ঢাকা ০৭:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার চলমান থাকবে

  • আপডেট সময় : ০১:০৬:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার রাতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন -ছবি রয়টার্স

প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এর পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা সমস্যা, যুদ্ধ-সংঘাতসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তরুণদের জন্য কীভাবে নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষা এবং পথ নিয়েও কথা বলেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটা) সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আবার শুরু হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেন এবং তা বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করে।

বৈশ্বিক এই ফোরামে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমি এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তা বলবো।

তাঁর সরকারকে বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কার কাজগুলো করা। কিন্তু আমরা বেছে নিই কঠিন পথ-অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ।’

১১টি সংস্কার কমিশন গঠন ও তাদের সুপারিশ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না। কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকেরা ভক্ষকে পরিণত হতে পারবে না।’

গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও সম্পদ ফিরিয়ে আনা: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনো কল্যাণও করে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করে তা আবিষ্কার করে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর করে ফেলেছিল।

পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমান সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার বলে জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হওয়া যাবে না।

যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এসব পাচার করা সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের এই অপরাধের শরিক না হওয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এই সম্পদ প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন। আমি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করছি।’

রোহিঙ্গা সংকট: প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটি শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না; বরং বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে।

গত আট বছরেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না এবং বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।

রাখাইনে সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকারবঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সমাধান এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। রাখাইনের সমস্যাগুলোর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করাও অপরিহার্য।

মিয়ানমারের সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা এবং বাংলাদেশ বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। বাংলাদেশ শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু তহবিল–সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার যৌথ প্রয়াসও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিলঘাটতির বিষয়ে ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে।

অধ্যাপক ইউনূস আরো বলেন, তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যমান দাতাদের সাহায্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।

গাজা পরিস্থিতি: গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার কথা উল্লেখ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শিশুরা না খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে একমত যে সবার চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে।

মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচার: বর্তমানে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। গত বছর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনো চলমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ‘ডিপফেক’–এর প্রসার। যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যাতে এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড মানুষের ওপর মানুষের আস্থাকে বিনষ্ট না করে এবং সামাজিক সম্প্রীতিকে দুর্বল না করে।  সৌজন্যে:অনলাইন ও টিভি মিডিয়া

সানা/আপ্র/২৭/০৯/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার চলমান থাকবে

আপডেট সময় : ০১:০৬:০৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এর পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা সমস্যা, যুদ্ধ-সংঘাতসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তরুণদের জন্য কীভাবে নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষা এবং পথ নিয়েও কথা বলেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটা) সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আবার শুরু হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেন এবং তা বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করে।

বৈশ্বিক এই ফোরামে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমি এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তা বলবো।

তাঁর সরকারকে বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কার কাজগুলো করা। কিন্তু আমরা বেছে নিই কঠিন পথ-অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ।’

১১টি সংস্কার কমিশন গঠন ও তাদের সুপারিশ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না। কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকেরা ভক্ষকে পরিণত হতে পারবে না।’

গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও সম্পদ ফিরিয়ে আনা: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনো কল্যাণও করে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করে তা আবিষ্কার করে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর করে ফেলেছিল।

পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমান সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার বলে জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হওয়া যাবে না।

যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এসব পাচার করা সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের এই অপরাধের শরিক না হওয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এই সম্পদ প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন। আমি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করছি।’

রোহিঙ্গা সংকট: প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটি শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না; বরং বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে।

গত আট বছরেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না এবং বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।

রাখাইনে সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকারবঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সমাধান এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। রাখাইনের সমস্যাগুলোর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করাও অপরিহার্য।

মিয়ানমারের সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা এবং বাংলাদেশ বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। বাংলাদেশ শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু তহবিল–সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার যৌথ প্রয়াসও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিলঘাটতির বিষয়ে ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে।

অধ্যাপক ইউনূস আরো বলেন, তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যমান দাতাদের সাহায্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।

গাজা পরিস্থিতি: গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার কথা উল্লেখ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শিশুরা না খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে একমত যে সবার চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে।

মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচার: বর্তমানে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। গত বছর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনো চলমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ‘ডিপফেক’–এর প্রসার। যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যাতে এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড মানুষের ওপর মানুষের আস্থাকে বিনষ্ট না করে এবং সামাজিক সম্প্রীতিকে দুর্বল না করে।  সৌজন্যে:অনলাইন ও টিভি মিডিয়া

সানা/আপ্র/২৭/০৯/২০২৫