নিজস্ব প্রতিবেদক : ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন ৩৫ বছরের ফারহানা সুলতানা। বাড়ি টাঙ্গাইল। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। টাঙ্গাইল থেকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে আসতে বলেন সেখানকার চিকিৎসকরা। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এলেও ফারহানা আইসিইউ পাননি, পরে মারা যান তিনি।
ফারহানার আত্মীয় গণমাধ্যমকর্মী রাজনীন ফারজানা বলেন, গত ৪ জুলাই টাঙ্গাইল থেকে ফারহানাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে আইসিইউ পাওয়া যায়নি, অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কোথাও আইসিইউ পাওয়া যায়নি, ৫ জুলাই ভোরে উনি মারা গেলেন।
রাজনীন বলেন, তার ভাইয়ের এক সহকর্মীর বন্ধুর স্ত্রী ছিলেন ফারহানা। এতো দূরের যোগাযোগ, কিন্তু একটু বাঁচার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর গর্ভবতী থাকায় পুরো বাসার যার যেখানে যোগাযোগ ছিল সবাই সবখানে চেষ্টা করেও একটা আইসিইউ বেড ম্যানেজ করতে পারিনি।
আর এই পরিবারের আসলে স্কয়ার বা ইউনাইটেড হাসপাতালে যাবার মতো সামর্থ ছিল না জানিয়ে রাজনীন বলেন, সব সরকারি হাসপাতাল অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, কুয়েত মৈত্রীতে খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু পাইনি। পরে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একটা বেড ফাঁকা ছিল। কিন্তু সেখানে নিতে নিতে ফারহানা মারা যান।
আইসিইউ পেতে নানা হাসপাতালে খোঁজ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ঢাকার ভেতরে আত্মীয় স্বজনরা ফোন করছেন, বন্ধুরা স্বজনদের একটা আইসিইউ পেতে নক করছেন, গ্রাম থেকে আত্মীয়স্বজনরা কল করছেন। কিন্তু ম্যানেজ করতে পারছি না।
এ দুই ঘটনা থেকেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) কতোটা সোনার হরিণ হয়ে উঠেছে সেটা বোঝা যায়। আর আইসিইউ সংকটের কথা স্বীকার করেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলে হাসপাতালের সাধারণ শয্যা এবং দ্রুত পূর্ণ হয়ে যেতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি, বলেন অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন। তিনি জানান, একইসঙ্গে আইসিইউ বেড যেগুলো রয়েছে সেগুলো খুব দ্রুত ফিল-আপ হয়ে যাচ্ছে। গত এক থেকে দুই সপ্তাহ আগেও সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেড খালি থাকলেও সেটা এখন আর খালি থাকছে না। একইসঙ্গে দ্রুত পূরণ হয়ে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেডের সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত ৫ জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড পাঁচ সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি ছিল না, আর ৭ জুলাইতে অধিদফতর জানায়, আটটিটি বড় সরকারি হাসপাতলের কোনোটির বেড খালি ছিল না। ৮ জুলাইতে জানায়, রাজধানী ঢাকায় ১৬টি সরকারি করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬ বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছে। এই ১৬টির মধ্যে আবার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হলেও সেখানে তাদের জন্য আইসিইউ নেই। সবমিলিয়ে এই ১৬ হাসপাতালের ৩৯৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৯৯টি বেড।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা রোগীদের শতকরা ৮০ শতাংশের মধ্যে মৃদু লক্ষণ দেখা দেয়। তাদের হাসপাতালে যেতে হয় না। ১৫ শতাংশের উপসর্গ তীব্র হয় ও হাসপাতালে যেতে হয়। ৫ শতাংশের অবস্থা হয় গুরুতর। তাদের আইসিইউর পাশাপাশি দরকার হয় ভেন্টিলেটরেরও। কিন্তু এবারে দেশে সামাজিক সংক্রমণ ঘটানো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আগের যে কোনও ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে শক্তিশালী। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছরের চেয়ে এবার আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারও বেড়েছে অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে।
গত ৭ জুলাই অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগী সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। লকডাউন বা বিধিনিষেধ অমান্য করার কারণে রোগীর সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলে আমরা আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবো। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন গত বছর। কিন্তু এক বছর পরেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতিপালন করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ জটিল রোগীদের যদি সঠিক সময়ে আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করা যেতো তাহলে একদিনে মৃত্যু ২০০ পার হতো না, মৃত্যুর এত রেকর্ড হতো না। কিছু না কিছু মৃত্যু কমতো, বলেন নজরুল ইসলাম। এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ শয্যার আইসিইউ খালি নেই জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, সব বেডেই রোগী ভর্তি থাকছে, যার কারণে অপেক্ষায় থাকতে হয় অন্যদের। কেবলমাত্র রোগীরা যদি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন অথবা কোনও মৃত্যু হলে সেই বেডটাই খালি হচ্ছে, তখন অন্য রোগীকে সে বেডে নেওয়া হচ্ছে।
তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিছুদিন আগে আগুনে পুড়ে যাওয়া ১৩ বেডের আইসিইউ ইউনিট পুনরায় আগামী ঈদের আগে চালু করা হচ্ছে। সেটা হলে বর্তমান ২০ বেডের সঙ্গে যোগ হবে আরও ১৩টি বেড। এই বেডগুলো ঈদের আগেই চালুর আশাবাদ ব্যক্ত করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, তখন এখনকার অবস্থার চেয়ে পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হবে, বাইরের রোগী নেওয়ার সুযোগ হবে।