ঢাকা ০২:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ফসলি জমি গ্রাস করে নগরায়ণ, নাজুক খাদ্যনিরাপত্তা

  • আপডেট সময় : ১২:৪৮:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১
  • ৩০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুর জেলায় এক দশক আগে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৭ হাজার হেক্টর। ১০ বছরে এ এলাকায় নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কমেছে ২৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নারায়ণগঞ্জের চিত্র আরও ভয়াবহ। ফসল উৎপাদন কমে খাদ্য ঘাটতির জেলা বাড়ছেই। শুধু ঢাকা শহরে খাদ্য ঘাটতি প্রায় ১৬ লাখ টন। ভৌত পরিকল্পনার অভাব ও অপরিকল্পিত শহরায়ণ এর অন্যতম কারণ।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মর্তুজা আলী বলেন, একসময় গাজীপুর জেলা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এখন ফসলি জমি কমে যাওয়ায় খাদ্য ঘাটতির জেলা।
একটি সংবাদসংস্থার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজধানী ঢাকা যেমন বড় হয়েছে, তেমনি সম্প্রসারিত হয়েছে আশপাশের জেলাও। রাজধানীর শহুরে হাওয়া সেখানে পরিবর্তন এনেছে, দ্রুত বেড়েছে বাসযোগ্যতা। আবার রাজধানীকেন্দ্রিক বেশকিছু জোগানের বাড়তি চাপও রয়েছে ওইসব শহরে। তাতে আবার অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপন বেড়েছে। নিজস্ব কৃষির সমৃদ্ধি বিলীন হয়ে গেছে দিনের পর দিন।
নিজস্ব কৃষি সমৃদ্ধির দিক থেকে গাজীপুরের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা নারায়ণগঞ্জের। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের শিল্পঐতিহ্য ছিল, এখন আবার রাজধানীর শহুরে হাওয়া বইছে জোরেশোরে। তাতে বর্তমানে এ জেলার ফসলি জমি নেমেছে মাত্র ৩৬ হাজার ৪৫৮ হেক্টরে। যা ১৯৯৯ সালে জেলার পরিসংখ্যানে ৫৫ হাজার ৯৭৯ হেক্টর ছিল। এ জেলার সদর উপজেলা, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ এবং বন্দর এলাকায় প্রচুর জমি শহরায়নে ব্যবহার হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নের জন্য নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা। ফলে সে বিষয় সামনে রেখেই ভৌত পরিকল্পনার প্রয়োজন। কিন্তু সেটার অভাবে ‘অপরিকল্পিত’ শহরায়ন চলছে। দ্রুত কমছে ফসলি জমি। এদিকে বাংলাদেশে শহর যত বড়, সেখানে নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা ততটাই দুর্বল। কারণ কৃষিজমি গ্রাস করেই এ শহরায়ন হয়েছে। এজন্য ঢাকা শহরের খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। এ শহরে খাদ্যের জন্য গুনতে হয় চড়া মূল্য। তথ্য বলছে, বছরে ঢাকা শহরের খাদ্যশস্যের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৪ হাজার টন। যেখানে এ জেলার মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের সক্ষমতা মাত্র ২ লাখ ৫৫ হাজার টন। অর্থাৎ বছরে ১৫ লাখ ৮৯ হাজার টন খাদ্যের ঘাটতি মেটাতে হয় ঢাকা শহরকে। আশপাশের জেলাগুলোও খাদ্য ঘাটতিতে চলে যাওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসে এসব খাদ্য। যার জন্য বেড়ে যায় দাম। তথ্য বলছে, ১ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টরের ঢাকা জেলার ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ জমি শহরায়নে ব্যবহার হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু বসতবাড়ি ও আবাসন প্রকল্প রয়েছে ৪১ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে। এছাড়া রাস্তাঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে ১১ হাজার ৬০৮ হেক্টরে। আর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৩ হাজার ৮৯০ হেক্টরে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহর বা শিল্পায়নের জন্য সীমিত পরিসরে কৃষিজমি ব্যবহার হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব ফসলি জমি গ্রাস করা হচ্ছে। যে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে যেখানে-সেখানে কলকারখানা বা আবাসন প্রকল্প করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব বেশি।
‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয়েছিল ২০১১ সালে। সেটা এখনো আটকে আছে। কিছু পুরোনো আইন নিয়ে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে তাদেরও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট মানুষদের সঙ্গে এসব সংস্থা পেরে উঠছে না। কার্যকর ও সময়োপযোগী আইনের অভাবে নির্বিচারে দখল চলছে।’
জানা যায়, এক দশক বাদেও অগ্রগতি নেই কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের। যদিও সরকারের বিভিন্ন মহল বারবার দাবি করছে, শিগগির আইন হবে, আর তাতে একদিকে যেমন জমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধ হবে, অন্যদিকে সুনিশ্চিত হবে উন্নয়নের গতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) মুহাম্মদ সালেহউদ্দীন বলেন, এখনো আইনটি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। কবে চূড়ান্ত হবে বলা যাচ্ছে না। কেন এত দীর্ঘ কালক্ষেপণ- এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দীন বলেন, আইন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় বারবার। আবার আইনটি বারবার ভিন্ন ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ধারায় পরিবর্তন করা হয়। আগে ভূমি সুরক্ষা আইন ছিল, এখন ভূমি ব্যবহার আইন হয়েছে। নতুন নতুন ধারা এসেছে, সেসব সংশোধন হচ্ছে বারবার। সবমিলেই দেরি হচ্ছে। একটি আইনের অনেক পদ্ধতিগত জটিলতা থাকে।
সামগ্রিকভাবে দেশে দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের আবাসস্থল তৈরিতে মোট আবাদ করা জমির বড় অংশ প্রতি বছর কমে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৭ অনুযায়ী দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। আর পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, প্রতিবছর দেশে কৃষিজমি কমছে ৮২ হাজার হেক্টর, যা মোট জমির ১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছে, এ অবস্থায় জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সীমিত আয়তনের বাংলাদেশে জমি খুবই মূল্যবান। আবাদি জমি যেভাবে কমছে, তাতে দেশে আগামীতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই সারা দেশে জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপেক্ষিতে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হলে কোনো উন্নয়ন কাজে আসবে না।
‘বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে নগরায়ণের সঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতাও রক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে আগে পরিকল্পনা হচ্ছে। এখানেও সে ধরনের সমন্বয় করে পরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে তুলতে হবে।’ নাজনীন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ঘোষণা ‘গ্রাম হবে শহর’ তাতে কিন্তু গ্রামের সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ন রেখে শহরের সুবিধাগুলো যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সবকিছু শুধু শহরের মতো হলে চলবে না। বর্তমান পেক্ষাপটে বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষিজমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় খাল কেটে মরুভূমিতে ফলানো হচ্ছে ফসল। বাংলাদেশের প্রতিযোগী খাদ্য চাল উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনামে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে জমির ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কৃষিজমি রক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন টেকসই উন্নয়নের কার্যক্রম প্রয়োজন বলেও মত দেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। এদিকে ফসলি জমি রক্ষায় কৃষি, ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। চলতি বছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মূলত কৃষি মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়। যা বাস্তবায়ন হলে ফসলি জমিতে শিল্প বা নগরায়ণ করা যাবে না। এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। এজন্য সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বিএআরসির চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। কিন্তু কৃষিজমি কমে গেলে খাদ্যনিরাত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। এজন্য কৃষিজমি রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাব তৈরি করছি। কাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। জানা যায়, এ কার্যক্রমে এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে উপজেলাভিত্তিক কৃষিজমি চিহ্নিত করে তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ওই তালিকার ভিত্তিতে কোন জমি কীভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অধিক ফসলি জমিতে কোনো স্থাপনা করা যাবে না। এদিকে গত ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি সংরক্ষণ করে উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে তিনি একাধিক দফায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে বলেছেন নীতিনির্ধারকদের।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ফসলি জমি গ্রাস করে নগরায়ণ, নাজুক খাদ্যনিরাপত্তা

আপডেট সময় : ১২:৪৮:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুর জেলায় এক দশক আগে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৭ হাজার হেক্টর। ১০ বছরে এ এলাকায় নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কমেছে ২৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নারায়ণগঞ্জের চিত্র আরও ভয়াবহ। ফসল উৎপাদন কমে খাদ্য ঘাটতির জেলা বাড়ছেই। শুধু ঢাকা শহরে খাদ্য ঘাটতি প্রায় ১৬ লাখ টন। ভৌত পরিকল্পনার অভাব ও অপরিকল্পিত শহরায়ণ এর অন্যতম কারণ।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মর্তুজা আলী বলেন, একসময় গাজীপুর জেলা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। এখন ফসলি জমি কমে যাওয়ায় খাদ্য ঘাটতির জেলা।
একটি সংবাদসংস্থার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজধানী ঢাকা যেমন বড় হয়েছে, তেমনি সম্প্রসারিত হয়েছে আশপাশের জেলাও। রাজধানীর শহুরে হাওয়া সেখানে পরিবর্তন এনেছে, দ্রুত বেড়েছে বাসযোগ্যতা। আবার রাজধানীকেন্দ্রিক বেশকিছু জোগানের বাড়তি চাপও রয়েছে ওইসব শহরে। তাতে আবার অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপন বেড়েছে। নিজস্ব কৃষির সমৃদ্ধি বিলীন হয়ে গেছে দিনের পর দিন।
নিজস্ব কৃষি সমৃদ্ধির দিক থেকে গাজীপুরের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা নারায়ণগঞ্জের। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের শিল্পঐতিহ্য ছিল, এখন আবার রাজধানীর শহুরে হাওয়া বইছে জোরেশোরে। তাতে বর্তমানে এ জেলার ফসলি জমি নেমেছে মাত্র ৩৬ হাজার ৪৫৮ হেক্টরে। যা ১৯৯৯ সালে জেলার পরিসংখ্যানে ৫৫ হাজার ৯৭৯ হেক্টর ছিল। এ জেলার সদর উপজেলা, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ এবং বন্দর এলাকায় প্রচুর জমি শহরায়নে ব্যবহার হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নের জন্য নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা। ফলে সে বিষয় সামনে রেখেই ভৌত পরিকল্পনার প্রয়োজন। কিন্তু সেটার অভাবে ‘অপরিকল্পিত’ শহরায়ন চলছে। দ্রুত কমছে ফসলি জমি। এদিকে বাংলাদেশে শহর যত বড়, সেখানে নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা ততটাই দুর্বল। কারণ কৃষিজমি গ্রাস করেই এ শহরায়ন হয়েছে। এজন্য ঢাকা শহরের খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। এ শহরে খাদ্যের জন্য গুনতে হয় চড়া মূল্য। তথ্য বলছে, বছরে ঢাকা শহরের খাদ্যশস্যের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৪ হাজার টন। যেখানে এ জেলার মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের সক্ষমতা মাত্র ২ লাখ ৫৫ হাজার টন। অর্থাৎ বছরে ১৫ লাখ ৮৯ হাজার টন খাদ্যের ঘাটতি মেটাতে হয় ঢাকা শহরকে। আশপাশের জেলাগুলোও খাদ্য ঘাটতিতে চলে যাওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসে এসব খাদ্য। যার জন্য বেড়ে যায় দাম। তথ্য বলছে, ১ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টরের ঢাকা জেলার ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ জমি শহরায়নে ব্যবহার হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু বসতবাড়ি ও আবাসন প্রকল্প রয়েছে ৪১ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে। এছাড়া রাস্তাঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে ১১ হাজার ৬০৮ হেক্টরে। আর শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৩ হাজার ৮৯০ হেক্টরে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহর বা শিল্পায়নের জন্য সীমিত পরিসরে কৃষিজমি ব্যবহার হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব ফসলি জমি গ্রাস করা হচ্ছে। যে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে যেখানে-সেখানে কলকারখানা বা আবাসন প্রকল্প করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব বেশি।
‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয়েছিল ২০১১ সালে। সেটা এখনো আটকে আছে। কিছু পুরোনো আইন নিয়ে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে তাদেরও সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট মানুষদের সঙ্গে এসব সংস্থা পেরে উঠছে না। কার্যকর ও সময়োপযোগী আইনের অভাবে নির্বিচারে দখল চলছে।’
জানা যায়, এক দশক বাদেও অগ্রগতি নেই কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের। যদিও সরকারের বিভিন্ন মহল বারবার দাবি করছে, শিগগির আইন হবে, আর তাতে একদিকে যেমন জমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধ হবে, অন্যদিকে সুনিশ্চিত হবে উন্নয়নের গতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) মুহাম্মদ সালেহউদ্দীন বলেন, এখনো আইনটি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। কবে চূড়ান্ত হবে বলা যাচ্ছে না। কেন এত দীর্ঘ কালক্ষেপণ- এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দীন বলেন, আইন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় বারবার। আবার আইনটি বারবার ভিন্ন ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ধারায় পরিবর্তন করা হয়। আগে ভূমি সুরক্ষা আইন ছিল, এখন ভূমি ব্যবহার আইন হয়েছে। নতুন নতুন ধারা এসেছে, সেসব সংশোধন হচ্ছে বারবার। সবমিলেই দেরি হচ্ছে। একটি আইনের অনেক পদ্ধতিগত জটিলতা থাকে।
সামগ্রিকভাবে দেশে দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের আবাসস্থল তৈরিতে মোট আবাদ করা জমির বড় অংশ প্রতি বছর কমে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৭ অনুযায়ী দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। আর পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, প্রতিবছর দেশে কৃষিজমি কমছে ৮২ হাজার হেক্টর, যা মোট জমির ১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছে, এ অবস্থায় জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সীমিত আয়তনের বাংলাদেশে জমি খুবই মূল্যবান। আবাদি জমি যেভাবে কমছে, তাতে দেশে আগামীতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই সারা দেশে জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিপেক্ষিতে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হলে কোনো উন্নয়ন কাজে আসবে না।
‘বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে নগরায়ণের সঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতাও রক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে আগে পরিকল্পনা হচ্ছে। এখানেও সে ধরনের সমন্বয় করে পরিকল্পিত নগরায়ণ গড়ে তুলতে হবে।’ নাজনীন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ঘোষণা ‘গ্রাম হবে শহর’ তাতে কিন্তু গ্রামের সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ন রেখে শহরের সুবিধাগুলো যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সবকিছু শুধু শহরের মতো হলে চলবে না। বর্তমান পেক্ষাপটে বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষিজমি সুরক্ষিত করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় খাল কেটে মরুভূমিতে ফলানো হচ্ছে ফসল। বাংলাদেশের প্রতিযোগী খাদ্য চাল উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনামে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে জমির ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে কৃষিজমি রক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন টেকসই উন্নয়নের কার্যক্রম প্রয়োজন বলেও মত দেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। এদিকে ফসলি জমি রক্ষায় কৃষি, ভূমি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। চলতি বছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মূলত কৃষি মন্ত্রণালয় এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়। যা বাস্তবায়ন হলে ফসলি জমিতে শিল্প বা নগরায়ণ করা যাবে না। এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। এজন্য সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বিএআরসির চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। কিন্তু কৃষিজমি কমে গেলে খাদ্যনিরাত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। এজন্য কৃষিজমি রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাব তৈরি করছি। কাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। জানা যায়, এ কার্যক্রমে এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি চিহ্নিত করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে উপজেলাভিত্তিক কৃষিজমি চিহ্নিত করে তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ওই তালিকার ভিত্তিতে কোন জমি কীভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অধিক ফসলি জমিতে কোনো স্থাপনা করা যাবে না। এদিকে গত ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি সংরক্ষণ করে উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে তিনি একাধিক দফায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে বলেছেন নীতিনির্ধারকদের।