ঢাকা ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

ফিতরা কী, কেন, কীভাবে?

  • আপডেট সময় : ০৬:০৫:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫
  • ১৫ বার পড়া হয়েছে

গুঞ্জন রহমান : ফিতরা বা ফেতরা আরবি শব্দ; যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের জাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাবার (ইৎবধশভধংঃ) বোঝানো হয়, যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। এই ফিতর বা ফাতুর থেকেই ইফতার শব্দটি এসেছে। জাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব দুস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে।

রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা প্রাতরাশ গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে জাকাতুল ফিতর বা ইফতারের জাকাত বলা হয়। মূলত, আল্লাহ পাক যে তাঁর বান্দাকে গোটা রমজান মাস ইফতার গ্রহণের তওফিক দান করলেন, তারই প্রতিদানস্বরূপ বান্দাকে ফিতরা প্রদান করতে হয়। ফিতরা প্রদানের বাধ্যবাধকতা আছে বিধায় রমজান শেষের ঈদটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই ঈদ উদযাপনের শর্তই হলো ফিতরা প্রদান করা। মহানবী (সা.) একাধিক হাদিসে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহের পথে রওনা হওয়ার আগেই ফিতরা প্রদান করতে আদেশ দিয়েছেন।

ফিতরা কার জন্য ওয়াজিব: াদাকাতুল ফিতর মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের জন্য আদায় করা ওয়াজিব। ইবনে ওমর বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতদের মধ্যে ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সবার ওপর মাথাপিছু এক সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব জাকাতুল ফিতর হিসাবে ওয়াজিব করেছেন এবং তা ঈদগাহে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন”। যদি কোনও ব্যক্তি ঈদের দিন সুবহে-সাদেকের পূর্বে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। একইভাবে, যদি সুবহে সাদেকের পরে কোনও বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কোনও ব্যক্তি সুবহে সাদেকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনও শিশু সুবহে সাদিকের পূর্বে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তাদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব। সাদাকাতুল ফিতর হলো জানের সদকা, মালের নয়। অতএব, জীবিত সব মুসলিমের জানের সাদকা আদায় করা ওয়াজিব। কোনও ব্যক্তি রোজা পালনে সক্ষম না হলেও তার জন্য ফিতরা ওয়াজিব। সামর্থ্যহীন ব্যক্তি, যেমন শিশু, উপার্জনহীন নারী ও পুরুষ, বৃদ্ধ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব যদি তার কোনও অভিভাবক থেকে থাকেন, যিনি তার বা তাদের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। তবে একই পরিবারে বসবাসকারী উপার্জনকারী সদস্যরা, যেমন স্ত্রী, ছোট ভাই বা সন্তান যদি উপার্জনক্ষম হন, তাহলে তারা নিজ নিজ ফিতরা নিজেরাই নির্বাহ করবেন। অর্থাৎ, পরিবারের উপার্জনহীন ব্যক্তিদের পক্ষে উপার্জনকারী ব্যক্তিদের ফিতরা আদায় করতে হবে। একইভাবে, দাসপ্রথা যখন বলবৎ ছিল, তখন দাসদের পক্ষে তাদের মালিককে ফিতরা প্রদান করতে হতো। সেই হিসেবে কারও ওপর নির্ভরশীল কর্মচারী, যার নিজের ফিতরা প্রদানের সামর্থ্য নেই, তার পক্ষে ফিতরা প্রদানের দায়িত্ব উক্ত কর্মচারীর নিয়োগদাতা বা কর্মদাতার।
কার প্রতি ফিতরা প্রদান ওয়াজিব বা আবশ্যক নয় এবং কারা এই ফিতরা গ্রহণ করতে পারবেন: ফিতরা তারাই গ্রহণ করতে পারবেন, যাদের প্রতি ফিতরা প্রদান আবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ও তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারকে প্রতিদিনের ভরপেট ইফতারের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, তিনিই ফিতরার হকদার। ধরুন, আপনার বাসার কাজে সাহায্যকারী ব্যক্তি, যার পক্ষে আপনার প্রদেয় বেতনের টাকা দিয়ে পরিবারের সব সদস্যকে প্রতিদিন ভরপেট ইফতার করানো সম্ভব হয় না, সেই ব্যক্তিকে আপনি ফিতরা দিতে পারবেন। তবে ফিতরা যেন অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত হয়। অর্থাৎ, ফিতরার মাধ্যমে কারও পারিশ্রমিক মেটানো যাবে না। একইভাবে, গরিব, দুস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি; যাদের পক্ষে জাকাত ও সদকা গ্রহণ করা জায়েজ, তাদের ফিতরা প্রদান করা যাবে।
কারা ফিতরা পাওয়ার যোগ্য তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। একদল আলেম মনে করেন, যারা সাধারণভাবে সম্পদের জাকাতের হক্দার, তারা সকলেই ছাদাকাতুল ফিতরেরও হকদার। তাদের যুক্তি হলো, ফিতরাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) জাকাত ও ছাদাকা বলেছেন। তাই যেটা সম্পদের জাকাতের খাত হবে, সেটা ফিতরারও খাত হবে। ছাদাকার যেই খাতগুলো আল্লাহ পাক সুরা তওবা’য় উল্লেখ করেছেন, সেই খাতগুলো ছাদাকাতুল ফিতরের জন্যও প্রযোজ্য হবে। সুরা তওবা’য় নির্দেশিত হিসাব অনুসারে আট প্রকার লোক ছাদাকাতুল ফিতরের হকদার। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ছাদাকাহ কেবল দরিদ্র, মিসকিন, (ও ছাদাকাহ্) আদায়ের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, (এবং) যাদের অন্তরে প্রীতি স্থাপন করা হয়, বন্দি মুক্ত করার জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরের জন্য, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরজ। আর আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’ (আত-তওবা, ৯/৬০)।
আরেক দল আলেম মনে করেন, ছাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা কেবল ফকির-মিসকিনদের হক; অন্যদের নয়। তাদের যুক্তি হলো, ইবনু আব্বাস (রা.) কর্তৃক হাদিস, যেখানে সাহাবী বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ পাক জাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন সিয়াম পালনকারীর অশ্লীলতা ও অনর্থক ক্রিয়াকলাপ হতে পবিত্রতা রক্ষার জন্য এবং মিসকিনদের আহারস্বরূপ…।’

যেহেতু উপর্যুক্ত হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে, ‘মিসকিনদের আহারস্বরূপ’; সেহেতু দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও অভাবগ্রস্তকেই ফিতরা প্রদান করতে হবে। ওই মতকে সমর্থন করেছেন ইবনু তায়মিয়া, ইবনুল কাইয়িম, শাওকানি, আযিমাবাদী, ইবনু উছায়মিনসহ আরও অনেকে। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে, এই মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ এই মতের পক্ষে স্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ বিদ্যমান।
উল্লেখ্য, কারো অধীনস্থ কর্মচারী বা বেতনভুক্ত সাহায্যকারীকে বেতনের পরিবর্তে ফিতরা দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বেতনসহ ফিতরা দেওয়া যেতে পারে। ফিতরার খাদ্যসমূহের মধ্যে মসজিদ, মাদরাসা অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম যদি ফকির-মিসকিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তারা ফিতরার দাবিদার হবেন।

বরং তারা অন্যান্য ফকির-মিসকিনদের থেকেও অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ, এরা দ্বীনের শিক্ষা অর্জনে ও অন্যকে শিক্ষাদানে নিয়োজিত, যে গুণটি অন্যান্য ফকির-মিসকিনের নেই।
সা এবং অর্ধ সা: ফিতরা প্রদানের পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় ‘সা’ বহুল আলোচিত শব্দ। মাঝারি দেহের অধিকারী মানুষের হাতের চার আঁজলা পরিমাণ এক ‘সা’ হয় (অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি একত্র করে চার আঁজলা বা অঞ্জলিতে যে পরিমাণ খাবার ওঠে, সেটিই এক ‘সা’)। আরবিতে ‘সা’ নির্দিষ্ট পরিমাপের একটি পাত্রকে বলা হয়; যার দ্বারা দানা জাতীয় শস্য মাপা হয়। বাংলাদেশে যেমন এক সময় ধান পরিমাপের জন্য কাঠা, তেল বা দুধ পরিমাপের জন্য ‘পোয়া’ ব্যবহৃত হতো। এখনো তেল পরিমাপের জন্য গ্যালন ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি একটি পাত্রের নাম সা।

জাকাতুল ফিতর হিসাবে প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক সা খাদ্যশস্যের হিসাব বের করতে গেলে দেখা যায়, নবী করিম (সা.)-এর যুগের এক সা পরিমাণ হলো, সবচেয়ে ভালো গমের ক্ষেত্রে এটি ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ। মনে রাখতে হবে, সা কোনো বাটখারা নয়; বরং এটি একটি পাত্রবিশেষ। তাই বিভিন্ন ফসলের জন্য সা-এর ওজন বিভিন্ন হয়। এক বাটি চাল এবং এক বাটি মুড়ির ওজনে তারতম্য হবে– এটা সাধারণ জ্ঞান দ্বারাই বোঝা যায়। তাই ফিতরার পরিমাণ হিসেবে সা বিবেচনা করা হয় নির্দিষ্ট শস্যের পরিমাপে। এক সা সমান চাল প্রায় ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হয়। কিন্তু এক সা গম, যব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি ২ কেজি ২২৫ গ্রামের বেশি হয় না। ইরাকি এক সা সমান ২ কেজি ৪০০ গ্রাম অথবা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলি চাল। বাংলাদেশে এক সা সমান ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম আটা পরিমাপ করা হয়।

ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ এক সা নাকি অর্ধ সা: বিভিন্ন হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়– হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এক সা পরিমাণ ফিতরা প্রদানের কথা বলেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং চার খলিফা (রা.)-এর মৃত্যুর পরে ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন মুআবিয়া (রা.)। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী সৌদি আরবের মদিনা থেকে সিরিয়ার দামেস্ক শহরে স্থানান্তর করেন। তখন তারা গমের সাথে পরিচিত হন। সেই যুগে সিরিয়ায় গমের মূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) একদা হজ বা উমরা করার সময় মদিনায় আসার পর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি’। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে মুসলিম জনগণের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু ফিতরার পরিমাণ অর্ধ সা নির্ধারণ করা আসলে ঠিক নয়। কারণ মহানবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনও অর্ধ সা ফিতরা দেননি বা দেওয়াটা অনুমোদন করেননি। তিনি এমনকি অর্থমূল্যেও ফিতরা দেননি কখনো; বরং যব, খেজুর, পনির বা কিশমিশ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য ফিতরা হিসেবে প্রদান করেছেন। তাই খেজুরের সাথে গমের দামের তারতম্য হিসাব করে, সেই অনুসারে অর্ধ সা গমের দামে ফিতরা পরিমাপ করলে তা মূলত মহানবীর (সা.) নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে।
বিশিষ্ট সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রা.)-সহ অন্যান্য সাহাবীরা মুয়াবিয়ার এই ‘ইজতিহাদী’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের ওপরই কায়েম থাকেন। যারা অর্ধ সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় করেন, তারা মুয়াবিয়ার রায়ের অনুসরণ করেন মাত্র। অর্ধ সা ফিতরা আদায় করা সুন্নাতবিরোধী কাজ।

রাসুলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর নির্দেশের লঙ্ঘনকারীদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করেছেন। মিস‘আর ইবনে কিদাম (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি সা’দ ইবনে ইবরাহীমকে বলতে শুনেছি, কেবল বিশ্বস্ত ব্যক্তিরাই আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাঁর ওপর আশীর্বাদ করুন এবং তাঁকে শান্তি দান করুন অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস গ্রহণ করা যাবে না। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে বেশি বেশি বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকবে। যে ব্যক্তি আমার ওপর কোনও কথা আরোপ করবে, সে যেন কেবল হক বা সত্য বলে। আর যে ব্যক্তি আমার ওপর এমন কোনও কথা আরোপ করবে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নিল।’

দান বা ছাদাকাহ দেওয়ার উপাদান নির্ধারণ প্রসঙ্গে অপর এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আর তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না, যখন তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও’। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রবর্তিত ফিতরার পরিমাণ অন্য কারও নির্দেশে পরিবর্তন করা গর্হিত অন্যায়। তিনি যেখানে খাদ্যের উৎকৃষ্ট উপাদানের দ্বারা দান করতে বলেছেন, সেখানে পরিমাণও হওয়া আবশ্যক উৎকৃষ্ট পরিমাণ।

ইমাম নবভি (রা.) বলেন, ‘সুতরাং অর্ধ সা ফিতরা আদায় করা সুন্নাহর খেলাপ। রাসুল (সা.) জাকাতের ও ফিতরার যে হার নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা রদবদল করার অধিকার কারো নেই। এ ব্যাপারে ওমর (রা.) একটি ফরমান লিখে আমর ইবনে হাযম (রা.)-এর কাছে পাঠান যে, জাকাতের নিছাব ও প্রত্যেক নিছাবে জাকাতের যে হার, তা চিরদিনের জন্য আল্লাহ তার রাসুলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এতে কোনও যুগে, কোনও দেশে (ফিতরার পরিমাণ) কমবেশি অথবা রদবদল করার অধিকার কারো নেই।’
ফিতরার পরিমাণ হিসেবে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের কারণ কী: যেহেতু ফিতরা প্রদান করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব, সেহেতু সামর্থ্যের তারতম্য অনুসারে ফিতরার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন অর্থমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যে ক’টি খাদ্যপণ্যের দ্বারা মহানবী (সা.) ফিতরা প্রদান করেছেন, সেই পণ্যগুলোর দামের সর্বোচ্চ সীমা ও সর্বনিম্ন সীমাকে ফিতরার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পরিমাণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেমন, যদি চলতি বছর বাংলাদেশে এক সা পরিমাণ (৩.৩ কেজি) উৎকৃষ্ট মানের পনিরের সর্বোচ্চ মূল্য (৩.৩০ কেজি দ্ধ ৮২০ টাকা) ২৭০৬ টাকা ধার্য করা হয়, তাহলে সেই হিসাবে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ফিতরা হবে ২৭০০ টাকা; এবং এক সা পরিমাণ উৎকৃষ্ট মানের আটার সর্বোচ্চ মূল্য (৩.৩০ কেজি দ্ধ ৬০ টাকা) ১৯৮ টাকা টাকা ধার্য করা হলে, মাথাপিছু সর্বনিম্ন ফিতরা ১৯৮ টাকা।

আপনার পরিবারে যদি আপনার ওপর নির্ভরশীল সদস্য তিন জন থেকে থাকেন, তবে নিজসহ আপনার ওপর ওয়াজিব সাদাকাতুল ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত হবে ১৯৮ী৪ = ৭৯২ টাকা। কিন্তু যদি আপনার আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে প্রদান করতে হবে ২৭০৬ী৪ = ১০ হাজার ৮২৪ টাকা। (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছর ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে অর্ধ সা গমের বাজারমূল্য হিসাব করে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে যেহেতু অর্ধ সা পরিমাণ ফিতরাহ আদায়কে সুন্নাহ পরিপন্থি বলে প্রতীয়মান হয়, তাই সর্বনিম্ন সীমা হিসেবে এখানে অর্ধ সা’র পরিবর্তে এক সা’র হিসাব উল্লেখ করা হয়েছে।)

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরার পরিমাপের একক হিসেবে যব, খেজুর, কিশমিশ, ও পনিরের পরিমাণ এক সা সমান হিসাব করলেও গম বা আটার ক্ষেত্রে অর্ধ সা কেন হিসাব করে, তা আমার বোধগম্য নয়। যদি মুয়াবিয়া (রা.)- এর বিধানও এক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তাহলে সেই বিধানের পেছনের কারণটাও বিবেচনায় নিতে হবে। মুয়াবিয়া (রা.)-র সময়ে গমের বাজারমূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল বিধায় তিনি এক সা খেজুরের পরিবর্তে অর্ধ সা গমকে ফিতরার পরিমাপ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এখন গমের চেয়ে খেজুর, কিশমিশ ও পনিরের বাজারমূল্য কয়েক গুণ বেশি, যবের বাজারদরও গমের চেয়ে খানিকটা বেশি। তাই গমের ক্ষেত্রে অর্ধ সা হিসাব করা কোনও যুক্তিতেই সঠিক নয়।লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও উন্নয়ন গবেষক
মড়ড়হলড়যহৎ@মসধরষ.পড়স

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ফিতরা কী, কেন, কীভাবে?

আপডেট সময় : ০৬:০৫:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫

গুঞ্জন রহমান : ফিতরা বা ফেতরা আরবি শব্দ; যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের জাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাবার (ইৎবধশভধংঃ) বোঝানো হয়, যা দ্বারা রোজাদারগণ রোজা ভঙ্গ করেন। এই ফিতর বা ফাতুর থেকেই ইফতার শব্দটি এসেছে। জাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব দুস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে।

রোজা বা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা প্রাতরাশ গ্রহণ করা হয়। সেজন্য রমজান মাস শেষে এই দানকে জাকাতুল ফিতর বা ইফতারের জাকাত বলা হয়। মূলত, আল্লাহ পাক যে তাঁর বান্দাকে গোটা রমজান মাস ইফতার গ্রহণের তওফিক দান করলেন, তারই প্রতিদানস্বরূপ বান্দাকে ফিতরা প্রদান করতে হয়। ফিতরা প্রদানের বাধ্যবাধকতা আছে বিধায় রমজান শেষের ঈদটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই ঈদ উদযাপনের শর্তই হলো ফিতরা প্রদান করা। মহানবী (সা.) একাধিক হাদিসে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহের পথে রওনা হওয়ার আগেই ফিতরা প্রদান করতে আদেশ দিয়েছেন।

ফিতরা কার জন্য ওয়াজিব: াদাকাতুল ফিতর মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের জন্য আদায় করা ওয়াজিব। ইবনে ওমর বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতদের মধ্যে ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সবার ওপর মাথাপিছু এক সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব জাকাতুল ফিতর হিসাবে ওয়াজিব করেছেন এবং তা ঈদগাহে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন”। যদি কোনও ব্যক্তি ঈদের দিন সুবহে-সাদেকের পূর্বে মারা যায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। একইভাবে, যদি সুবহে সাদেকের পরে কোনও বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তার পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কোনও ব্যক্তি সুবহে সাদেকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনও শিশু সুবহে সাদিকের পূর্বে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তাদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব। সাদাকাতুল ফিতর হলো জানের সদকা, মালের নয়। অতএব, জীবিত সব মুসলিমের জানের সাদকা আদায় করা ওয়াজিব। কোনও ব্যক্তি রোজা পালনে সক্ষম না হলেও তার জন্য ফিতরা ওয়াজিব। সামর্থ্যহীন ব্যক্তি, যেমন শিশু, উপার্জনহীন নারী ও পুরুষ, বৃদ্ধ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ওপরও ফিতরা ওয়াজিব যদি তার কোনও অভিভাবক থেকে থাকেন, যিনি তার বা তাদের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। তবে একই পরিবারে বসবাসকারী উপার্জনকারী সদস্যরা, যেমন স্ত্রী, ছোট ভাই বা সন্তান যদি উপার্জনক্ষম হন, তাহলে তারা নিজ নিজ ফিতরা নিজেরাই নির্বাহ করবেন। অর্থাৎ, পরিবারের উপার্জনহীন ব্যক্তিদের পক্ষে উপার্জনকারী ব্যক্তিদের ফিতরা আদায় করতে হবে। একইভাবে, দাসপ্রথা যখন বলবৎ ছিল, তখন দাসদের পক্ষে তাদের মালিককে ফিতরা প্রদান করতে হতো। সেই হিসেবে কারও ওপর নির্ভরশীল কর্মচারী, যার নিজের ফিতরা প্রদানের সামর্থ্য নেই, তার পক্ষে ফিতরা প্রদানের দায়িত্ব উক্ত কর্মচারীর নিয়োগদাতা বা কর্মদাতার।
কার প্রতি ফিতরা প্রদান ওয়াজিব বা আবশ্যক নয় এবং কারা এই ফিতরা গ্রহণ করতে পারবেন: ফিতরা তারাই গ্রহণ করতে পারবেন, যাদের প্রতি ফিতরা প্রদান আবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ও তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারকে প্রতিদিনের ভরপেট ইফতারের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, তিনিই ফিতরার হকদার। ধরুন, আপনার বাসার কাজে সাহায্যকারী ব্যক্তি, যার পক্ষে আপনার প্রদেয় বেতনের টাকা দিয়ে পরিবারের সব সদস্যকে প্রতিদিন ভরপেট ইফতার করানো সম্ভব হয় না, সেই ব্যক্তিকে আপনি ফিতরা দিতে পারবেন। তবে ফিতরা যেন অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত হয়। অর্থাৎ, ফিতরার মাধ্যমে কারও পারিশ্রমিক মেটানো যাবে না। একইভাবে, গরিব, দুস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি; যাদের পক্ষে জাকাত ও সদকা গ্রহণ করা জায়েজ, তাদের ফিতরা প্রদান করা যাবে।
কারা ফিতরা পাওয়ার যোগ্য তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। একদল আলেম মনে করেন, যারা সাধারণভাবে সম্পদের জাকাতের হক্দার, তারা সকলেই ছাদাকাতুল ফিতরেরও হকদার। তাদের যুক্তি হলো, ফিতরাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) জাকাত ও ছাদাকা বলেছেন। তাই যেটা সম্পদের জাকাতের খাত হবে, সেটা ফিতরারও খাত হবে। ছাদাকার যেই খাতগুলো আল্লাহ পাক সুরা তওবা’য় উল্লেখ করেছেন, সেই খাতগুলো ছাদাকাতুল ফিতরের জন্যও প্রযোজ্য হবে। সুরা তওবা’য় নির্দেশিত হিসাব অনুসারে আট প্রকার লোক ছাদাকাতুল ফিতরের হকদার। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ছাদাকাহ কেবল দরিদ্র, মিসকিন, (ও ছাদাকাহ্) আদায়ের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, (এবং) যাদের অন্তরে প্রীতি স্থাপন করা হয়, বন্দি মুক্ত করার জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরের জন্য, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরজ। আর আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’ (আত-তওবা, ৯/৬০)।
আরেক দল আলেম মনে করেন, ছাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা কেবল ফকির-মিসকিনদের হক; অন্যদের নয়। তাদের যুক্তি হলো, ইবনু আব্বাস (রা.) কর্তৃক হাদিস, যেখানে সাহাবী বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ পাক জাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন সিয়াম পালনকারীর অশ্লীলতা ও অনর্থক ক্রিয়াকলাপ হতে পবিত্রতা রক্ষার জন্য এবং মিসকিনদের আহারস্বরূপ…।’

যেহেতু উপর্যুক্ত হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে, ‘মিসকিনদের আহারস্বরূপ’; সেহেতু দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও অভাবগ্রস্তকেই ফিতরা প্রদান করতে হবে। ওই মতকে সমর্থন করেছেন ইবনু তায়মিয়া, ইবনুল কাইয়িম, শাওকানি, আযিমাবাদী, ইবনু উছায়মিনসহ আরও অনেকে। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে, এই মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ এই মতের পক্ষে স্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ বিদ্যমান।
উল্লেখ্য, কারো অধীনস্থ কর্মচারী বা বেতনভুক্ত সাহায্যকারীকে বেতনের পরিবর্তে ফিতরা দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বেতনসহ ফিতরা দেওয়া যেতে পারে। ফিতরার খাদ্যসমূহের মধ্যে মসজিদ, মাদরাসা অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম যদি ফকির-মিসকিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তারা ফিতরার দাবিদার হবেন।

বরং তারা অন্যান্য ফকির-মিসকিনদের থেকেও অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ, এরা দ্বীনের শিক্ষা অর্জনে ও অন্যকে শিক্ষাদানে নিয়োজিত, যে গুণটি অন্যান্য ফকির-মিসকিনের নেই।
সা এবং অর্ধ সা: ফিতরা প্রদানের পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় ‘সা’ বহুল আলোচিত শব্দ। মাঝারি দেহের অধিকারী মানুষের হাতের চার আঁজলা পরিমাণ এক ‘সা’ হয় (অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি একত্র করে চার আঁজলা বা অঞ্জলিতে যে পরিমাণ খাবার ওঠে, সেটিই এক ‘সা’)। আরবিতে ‘সা’ নির্দিষ্ট পরিমাপের একটি পাত্রকে বলা হয়; যার দ্বারা দানা জাতীয় শস্য মাপা হয়। বাংলাদেশে যেমন এক সময় ধান পরিমাপের জন্য কাঠা, তেল বা দুধ পরিমাপের জন্য ‘পোয়া’ ব্যবহৃত হতো। এখনো তেল পরিমাপের জন্য গ্যালন ব্যবহৃত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি একটি পাত্রের নাম সা।

জাকাতুল ফিতর হিসাবে প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক সা খাদ্যশস্যের হিসাব বের করতে গেলে দেখা যায়, নবী করিম (সা.)-এর যুগের এক সা পরিমাণ হলো, সবচেয়ে ভালো গমের ক্ষেত্রে এটি ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ। মনে রাখতে হবে, সা কোনো বাটখারা নয়; বরং এটি একটি পাত্রবিশেষ। তাই বিভিন্ন ফসলের জন্য সা-এর ওজন বিভিন্ন হয়। এক বাটি চাল এবং এক বাটি মুড়ির ওজনে তারতম্য হবে– এটা সাধারণ জ্ঞান দ্বারাই বোঝা যায়। তাই ফিতরার পরিমাণ হিসেবে সা বিবেচনা করা হয় নির্দিষ্ট শস্যের পরিমাপে। এক সা সমান চাল প্রায় ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হয়। কিন্তু এক সা গম, যব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি ২ কেজি ২২৫ গ্রামের বেশি হয় না। ইরাকি এক সা সমান ২ কেজি ৪০০ গ্রাম অথবা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলি চাল। বাংলাদেশে এক সা সমান ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম আটা পরিমাপ করা হয়।

ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ এক সা নাকি অর্ধ সা: বিভিন্ন হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়– হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এক সা পরিমাণ ফিতরা প্রদানের কথা বলেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং চার খলিফা (রা.)-এর মৃত্যুর পরে ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন মুআবিয়া (রা.)। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী সৌদি আরবের মদিনা থেকে সিরিয়ার দামেস্ক শহরে স্থানান্তর করেন। তখন তারা গমের সাথে পরিচিত হন। সেই যুগে সিরিয়ায় গমের মূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) একদা হজ বা উমরা করার সময় মদিনায় আসার পর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি’। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে মুসলিম জনগণের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু ফিতরার পরিমাণ অর্ধ সা নির্ধারণ করা আসলে ঠিক নয়। কারণ মহানবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনও অর্ধ সা ফিতরা দেননি বা দেওয়াটা অনুমোদন করেননি। তিনি এমনকি অর্থমূল্যেও ফিতরা দেননি কখনো; বরং যব, খেজুর, পনির বা কিশমিশ ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য ফিতরা হিসেবে প্রদান করেছেন। তাই খেজুরের সাথে গমের দামের তারতম্য হিসাব করে, সেই অনুসারে অর্ধ সা গমের দামে ফিতরা পরিমাপ করলে তা মূলত মহানবীর (সা.) নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে।
বিশিষ্ট সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রা.)-সহ অন্যান্য সাহাবীরা মুয়াবিয়ার এই ‘ইজতিহাদী’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের ওপরই কায়েম থাকেন। যারা অর্ধ সা গম দ্বারা ফিতরা আদায় করেন, তারা মুয়াবিয়ার রায়ের অনুসরণ করেন মাত্র। অর্ধ সা ফিতরা আদায় করা সুন্নাতবিরোধী কাজ।

রাসুলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর নির্দেশের লঙ্ঘনকারীদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করেছেন। মিস‘আর ইবনে কিদাম (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি সা’দ ইবনে ইবরাহীমকে বলতে শুনেছি, কেবল বিশ্বস্ত ব্যক্তিরাই আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাঁর ওপর আশীর্বাদ করুন এবং তাঁকে শান্তি দান করুন অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস গ্রহণ করা যাবে না। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে বেশি বেশি বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকবে। যে ব্যক্তি আমার ওপর কোনও কথা আরোপ করবে, সে যেন কেবল হক বা সত্য বলে। আর যে ব্যক্তি আমার ওপর এমন কোনও কথা আরোপ করবে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নিল।’

দান বা ছাদাকাহ দেওয়ার উপাদান নির্ধারণ প্রসঙ্গে অপর এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আর তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প করিও না, যখন তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত নও’। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রবর্তিত ফিতরার পরিমাণ অন্য কারও নির্দেশে পরিবর্তন করা গর্হিত অন্যায়। তিনি যেখানে খাদ্যের উৎকৃষ্ট উপাদানের দ্বারা দান করতে বলেছেন, সেখানে পরিমাণও হওয়া আবশ্যক উৎকৃষ্ট পরিমাণ।

ইমাম নবভি (রা.) বলেন, ‘সুতরাং অর্ধ সা ফিতরা আদায় করা সুন্নাহর খেলাপ। রাসুল (সা.) জাকাতের ও ফিতরার যে হার নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা রদবদল করার অধিকার কারো নেই। এ ব্যাপারে ওমর (রা.) একটি ফরমান লিখে আমর ইবনে হাযম (রা.)-এর কাছে পাঠান যে, জাকাতের নিছাব ও প্রত্যেক নিছাবে জাকাতের যে হার, তা চিরদিনের জন্য আল্লাহ তার রাসুলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এতে কোনও যুগে, কোনও দেশে (ফিতরার পরিমাণ) কমবেশি অথবা রদবদল করার অধিকার কারো নেই।’
ফিতরার পরিমাণ হিসেবে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের কারণ কী: যেহেতু ফিতরা প্রদান করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ওয়াজিব, সেহেতু সামর্থ্যের তারতম্য অনুসারে ফিতরার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন অর্থমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যে ক’টি খাদ্যপণ্যের দ্বারা মহানবী (সা.) ফিতরা প্রদান করেছেন, সেই পণ্যগুলোর দামের সর্বোচ্চ সীমা ও সর্বনিম্ন সীমাকে ফিতরার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পরিমাণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেমন, যদি চলতি বছর বাংলাদেশে এক সা পরিমাণ (৩.৩ কেজি) উৎকৃষ্ট মানের পনিরের সর্বোচ্চ মূল্য (৩.৩০ কেজি দ্ধ ৮২০ টাকা) ২৭০৬ টাকা ধার্য করা হয়, তাহলে সেই হিসাবে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ফিতরা হবে ২৭০০ টাকা; এবং এক সা পরিমাণ উৎকৃষ্ট মানের আটার সর্বোচ্চ মূল্য (৩.৩০ কেজি দ্ধ ৬০ টাকা) ১৯৮ টাকা টাকা ধার্য করা হলে, মাথাপিছু সর্বনিম্ন ফিতরা ১৯৮ টাকা।

আপনার পরিবারে যদি আপনার ওপর নির্ভরশীল সদস্য তিন জন থেকে থাকেন, তবে নিজসহ আপনার ওপর ওয়াজিব সাদাকাতুল ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত হবে ১৯৮ী৪ = ৭৯২ টাকা। কিন্তু যদি আপনার আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে প্রদান করতে হবে ২৭০৬ী৪ = ১০ হাজার ৮২৪ টাকা। (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতি বছর ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে অর্ধ সা গমের বাজারমূল্য হিসাব করে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে যেহেতু অর্ধ সা পরিমাণ ফিতরাহ আদায়কে সুন্নাহ পরিপন্থি বলে প্রতীয়মান হয়, তাই সর্বনিম্ন সীমা হিসেবে এখানে অর্ধ সা’র পরিবর্তে এক সা’র হিসাব উল্লেখ করা হয়েছে।)

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরার পরিমাপের একক হিসেবে যব, খেজুর, কিশমিশ, ও পনিরের পরিমাণ এক সা সমান হিসাব করলেও গম বা আটার ক্ষেত্রে অর্ধ সা কেন হিসাব করে, তা আমার বোধগম্য নয়। যদি মুয়াবিয়া (রা.)- এর বিধানও এক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তাহলে সেই বিধানের পেছনের কারণটাও বিবেচনায় নিতে হবে। মুয়াবিয়া (রা.)-র সময়ে গমের বাজারমূল্য খেজুরের দ্বিগুণ ছিল বিধায় তিনি এক সা খেজুরের পরিবর্তে অর্ধ সা গমকে ফিতরার পরিমাপ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এখন গমের চেয়ে খেজুর, কিশমিশ ও পনিরের বাজারমূল্য কয়েক গুণ বেশি, যবের বাজারদরও গমের চেয়ে খানিকটা বেশি। তাই গমের ক্ষেত্রে অর্ধ সা হিসাব করা কোনও যুক্তিতেই সঠিক নয়।লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও উন্নয়ন গবেষক
মড়ড়হলড়যহৎ@মসধরষ.পড়স