ঢাকা ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ফিলিস্তিনের নারী নেত্রী খালিদার পুরো জীবনই সংগ্রামমুখর

  • আপডেট সময় : ০৫:১৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
  • ২৪ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক: গাজায় এখন চলছে মুক্তির আনন্দ। যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের অকুতোভয় বীর রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী খালিদা জাররার। প্রায় ৪০ বছর ধরে স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করে চলা এই নারীনেত্রী অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তার কাছে এ মুক্তি যদিও কেবল ছোট কারাগার থেকে নিয়মিত বিরতিতে বড় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ারই নামান্তর, তবুও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা তার মুক্তি দারুণভাবে উদ্যাপন করছে।

১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া খালিদা ফিলিস্তিনের বামপন্থি রাজনৈতিক দল পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা। ২০০৬ সালে দলটি থেকে ফিলিস্তিন আইন পরিষদের (পিএলসি) সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সেই দায়িত্ব এখনো পালন করে চলেছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপের ফিলিস্তিন প্রতিনিধি এবং পিএলসির প্রিজনারস কমিটিরও প্রধান খালিদা জাররার। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফিলিস্তিনের যোগদানে বড় ভূমিকা রয়েছে তার।

খালিদা জাররারের পুরো জীবনই সংগ্রামমুখর। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তিনি প্রথম আটক হন ১৯৮৯ সালে। দিনটি ছিল ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেদিন ৫ হাজার ফিলিস্তিনি নারীকে জড়ো করে বিশাল বিক্ষোভ করেছিলেন তিনি।

তখন থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন খালিদা। ১৯৯৮ সালে তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসরায়েল। ২০১৫ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর সাময়িক জামিন পেলেও ২০১৭ সালে আবার গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। দীর্ঘ সাজার পর ২০২১ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে শেষবার গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার স্বামী গাসসানও দখলদারদের বুটের আঘাতে রক্তাক্ত হন।
খালিদা জাররার ২০ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন। পশ্চিম তীরকেন্দ্রিক কমিউনিস্ট মতাদর্শের বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বন্দিবিনিময়ের প্রথম পর্বেই তাকে মুক্ত করে আনে গাজার ডানপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামাস। এ পদক্ষেপে হামাসের মানবিকতা প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে খালিদার অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা জোরালো হয়ে উঠছে।

জেল থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসার পর তার শারীরিক দুর্বলতা এবং অসুস্থতা দেখে কারাগারে তার পর্যাপ্ত যত্ন ও চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী। তবে সত্য হলো, কারাগারের নিপীড়ন খালিদাকে সাদা চুল ও ভগ্নদেহ উপহার দিলেও তার দৃঢ় মনোবল মোটেই ভাঙতে পারেনি। তার পুরো জীবনে এমন নির্যাতন ও নিপীড়নের অসংখ্য ঘটনা আছে।
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা খালিদার বাবা ছিলেন নাবলুসের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

বির জেইত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গাসসান জাররারকে বিয়ে করেন খালিদা। গাসসান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৪ বার দখলদারদের হাতে আটক হন। সব মিলিয়ে জীবনের ১১টি বছর ইসরায়েলের কারাগারে কাটান। গাসসান-খালিদা দম্পতির তিন সন্তান। মা-বাবার জেল-জুলুমের এক নিষ্ঠুর জীবনের ভেতর দিয়ে রামাল্লার আল-বিরেহে বেড়ে ওঠে তাদের সন্তানেরা। খালিদা জাররার ২০১৫ সালে বাবাকে হারান। ২০১৮ সালে হারান মাকে। ২০২১ সালে ৩১ বছর বয়সী কন্যা সুহাও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তবে খালিদা কারো জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। মা-বাবা কিংবা কন্যার মুখটি শেষবারের মতো দেখার অনুমতি দেয়নি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে তার একমাত্র ছেলে ওয়াদিয়াও মাত্র ২৯ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখনো খালিদা ইসরায়েলের বিশেষ জেলে নির্জন কারাবাসে শাস্তি ভোগ করছেন।
খালিদা জাররারদের হারানোর কিছু নেই। মুক্ত জীবনের ঘ্রাণ কখনো স্পর্শ করতে পারবেন কি না, তা-ও অজানা। তবে তার আপসহীন ব্যক্তিত্ব ফিলিস্তিনিদের অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে। তাই ছোট্ট সেলের বন্দিজীবন থেকে বড় সেলের জীবনে ফেরাতেই আপাতত একটু আনন্দ, হাসি ও উদ্যাপন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ফিলিস্তিনের নারী নেত্রী খালিদার পুরো জীবনই সংগ্রামমুখর

আপডেট সময় : ০৫:১৩:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫

নারী ও শিশু ডেস্ক: গাজায় এখন চলছে মুক্তির আনন্দ। যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের অকুতোভয় বীর রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী খালিদা জাররার। প্রায় ৪০ বছর ধরে স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করে চলা এই নারীনেত্রী অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। তার কাছে এ মুক্তি যদিও কেবল ছোট কারাগার থেকে নিয়মিত বিরতিতে বড় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ারই নামান্তর, তবুও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা তার মুক্তি দারুণভাবে উদ্যাপন করছে।

১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া খালিদা ফিলিস্তিনের বামপন্থি রাজনৈতিক দল পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা। ২০০৬ সালে দলটি থেকে ফিলিস্তিন আইন পরিষদের (পিএলসি) সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সেই দায়িত্ব এখনো পালন করে চলেছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপের ফিলিস্তিন প্রতিনিধি এবং পিএলসির প্রিজনারস কমিটিরও প্রধান খালিদা জাররার। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফিলিস্তিনের যোগদানে বড় ভূমিকা রয়েছে তার।

খালিদা জাররারের পুরো জীবনই সংগ্রামমুখর। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তিনি প্রথম আটক হন ১৯৮৯ সালে। দিনটি ছিল ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেদিন ৫ হাজার ফিলিস্তিনি নারীকে জড়ো করে বিশাল বিক্ষোভ করেছিলেন তিনি।

তখন থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন খালিদা। ১৯৯৮ সালে তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসরায়েল। ২০১৫ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর সাময়িক জামিন পেলেও ২০১৭ সালে আবার গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। দীর্ঘ সাজার পর ২০২১ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে শেষবার গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার স্বামী গাসসানও দখলদারদের বুটের আঘাতে রক্তাক্ত হন।
খালিদা জাররার ২০ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন। পশ্চিম তীরকেন্দ্রিক কমিউনিস্ট মতাদর্শের বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বন্দিবিনিময়ের প্রথম পর্বেই তাকে মুক্ত করে আনে গাজার ডানপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামাস। এ পদক্ষেপে হামাসের মানবিকতা প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে খালিদার অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা জোরালো হয়ে উঠছে।

জেল থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসার পর তার শারীরিক দুর্বলতা এবং অসুস্থতা দেখে কারাগারে তার পর্যাপ্ত যত্ন ও চিকিৎসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী। তবে সত্য হলো, কারাগারের নিপীড়ন খালিদাকে সাদা চুল ও ভগ্নদেহ উপহার দিলেও তার দৃঢ় মনোবল মোটেই ভাঙতে পারেনি। তার পুরো জীবনে এমন নির্যাতন ও নিপীড়নের অসংখ্য ঘটনা আছে।
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা খালিদার বাবা ছিলেন নাবলুসের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

বির জেইত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গাসসান জাররারকে বিয়ে করেন খালিদা। গাসসান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৪ বার দখলদারদের হাতে আটক হন। সব মিলিয়ে জীবনের ১১টি বছর ইসরায়েলের কারাগারে কাটান। গাসসান-খালিদা দম্পতির তিন সন্তান। মা-বাবার জেল-জুলুমের এক নিষ্ঠুর জীবনের ভেতর দিয়ে রামাল্লার আল-বিরেহে বেড়ে ওঠে তাদের সন্তানেরা। খালিদা জাররার ২০১৫ সালে বাবাকে হারান। ২০১৮ সালে হারান মাকে। ২০২১ সালে ৩১ বছর বয়সী কন্যা সুহাও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তবে খালিদা কারো জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। মা-বাবা কিংবা কন্যার মুখটি শেষবারের মতো দেখার অনুমতি দেয়নি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে তার একমাত্র ছেলে ওয়াদিয়াও মাত্র ২৯ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখনো খালিদা ইসরায়েলের বিশেষ জেলে নির্জন কারাবাসে শাস্তি ভোগ করছেন।
খালিদা জাররারদের হারানোর কিছু নেই। মুক্ত জীবনের ঘ্রাণ কখনো স্পর্শ করতে পারবেন কি না, তা-ও অজানা। তবে তার আপসহীন ব্যক্তিত্ব ফিলিস্তিনিদের অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে। তাই ছোট্ট সেলের বন্দিজীবন থেকে বড় সেলের জীবনে ফেরাতেই আপাতত একটু আনন্দ, হাসি ও উদ্যাপন।