নিজস্ব প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনের অন্যতম নেতা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানিয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে মুশতারী শফীর কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত সেখানে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
তার ছেলে মেহরাজ তাহসিন শফী সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, “আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখতে গিয়ে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আমরা বাবার আদর-স্নেহ পাইনি। মাকে আমরা একসঙ্গে বাবা এবং মা হিসেবে পেয়েছি। উনিই বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন, মায়ের দায়িত্ব পালন করে আমাদের সাতজনকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
“আমাদের আশা ছিল, তিনি স্বাধীনতা পদক পাবেন। কিন্তু আমরা এখনো জানি না, তিনি পাবেন কিনা”
মুশতারী শফীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে তার অসাধারণ ভূমিকা ছিল এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে তিনি যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, জাতি তা কৃতজ্ঞতার সাথে চিরকাল স্মরণ করবে।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনে মুশতারী শফীর ভূমিকা তুলে ধরে শাহরিয়ার কবির বলেন, “শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন আমরা একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি, বেগম মুশতারী শফী ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। চট্টগ্রামে তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন এবং ১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বে গোলাম আজমের সমাবেশ প্রতিহত করা হয়। বিভিন্ন আন্দোলনের সেই সক্রিয় নেত্রীকে আমরা হারিয়েছি।
“আজ আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছি। তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তা আমাদের তরুণ কর্মীদের অনুপ্রেরণা দেবে।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “তার (মুশতারী শফী) নিটক আত্মীয় স্বজনদের মৃত্যুর পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী সৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তিনি ধারণ করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ কেন্দ্রীয় কমিটি, উদীচী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতন্ত্রী পার্টি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ তাঁতীলীগ, গেরিলা ১৯৭১, গীতাঞ্জলি, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, নাট্যযোদ্ধা, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী, রক্তধারা’৭১, গৌরব’৭১, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সমাজতাত্ত্বিক ছাত্র ফ্রন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে থেকে মুশতারী শফীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে মুশতারী শফীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত তার কফিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে এবং গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এরপর চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে জানাজা শেষে চৈতন্য গলিতে তাকে সমাহিত করা হবে।
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার বিকালে মারা যান বেগম মুশতারী শফী। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া মুশতারী শফী ছিলেন চট্টগ্রামসহ সারাদেশের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামের প্রায় সব নাগরিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়।
১৯৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে নারীদের জন্য মাসিক ‘বান্ধবী’ সাময়িকীর প্রকাশনা শুরু করেন এবং ‘বান্ধবী সংঘ’র প্রতিষ্ঠা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম মহানগরীর এনায়েত বাজারে মুশতারী শফীর বাড়িতেই কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডা. মোহাম্মদ শফী ও তার স্ত্রী মুশতারী। একাত্তরের শুরুর সময় থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, সেবা ও অর্থায়নসহ নানা কাজে যুক্ত ছিলেন তারা। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বাসায় রাখায় ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ডা. মোহাম্মদ শফী এবং মুশতারীর ভাই এহসানুল হক আনসারীকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যার। পরে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরপর ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দ সৈনিক হিসেবে কাজ করেন মুশতারী শফী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে মুশতারী শফীকে ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। ২০২০ সালে তিনি বেগম রোকেয়া পদক পান।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গত শতকের ৯০ এর দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলে তাতে সক্রিয় হন মুশতারী শফী। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পরও আন্দোলন এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় এক দশক আগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবে ছিলেন মুশতারী শফী। তিনি মহিলা পরিষদে যুক্ত ছিলেন এবং সর্বশেষ উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন। মুশতারী শফী লেখালেখিতেও ছিলেন সমান সক্রিয়। ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘একুশের গল্প’, ‘দুটি নারী ও একটি যুদ্ধ’, একদিন এবং অনেকগুলো দিন’, ‘আমি সুদূরের পিয়াসি’সহ বেশ কিছু কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
ফুলেল শ্রদ্ধায় শহীদজায়া মুশতারী শফীকে শেষ বিদায়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ