বিদেশের খবর ডেস্ক : যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ৯০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। এর আগে তিন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। রোববার (১৯ জানুয়ারি) যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরতে শুরু করেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। যদিও গাজার ৭০ শতাংশ ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অনেকে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় গাজা জুড়ে শুধু ধ্বংসস্তূপ।
চুক্তির অংশ হিসেবে ৯০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয় তেল আবিব। চুক্তির আওতায় একজন ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে ৩০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল নেতানিয়াহু প্রশাসনের। ইসরায়েল সেটাই করেছে। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য খান ইউনিস হাসপাতালে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ধাপে হামাসের হাতে থাকা ৩৩ ইসরাইলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল তাদের হাতে আটক শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। চুক্তির প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই বন্দি বিনিময় হবে। একই সঙ্গে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘরে ফেরার অনুমতি পাবে। পাশাপাশি ত্রাণবাহী ট্রাকগুলোকে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।
দ্বিতীয় ধাপে, হামাসের হাতে থাকা বাকি জিম্মিরা মুক্তি পাবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হবে। এর মাধ্যমে ‘টেকসই শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠা হবে’। তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে, গাজা পুনর্গঠন হবে-যা শেষ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। একই সঙ্গে মৃত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের প্রথমদিনে তিন ইসরায়েলি জিম্মি রোমি গনেন, ডোরন স্টেইন ব্রেচার এবং এমিলি দামারিকে মুক্তি দেয় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস যোদ্ধারা। এরপর তাদেরকে রেডক্রসের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে রেডক্রস তাদেরকে পরিবারের হাতে তুলে দিলে পরিবারের সদস্যরা তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ইসরায়েলের হাসপাতালে ভর্তি করেন। এদিকে, নির্ধারিত সময়ের প্রায় সময়ের তিন ঘণ্টা পর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়। বন্দি বিনিময়ে বিলম্ব হওয়ায় ইসরায়েল গাজায় হামলা চালালে কমপক্ষে ১৯ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হন।
রাফাহতে ফিরে ধ্বংসস্তূপ দেখলেন ফিলিস্তিনিরা
১৫ মাসের ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে নিজেদের বাড়িতে ফেরার আশায় ছিলেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল শুধুই ধ্বংসস্তূপ। ৫৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কৃষক আব্দ আল-সাত্তার রাফাহতে দুইটি বাড়ির মালিক ছিলেন।
নয় মাস আগে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণের পর থেকে তিনি উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছিলেন। আশায় ছিলেন, একটি বাড়ি যদি ধ্বংস হয়, তবে অন্য বাড়ি তার পরিবারের আশ্রয় হয়ে উঠবে। কিন্তু রবিবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগেই তিনি তার বড় ছেলে মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে দেখেন তাদের দু’টি বাড়িই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আল-সাত্তারের একটি বাড়ি ছিল শাবুরা এলাকায়, আর অন্যটি মিরাজে। প্রথম বাড়ি ছিল ২০০ বর্গমিটার আর দ্বিতীয়টি দুইতলা, ১৬০ বর্গমিটারের। কিন্তু এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তার তিন ভাইয়ের বাড়িও একই অবস্থায়। পরিবারকে পুনরায় আশ্রয় দেওয়ার স্বপ্ন এক নিমেষেই ভেঙে যায়। আল-সাত্তার ফোনে তার স্ত্রীকে খবরটি জানান, যিনি আল-মাওয়াসি ক্যাম্পে তাদের পরিবারের সঙ্গে অপেক্ষায় ছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি বাসযোগ্য নয়। এখানে আর ফেরার উপায় নেই। তার স্ত্রী চোখের জলে তাকে ফিরে আসার অনুরোধ করলেও আল-সাত্তার তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি বলেন, রাফাহ আর আগের মতো নেই। যেখানে আমরা বড় হয়েছি, কাজ করেছি, সেই সব জায়গা এখন অচেনা ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আগে রাফাহতে বহু পরিবার ফিরতে শুরু করে। তারা গাড়ি, গরুর গাড়ি আর বাইকে করে তাদের কিছু সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হয়। তাদের অনেকেই ধ্বংসাবশেষে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প গড়ে তোলে। পথ চলার সময় কেউ কেউ স্লোগান দেয়, ‘আমরা আবার গড়ব। আমরা বাঁচব।’
কিন্তু অনেকের জন্য ফেরার আনন্দ অচিরেই পরিণত হয় হতাশায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধের পর গাজার ৬০ শতাংশ ভবন আর ৬৫ শতাংশ রাস্তা ধ্বংস হয়েছে। রাফাহ শহরের মেয়র মোহাম্মদ আল-সুফি বলেন, শহরের ৭০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। শহর এখন বাসযোগ্য নয়।
রাফাহ অঞ্চলের ফিলাডেলফি করিডর শহরের ১৬ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এটি এখনও জনসাধারণের জন্য বন্ধ। পূর্ব রাফাহতে বিশাল অংশও চলাচলের অনুপযোগী।
ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আল-সাত্তার বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, অবশেষে তাঁবুর জীবন থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বোমার আঘাত নয়, বরং জীবনের মৌলিক চাহিদার অভাবই আমাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
রাফাহতে ফিরে আসা অনেকেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে খান ইউনিসে আশ্রয় নিয়েছেন। এক বাসিন্দা বলেন, রাফাহ এখন কবরস্থানের মতো। এখানে জীবনযাপন অসম্ভব। তবুও, রাফাহতে অনেক পরিবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদের শহর পুনর্গঠনের। এক বাবা বলেন, রাফাহই আমাদের ঘর। আমরা আবার গড়ব, যত সময়ই লাগুক। সূত্র: আল জাজিরা