ঢাকা ০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিরে দেখা-২০২৪,ব্যাংকিংখাতে ঋণের নামে লুটপাট

  • আপডেট সময় : ০৮:০৪:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ১০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এস আলম সহ কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পুরো ব্যাংক খাত জব্দ করে রেখেছিলো। ঋণের নামে অর্থ লুট করে অনেকেই বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এরপরই কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের মালিকানা কেড়ে নেওয়া হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় সুশাসনের অভাব দূর করে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের চিত্র। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট ও তারল্য সংকট বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলো খারাপ অবস্থায় পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরাও এলসি খুলতে পারছিলো না। এভাবেই নানা সংকটের মধ্যেই ২০২৪ সাল পার করতে চলেছে ব্যাংক খাতে।
২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে দেশের নয়টি ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারেনি। এসব ব্যাংকের চলতি হিসেবে ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের দখলমুক্ত ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদেরই বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে ওই সব ব্যাংককে দেওয়া হবে না।

যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য আছে তাদের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। আর এর গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তাতে তেমন সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে টাকা ছাপিয়ে টাকা ধার দিতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

আগের সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হবে না- গত আগস্টেই এমন মন্তব্য করেছিলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে এমন মন্তব্যের তিন মাসের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা জানান গভর্নর নিজেই।
একীভূতকরণ রহিত
আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত। ব্যাংকখাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সিদ্ধান্তহীনতায় খোদ দুর্বল ও সবল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হতে পারে। তবে পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ডিজিটাল ব্যাংকিং ও নগদের লাইসেন্স স্থগিত
দেশে প্রথমবারের মতো গত বছরে প্রাথমিকভাবে দুটি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুটি হলো- নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি। আর ডিজিটাল ব্যাংকের উইন্ডোর জন্য গাইডলাইন তৈরির পর ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ব্যাংক এশিয়ার ডিজিট অল ও ডিজি১০ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক উইন্ডো খুলতে পারবে বলে সায় দেয়। ডিজি১০ ব্যাংকটি ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংক। নগদের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স স্থগিত করে পুনরায় পর্যালোচনা করার কথা জানান গভর্নর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, নগদের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া পুনরায় রিভিউ করা হবে।
নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ
গত জুলাইয়ের শুরুতেই নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের হিসাব স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার যা গোপন করে আসছিলেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বর্তমানে মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ হিসাবে তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের ব্যয়যোগ রিজার্ভ প্রায় ১৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্য ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়নের চেয়ে সামান্য কম।
গভর্নরকে বয়কট
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য বয়কট করেছিলেন সাংবাদিকরা। যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বিরল ঘটনা।
গভর্নরের পদত্যাগ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন দায়িত্বে থাকলেও অফিস করেননি আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি পালিয়েছেন বলে তখন গুঞ্জন ওঠে। তারপরই ৯ আগস্ট দুপুরে অনলাইনে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর। একইভাবে অফিস করলেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দুই ডেপুটি গভর্নর ও পলিসি উপদেষ্টা। নিয়োগ দেয়া হয় দুইজন ডেপুটি গভর্নর।
সালমান এফ রহমান ও এস আলমের পতন
এস আলম ও সালমান এফ রহমানদের ইশারায় চলেছে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি। সরকারের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সালমান এফ রহমানের পতন হয়। পালিয়ে যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। তিনি একাই প্রায় ১০ ব্যাংক নিজের কব্জায় নেন। করেন লুটপাট ও পাচার। নিজের পিএস, আত্মীয় ও ছেলেদের বসান দখলকৃত ব্যাংকগুলোয়। কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিজ এলাকার ১০ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়োগ দেন ব্যাংকে, সরিয়ে দেন দক্ষ কর্মকর্তাদের। একইভাবে পতন ঘটে সিকদার গ্রুপের। গ্রুপটির পরিচালক রন হক সিদকার ও রক সিকদারের অস্ত্রবাজির মহড়া আর নেই। তাদের হাতে প্রায় ধ্বংস হওয়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অস্থির ডলার বাজার
আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আমদানি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এ চাহিদা বেড়েছে। তবে এর বিপরীতে ডলারের জোগান কম। এ কারণেই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকায় ডলার কিনতে পারবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রেমিট্যান্সের প্রবাহ
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেন। এদিকে চলতি মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে দেশে বৈধপথে ২৪২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর) ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার, অক্টোবরে ২৪০ কোটি (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার এবং সবশেষ নভেম্বর মাসে এসেছে ২২০ কোটি (২ দশমিক ২০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স।
খেলাপি ঋণ
দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৪। চলতি বছর মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা ছিল, যা মোট বিতরণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। বছরের পরের প্রান্তিক জুন শেষে তা ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা বা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যায় সবশেষ সেপ্টেম্বর প্রান্তিক। সেপ্টেম্বর শেষে রেকর্ড ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ফিরে দেখা-২০২৪,ব্যাংকিংখাতে ঋণের নামে লুটপাট

আপডেট সময় : ০৮:০৪:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এস আলম সহ কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পুরো ব্যাংক খাত জব্দ করে রেখেছিলো। ঋণের নামে অর্থ লুট করে অনেকেই বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এরপরই কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের মালিকানা কেড়ে নেওয়া হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় সুশাসনের অভাব দূর করে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের চিত্র। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট ও তারল্য সংকট বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলো খারাপ অবস্থায় পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরাও এলসি খুলতে পারছিলো না। এভাবেই নানা সংকটের মধ্যেই ২০২৪ সাল পার করতে চলেছে ব্যাংক খাতে।
২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে দেশের নয়টি ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারেনি। এসব ব্যাংকের চলতি হিসেবে ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের দখলমুক্ত ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদেরই বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে ওই সব ব্যাংককে দেওয়া হবে না।

যেসব ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য আছে তাদের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। আর এর গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তাতে তেমন সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে টাকা ছাপিয়ে টাকা ধার দিতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

আগের সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হবে না- গত আগস্টেই এমন মন্তব্য করেছিলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে এমন মন্তব্যের তিন মাসের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা জানান গভর্নর নিজেই।
একীভূতকরণ রহিত
আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত। ব্যাংকখাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সিদ্ধান্তহীনতায় খোদ দুর্বল ও সবল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হতে পারে। তবে পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ডিজিটাল ব্যাংকিং ও নগদের লাইসেন্স স্থগিত
দেশে প্রথমবারের মতো গত বছরে প্রাথমিকভাবে দুটি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুটি হলো- নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি ও কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি। আর ডিজিটাল ব্যাংকের উইন্ডোর জন্য গাইডলাইন তৈরির পর ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ব্যাংক এশিয়ার ডিজিট অল ও ডিজি১০ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক উইন্ডো খুলতে পারবে বলে সায় দেয়। ডিজি১০ ব্যাংকটি ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংক। নগদের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স স্থগিত করে পুনরায় পর্যালোচনা করার কথা জানান গভর্নর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, নগদের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া পুনরায় রিভিউ করা হবে।
নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ
গত জুলাইয়ের শুরুতেই নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের হিসাব স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার যা গোপন করে আসছিলেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বর্তমানে মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ হিসাবে তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের ব্যয়যোগ রিজার্ভ প্রায় ১৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের বেঁধে দেয়া লক্ষ্য ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়নের চেয়ে সামান্য কম।
গভর্নরকে বয়কট
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য বয়কট করেছিলেন সাংবাদিকরা। যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বিরল ঘটনা।
গভর্নরের পদত্যাগ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন দায়িত্বে থাকলেও অফিস করেননি আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি পালিয়েছেন বলে তখন গুঞ্জন ওঠে। তারপরই ৯ আগস্ট দুপুরে অনলাইনে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর। একইভাবে অফিস করলেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দুই ডেপুটি গভর্নর ও পলিসি উপদেষ্টা। নিয়োগ দেয়া হয় দুইজন ডেপুটি গভর্নর।
সালমান এফ রহমান ও এস আলমের পতন
এস আলম ও সালমান এফ রহমানদের ইশারায় চলেছে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি। সরকারের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সালমান এফ রহমানের পতন হয়। পালিয়ে যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম। তিনি একাই প্রায় ১০ ব্যাংক নিজের কব্জায় নেন। করেন লুটপাট ও পাচার। নিজের পিএস, আত্মীয় ও ছেলেদের বসান দখলকৃত ব্যাংকগুলোয়। কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিজ এলাকার ১০ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়োগ দেন ব্যাংকে, সরিয়ে দেন দক্ষ কর্মকর্তাদের। একইভাবে পতন ঘটে সিকদার গ্রুপের। গ্রুপটির পরিচালক রন হক সিদকার ও রক সিকদারের অস্ত্রবাজির মহড়া আর নেই। তাদের হাতে প্রায় ধ্বংস হওয়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অস্থির ডলার বাজার
আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আমদানি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এ চাহিদা বেড়েছে। তবে এর বিপরীতে ডলারের জোগান কম। এ কারণেই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকায় ডলার কিনতে পারবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রেমিট্যান্সের প্রবাহ
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেন। এদিকে চলতি মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে দেশে বৈধপথে ২৪২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর) ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার, অক্টোবরে ২৪০ কোটি (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার এবং সবশেষ নভেম্বর মাসে এসেছে ২২০ কোটি (২ দশমিক ২০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স।
খেলাপি ঋণ
দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৪। চলতি বছর মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা ছিল, যা মোট বিতরণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। বছরের পরের প্রান্তিক জুন শেষে তা ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা বা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যায় সবশেষ সেপ্টেম্বর প্রান্তিক। সেপ্টেম্বর শেষে রেকর্ড ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ।