয়ই সবংর্ধনা দেয়ার ও পুরস্কৃত করবার মতো অনেক ছেলেমেয়ে এই এ প্লাস বা গোল্ডেনওয়ালাদের মধ্যে আছে- যারা একবেলা পেট ভরে খেতে পায়নি, ভালো একটা কাপড় পরতে পারেনি, যার বা যাদের বাবা-মা দিনমজুর হিসেবে খেটে তাদের পড়ালেখা করিয়েছে, যে বা যারা সংসারের ভার বহন করেও আবার ভালো ফল করেছে, যারা ভালো ফল করেও কোথায় ভর্তি হবে ও পড়ালেখা চালাবে ওই নিশ্চয়তা নেই, যে বা যারা একটা নিতান্ত সাধারণ নাম-না-জানা স্কুলে পড়ালেখা করেছে- এমন শত শত ছেলেমেয়ে তো অবশ্যই বীর ও শ্রদ্ধার পাত্র। তারা নিশ্চয়ই সবংর্ধনার যোগ্য ও সার্বিক সহযোগিতা তাদের অধিকার। বাকিদের তো জীবনের আসল পর্ব অর্থাৎ কর্মজীবনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে সমাজ ও মানবতার পক্ষে ভালো, মঙ্গলময়, গৌরবজনক কিছু করে দেখাবার জন্য। এখন বোঝার সময় এসেছে সবাইকে নিয়ে মিথ্যা আদিখ্যেতা বহু মৃত্যুর, আত্মহত্যা চেষ্টার ও দীর্ঘ গ্লানিবোধের জন্য দায়ী।
প্রতিবছর ভালো ফল না করার জন্য যেসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, সেসব কি সত্যি আত্মহত্যা? নাকি তাদেরকে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয়া হয়, বাধ্য করা হয় আত্মহত্যা করতে? এবারও ভালো ফল না করায় এই যে কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা, তা থেকে ধরে নেয়া যায় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল আরো বহু শিক্ষার্থী, অর্থাৎ আত্মহত্যার কিনারা থেকে নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে অনেকে। এছাড়া অনেকে আত্মহত্যার কথা না ভেবে জীবনের এই গ্লানি বহন করে একটা সঙ্কুচিত জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা মেনে নিয়েছে। বহু অকৃতকার্যদের মনে ব্যর্থতার যন্ত্রণার করুণ পাহাড়। আসলেই কি তারা ব্যর্থ? নাকি শিক্ষাব্যবস্থা নামক এই মারাত্মক কলের মাঝে তারা খাপ খায়নি- যেখানে ব্যবস্থাটা যতখানি কড়াকড়ি শিক্ষা ততখানিই দুর্বল ও পানসে।
মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা জ্ঞানের ফেরিওয়ালা পলান সরকার বই বিলিয়ে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামে গ্রামে। অন্যদিকে আমাদের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া (বা একসময়কার সব বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করা) মহাপ্রতিভারা জ্ঞানকে লুকিয়ে ও পকেটস্থ করে মানুষকে জিম্মি করে, তথ্যহীনতার অন্ধকারে রেখে, ইংরেজি ভাষার মারপ্যাঁচ খাটিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর কেবল আধিপত্যই বিস্তার করে গেলেন ও নিরন্তর যাচ্ছেন। (ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বলছি) ভাগ্যিস, হরিপদ কাপালী ও পলান সরকাররা এই মহাশিক্ষাচোঙের মধ্যে ঢুকে নিজেদের সমস্ত সৃষ্টিশীলতাকে মাটি হতে দেননি।
আসুন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষাপদ্ধতি ও জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়াকে আনন্দময়, নিরাপদ, সৃষ্টিশীল ও মানবিক করে তুলি। এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মিত হোক- রক্তাক্ত ও নিহত নয়- পূর্ণতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠুক। আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরের মৃত্যুর কারণ না হয়ে তাদের প্রস্ফুটনের মাধ্যম হোক- সুবুদ্ধি হোক শিক্ষাপ্রণেতা, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরও।
লেখক: কলামিস্ট