ঢাকা ১০:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাপ্তি-প্রাপ্তির বছর ২০২৪

  • আপডেট সময় : ০৫:৪৮:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৩৪ বার পড়া হয়েছে

দেশের নারীরা আশা-হতাশা আর অর্জনের মধ্যে হয়েছেন সম্মানিত
দেখতে দেখতে বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে ২০২৪ সালের। বরাবরের মতো এ বছরটাও শেষ হচ্ছে নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা আর অর্জনের মধ্য দিয়ে। দেশে এবং দেশের বাইরে আমাদের নারীরা সম্মানিত হয়েছেন মানবতা, জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের কাজ দিয়ে।
ক্রীড়া জগতে কখনো কখনো সাফল্যের ঝলকানি দেখেছি আমরা। দেখেছি ছাদ খোলা বাসে বিজয়ের আনন্দ উদ্যাপনের দৃশ্য। কিন্তু এই উদযাপন কি দেশের ৫৫ ফেডারেশনের ৫৪টিতে নারী খেলোয়াড়দের সাফল্যের কথা তুলে ধরে?
টানা দ্বিতীয়বার জয়: বছরের প্রথম

কয়েকটি মাসে ছিল না বড় কোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট। জুলাই-আগস্ট কেটেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে নেমে আসে স্থবিরতা। সেই স্থবির দশা কেটে যায় দারুণ এক জয়ে। নেপালের কাঠমান্ডুতে সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিকদের হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। আনন্দে উদ্বেলিত ফুটবলপ্রেমীরা দারুণভাবে বরণ করে নেয় সামিনাদের। আসে একের পর এক পুরস্কারের ঘোষণা। সাফ জয়ের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে ক্রীড়াঙ্গনে।
মৃত্যু: একদিকে মেয়েদের সাফ জয়, অন্যদিকে দুই নারী ফুটবলার নুরজাহান আক্তার মিথিলা ও রাজিয়া সুলতানার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। এ দুই ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনের প্রাপ্তির একাংশে মেখে দেয় মলিনতা। ‘দয়া করে আপনারা সহায়তার হাত বাড়ান, আমি বাঁচতে চাই’— গত ৬ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে করা মিথিলার আকুতিকে কজনই গুরুত্ব দিয়েছে। এরপর গত মার্চে প্রসবকালীন জটিলতায় অনন্তলোকের পথে হেঁটেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা। তবে মিথিলার সেদিনের আর্তনাদ আজও অনেকের চোখে জল এনে দেয়।
নারী ফুটবলার নুরজাহান আক্তার মিথিলা: বাঁচার আকুতি জানিয়ে মিথিলা ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘আমি অনেক অসুস্থ। শ্যামলী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

আমার বাবা প্রায় লাখ টাকা খরচ করেছেন, এখন আর পারছেন না। টাকার অভাবে ওষুধও ঠিকমতো খেতে পারছি না। আমি বাঁচতে চাই। হার্টে পানি জমেছে। ফুসফুসে সমস্যা। শ্বাসনালিতে ইনফেকশন। অক্সিজেন লেভেলও কম। অক্সিজেন মেশিন কিনতে হবে, মূল্য ৩৫ হাজার টাকা। অত টাকা কোথায় পাব! প্লিজ, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।’
স্বর্ণজয়ী শুটার সাদিয়া সুলতানা: হুট করেই চলে যান এসএ গেমস স্বর্ণজয়ী শুটার সাদিয়া সুলতানা। জীবনের শেষ দিনগুলো নিজের পাওয়া মেডেলগুলো দেখেই কাটিয়েছেন।

মানসিক অবসাদ আর তাকে প্রিয় শুটিং রেঞ্জে ফিরতে দেয়নি। তার মৃত্যুতেও ক্রীড়াঙ্গনে নামে শোকের ছায়া।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ক্রীড়া সংস্কারে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে গড়ার কাজটা মন দিয়ে শুরু করে। এ জন্য সব ফেডারেশন সভাপতি ছেঁটে ফেলা হয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় খেলাধুলায় ছিল না স্বাভাবিক অবস্থা। এর মাঝেও সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। তিনি নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সপ্তম আন্তঃসার্ভিস ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ৭১ কেজি ওজন শ্রেণিতে প্রথম স্থান ধরে রাখার পাশাপাশি রেকর্ডও গড়েন। ভারোত্তোলনের দুটি অংশ—ক্লিন ও জার্ক। দুই বিভাগেই তিন কেজি করে বেশি তোলেন তিনি। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১১১ কেজি উত্তোলন করেন। ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন সীমান্ত। গত এক দশকে অনেক চ্যাম্পিয়ন ও রেকর্ড গড়েছেন-ভেঙেছেন। তাই নিজের কীর্তি নিজেরই এখন মনে রাখা কষ্টকর। এ কথাটিই শোনা গেল তার কণ্ঠে, ‘ঠিক মনে নেই, কতবার রেকর্ড হলো বা ভাঙলাম। যত দিন খেলব তত দিনই রেকর্ড করতে চাই।’
উর্মি আক্তার: বছরের শেষ দিকে ঢাকায় আন্তর্জাতিক জুনিয়র ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ছিল ইন্দোনেশিয়ায় জয়জয়কার। দেশের মেয়েরা ফাইনালেও যেতে পারেননি।

এরপর সিনিয়র পর্যায়েও ভালো করতে পারেননি মেয়েরা। প্রথম দিনেই বাংলাদেশের নারী জাতীয় চ্যাম্পিয়ন উর্মি আক্তার একক ইভেন্টে হেরে যান। যে হার নিয়ে তার ব্যাখ্যা ছিল, ‘আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এরপরও যতটুকু সম্ভব লড়াই করেছি।’
হকির অধিনায়ক অর্পিতা পাল: ওই হারের কয়েকদিন আগে ওমানের মাসকটে নারীদের জুনিয়র এশিয়া কাপ হকিতেও হতাশ করেন মেয়েরা। যেখানে ছেলেরা পঞ্চম হয়ে প্রথমবারের মতো জুনিয়র হকির বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিলেন, সেখানে মেয়েরা সপ্তম হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরেন। এ জন্য অবশ্য প্রস্তুতির ঘাটতিকেই দুষেছেন জুনিয়র হকির অধিনায়ক অর্পিতা পাল। তিনি বলেছেন, ‘আসলে আমরা শুরুর দিকে যাদের সঙ্গে খেলেছিলাম তাদের বিপক্ষে আগে কখনো খেলিনি। তাদের খেলাও দেখা হয়নি। এ জন্য মাঠে নেমে একটু ধরে খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের কিছু কিছু টেকনিকের সঙ্গে আমরা কুলিয়ে উঠিনি। এরপর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ম্যাচগুলোতে আগের তুলনায় ভালো খেলেছিলাম। যদিও জিততে পারিনি। শেষ ম্যাচটা সব দিক থেকে ভালো হয়। তবে প্রস্তুতিা আমাদের পরিপূর্ণ হয়নি।’
নকশাকার করেছিলেন মেরিনা তাবাসসুম: সুলতানি আমলের স্থাপত্যরীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১২ সালে নির্মিত ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের নকশা করেছিলেন মেরিনা তাবাসসুম। এ জন্য এ বছর টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন তিনি।

এ জন্য ৮ ডিসেম্বর জনপ্রিয় অনলাইন ম্যাগাজিন ‘ডিজেন’ কর্তৃক ‘ডিজেন আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয় মেরিনার প্রতিষ্ঠান ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস’। প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।
সারাফ নাওয়ার: আর্কিটেকচারে মর্যাদাপূর্ণ ইন্সপাইরেলি পুরস্কার জিতেছেন সারাফ নাওয়ার। তার প্রকল্পের নাম ‘টেল অব অ্যান ওশান: ওশানেরিয়াম কমপ্লেক্স অ্যাট সোনাদিয়া’। প্রকল্পটি স্থাপত্যের মাধ্যমে পরিবেশের স্থিতিশীলতার কথা বলে।
রিকতা আখতার বানু লুৎফা: প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের রিকতা আখতার বানু লুৎফা। চিলমারীর এই নারী নিজের সর্বস্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। সেখানে এখন তিন শর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এ কাজের জন্য রিকতা বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।
রেসিং ড্রাইভার কাশফিয়া আরফা: এ বছর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে দেশের প্রথম নারী রোবোটিকস দল কোড ব্ল্যাক। এর সদস্যরা সবাই উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে সবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী রেসিং ড্রাইভার হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন কাশফিয়া আরফা।
বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী: ভিয়েতনামের ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজ পেয়েছেন বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। কলেরা, টাইফয়েড ও হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) সুলভ মূল্যের টিকা উদ্ভাবনে অবদান রাখায় তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
নুশরাত ইসলাম তৃষা: দেশে এখনো বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি। বাগেরহাটের প্রজাপতি স্কোয়াডের কিশোরীরা বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে। নারীদের প্রতি হওয়া সব ধরনের বৈষম্যের অবসান চায় এই প্রজাপতিরা। এই দলের নুশরাত ইসলাম তৃষা এ বছর মনোনীত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শিশুশান্তি পুরস্কারের জন্য।
জ্যাতির্বিজ্ঞানী ড. লামিয়া আশরাফ মওলা: জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ নামের একটি নতুন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের এই দলে রয়েছেন বাংলাদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. লামিয়া আশরাফ মওলা।
শারমীন আক্তার: নিভৃতচারী হয়ে কাজ করছেন কুতুবদিয়ার শারমীন আক্তার। তিনি গ্রামের নারীদের জন্য মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ, বসতবাড়িতে শাকসবজি চাষ, সঞ্চয় ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে চলেছেন।
শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা: জুলাই মাসের উত্তাল আন্দোলনের দিনেও থেমে থাকেননি অর্থী জুখরীফের মতো চিকিৎসকরা। পুলিশের গাড়ির সামনে রুখে দাঁড়াতে একবারও বুক কাঁপেনি নুসরাত জাহান টুম্পার মতো শিক্ষার্থীদের।
বাইসাইকেলিস্ট তানজিনা মিতু: বাইসাইকেলে চেপে ৬৪ জেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন কুমিল্লার মেয়ে তানজিনা মিতু।
ইয়াসমিন লিসা, তাহেরা সুলতানা রেখা, ট্রেকার এপি তালুকদার ও অর্পিতা দেবনাথ: নেপালের লাংটা হিমালয়ের তিনটি পর্বতের শিখর আরোহণ অভিযানে গেছেন দেশের পাঁচ নারী পর্বতারোহী। পর্বতারোহী নিশাত মজুমদারের নেতৃত্বে ‘সুলতানাজ ড্রিম অনবাউন্ড’ নামের এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী অন্য সদস্যরা হলেন পর্বতারোহী ইয়াসমিন লিসা, তাহেরা সুলতানা রেখা, ট্রেকার এপি তালুকদার ও অর্পিতা দেবনাথ।
নারী উদ্যোক্তা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় তৈরি হয়েছে অনেক নারী উদ্যোক্তা।

এর পাশাপাশি গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পারলার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য এবং হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতেও নারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
সামষ্টিক ভীতি: অর্জন, প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার গল্পের সমান্তরালে বয়ে চলেছে সহিংসতা ও নির্যাতনের ধারা। বাধা পেরিয়ে যারা এগিয়ে গেছেন তাদের জন্য শুভকামনা থাকলেও যারা পিছিয়ে পড়ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন; তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন কিংবা খুনের মতো বিষয়গুলো নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ। এতে তৈরি হয় সামষ্টিক ভীতি। এ থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রাপ্তি-প্রাপ্তির বছর ২০২৪

আপডেট সময় : ০৫:৪৮:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশের নারীরা আশা-হতাশা আর অর্জনের মধ্যে হয়েছেন সম্মানিত
দেখতে দেখতে বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে ২০২৪ সালের। বরাবরের মতো এ বছরটাও শেষ হচ্ছে নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা আর অর্জনের মধ্য দিয়ে। দেশে এবং দেশের বাইরে আমাদের নারীরা সম্মানিত হয়েছেন মানবতা, জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের কাজ দিয়ে।
ক্রীড়া জগতে কখনো কখনো সাফল্যের ঝলকানি দেখেছি আমরা। দেখেছি ছাদ খোলা বাসে বিজয়ের আনন্দ উদ্যাপনের দৃশ্য। কিন্তু এই উদযাপন কি দেশের ৫৫ ফেডারেশনের ৫৪টিতে নারী খেলোয়াড়দের সাফল্যের কথা তুলে ধরে?
টানা দ্বিতীয়বার জয়: বছরের প্রথম

কয়েকটি মাসে ছিল না বড় কোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট। জুলাই-আগস্ট কেটেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে নেমে আসে স্থবিরতা। সেই স্থবির দশা কেটে যায় দারুণ এক জয়ে। নেপালের কাঠমান্ডুতে সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিকদের হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। আনন্দে উদ্বেলিত ফুটবলপ্রেমীরা দারুণভাবে বরণ করে নেয় সামিনাদের। আসে একের পর এক পুরস্কারের ঘোষণা। সাফ জয়ের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে ক্রীড়াঙ্গনে।
মৃত্যু: একদিকে মেয়েদের সাফ জয়, অন্যদিকে দুই নারী ফুটবলার নুরজাহান আক্তার মিথিলা ও রাজিয়া সুলতানার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু। এ দুই ঘটনা ক্রীড়াঙ্গনের প্রাপ্তির একাংশে মেখে দেয় মলিনতা। ‘দয়া করে আপনারা সহায়তার হাত বাড়ান, আমি বাঁচতে চাই’— গত ৬ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে করা মিথিলার আকুতিকে কজনই গুরুত্ব দিয়েছে। এরপর গত মার্চে প্রসবকালীন জটিলতায় অনন্তলোকের পথে হেঁটেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা। তবে মিথিলার সেদিনের আর্তনাদ আজও অনেকের চোখে জল এনে দেয়।
নারী ফুটবলার নুরজাহান আক্তার মিথিলা: বাঁচার আকুতি জানিয়ে মিথিলা ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘আমি অনেক অসুস্থ। শ্যামলী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

আমার বাবা প্রায় লাখ টাকা খরচ করেছেন, এখন আর পারছেন না। টাকার অভাবে ওষুধও ঠিকমতো খেতে পারছি না। আমি বাঁচতে চাই। হার্টে পানি জমেছে। ফুসফুসে সমস্যা। শ্বাসনালিতে ইনফেকশন। অক্সিজেন লেভেলও কম। অক্সিজেন মেশিন কিনতে হবে, মূল্য ৩৫ হাজার টাকা। অত টাকা কোথায় পাব! প্লিজ, আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।’
স্বর্ণজয়ী শুটার সাদিয়া সুলতানা: হুট করেই চলে যান এসএ গেমস স্বর্ণজয়ী শুটার সাদিয়া সুলতানা। জীবনের শেষ দিনগুলো নিজের পাওয়া মেডেলগুলো দেখেই কাটিয়েছেন।

মানসিক অবসাদ আর তাকে প্রিয় শুটিং রেঞ্জে ফিরতে দেয়নি। তার মৃত্যুতেও ক্রীড়াঙ্গনে নামে শোকের ছায়া।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ক্রীড়া সংস্কারে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্রীড়াঙ্গনকে নতুন করে গড়ার কাজটা মন দিয়ে শুরু করে। এ জন্য সব ফেডারেশন সভাপতি ছেঁটে ফেলা হয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় খেলাধুলায় ছিল না স্বাভাবিক অবস্থা। এর মাঝেও সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। তিনি নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সপ্তম আন্তঃসার্ভিস ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ৭১ কেজি ওজন শ্রেণিতে প্রথম স্থান ধরে রাখার পাশাপাশি রেকর্ডও গড়েন। ভারোত্তোলনের দুটি অংশ—ক্লিন ও জার্ক। দুই বিভাগেই তিন কেজি করে বেশি তোলেন তিনি। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১১১ কেজি উত্তোলন করেন। ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন সীমান্ত। গত এক দশকে অনেক চ্যাম্পিয়ন ও রেকর্ড গড়েছেন-ভেঙেছেন। তাই নিজের কীর্তি নিজেরই এখন মনে রাখা কষ্টকর। এ কথাটিই শোনা গেল তার কণ্ঠে, ‘ঠিক মনে নেই, কতবার রেকর্ড হলো বা ভাঙলাম। যত দিন খেলব তত দিনই রেকর্ড করতে চাই।’
উর্মি আক্তার: বছরের শেষ দিকে ঢাকায় আন্তর্জাতিক জুনিয়র ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ছিল ইন্দোনেশিয়ায় জয়জয়কার। দেশের মেয়েরা ফাইনালেও যেতে পারেননি।

এরপর সিনিয়র পর্যায়েও ভালো করতে পারেননি মেয়েরা। প্রথম দিনেই বাংলাদেশের নারী জাতীয় চ্যাম্পিয়ন উর্মি আক্তার একক ইভেন্টে হেরে যান। যে হার নিয়ে তার ব্যাখ্যা ছিল, ‘আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এরপরও যতটুকু সম্ভব লড়াই করেছি।’
হকির অধিনায়ক অর্পিতা পাল: ওই হারের কয়েকদিন আগে ওমানের মাসকটে নারীদের জুনিয়র এশিয়া কাপ হকিতেও হতাশ করেন মেয়েরা। যেখানে ছেলেরা পঞ্চম হয়ে প্রথমবারের মতো জুনিয়র হকির বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিলেন, সেখানে মেয়েরা সপ্তম হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরেন। এ জন্য অবশ্য প্রস্তুতির ঘাটতিকেই দুষেছেন জুনিয়র হকির অধিনায়ক অর্পিতা পাল। তিনি বলেছেন, ‘আসলে আমরা শুরুর দিকে যাদের সঙ্গে খেলেছিলাম তাদের বিপক্ষে আগে কখনো খেলিনি। তাদের খেলাও দেখা হয়নি। এ জন্য মাঠে নেমে একটু ধরে খেলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের কিছু কিছু টেকনিকের সঙ্গে আমরা কুলিয়ে উঠিনি। এরপর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ম্যাচগুলোতে আগের তুলনায় ভালো খেলেছিলাম। যদিও জিততে পারিনি। শেষ ম্যাচটা সব দিক থেকে ভালো হয়। তবে প্রস্তুতিা আমাদের পরিপূর্ণ হয়নি।’
নকশাকার করেছিলেন মেরিনা তাবাসসুম: সুলতানি আমলের স্থাপত্যরীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১২ সালে নির্মিত ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের নকশা করেছিলেন মেরিনা তাবাসসুম। এ জন্য এ বছর টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন তিনি।

এ জন্য ৮ ডিসেম্বর জনপ্রিয় অনলাইন ম্যাগাজিন ‘ডিজেন’ কর্তৃক ‘ডিজেন আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয় মেরিনার প্রতিষ্ঠান ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস’। প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।
সারাফ নাওয়ার: আর্কিটেকচারে মর্যাদাপূর্ণ ইন্সপাইরেলি পুরস্কার জিতেছেন সারাফ নাওয়ার। তার প্রকল্পের নাম ‘টেল অব অ্যান ওশান: ওশানেরিয়াম কমপ্লেক্স অ্যাট সোনাদিয়া’। প্রকল্পটি স্থাপত্যের মাধ্যমে পরিবেশের স্থিতিশীলতার কথা বলে।
রিকতা আখতার বানু লুৎফা: প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের রিকতা আখতার বানু লুৎফা। চিলমারীর এই নারী নিজের সর্বস্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। সেখানে এখন তিন শর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এ কাজের জন্য রিকতা বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।
রেসিং ড্রাইভার কাশফিয়া আরফা: এ বছর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে দেশের প্রথম নারী রোবোটিকস দল কোড ব্ল্যাক। এর সদস্যরা সবাই উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে সবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী রেসিং ড্রাইভার হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন কাশফিয়া আরফা।
বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী: ভিয়েতনামের ভিনফিউচার স্পেশাল প্রাইজ পেয়েছেন বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। কলেরা, টাইফয়েড ও হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) সুলভ মূল্যের টিকা উদ্ভাবনে অবদান রাখায় তাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
নুশরাত ইসলাম তৃষা: দেশে এখনো বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি। বাগেরহাটের প্রজাপতি স্কোয়াডের কিশোরীরা বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে। নারীদের প্রতি হওয়া সব ধরনের বৈষম্যের অবসান চায় এই প্রজাপতিরা। এই দলের নুশরাত ইসলাম তৃষা এ বছর মনোনীত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শিশুশান্তি পুরস্কারের জন্য।
জ্যাতির্বিজ্ঞানী ড. লামিয়া আশরাফ মওলা: জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ‘ফায়ারফ্লাই স্পার্কল’ নামের একটি নতুন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের এই দলে রয়েছেন বাংলাদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. লামিয়া আশরাফ মওলা।
শারমীন আক্তার: নিভৃতচারী হয়ে কাজ করছেন কুতুবদিয়ার শারমীন আক্তার। তিনি গ্রামের নারীদের জন্য মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ, বসতবাড়িতে শাকসবজি চাষ, সঞ্চয় ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে চলেছেন।
শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা: জুলাই মাসের উত্তাল আন্দোলনের দিনেও থেমে থাকেননি অর্থী জুখরীফের মতো চিকিৎসকরা। পুলিশের গাড়ির সামনে রুখে দাঁড়াতে একবারও বুক কাঁপেনি নুসরাত জাহান টুম্পার মতো শিক্ষার্থীদের।
বাইসাইকেলিস্ট তানজিনা মিতু: বাইসাইকেলে চেপে ৬৪ জেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন কুমিল্লার মেয়ে তানজিনা মিতু।
ইয়াসমিন লিসা, তাহেরা সুলতানা রেখা, ট্রেকার এপি তালুকদার ও অর্পিতা দেবনাথ: নেপালের লাংটা হিমালয়ের তিনটি পর্বতের শিখর আরোহণ অভিযানে গেছেন দেশের পাঁচ নারী পর্বতারোহী। পর্বতারোহী নিশাত মজুমদারের নেতৃত্বে ‘সুলতানাজ ড্রিম অনবাউন্ড’ নামের এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী অন্য সদস্যরা হলেন পর্বতারোহী ইয়াসমিন লিসা, তাহেরা সুলতানা রেখা, ট্রেকার এপি তালুকদার ও অর্পিতা দেবনাথ।
নারী উদ্যোক্তা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় তৈরি হয়েছে অনেক নারী উদ্যোক্তা।

এর পাশাপাশি গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পারলার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য এবং হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতেও নারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
সামষ্টিক ভীতি: অর্জন, প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার গল্পের সমান্তরালে বয়ে চলেছে সহিংসতা ও নির্যাতনের ধারা। বাধা পেরিয়ে যারা এগিয়ে গেছেন তাদের জন্য শুভকামনা থাকলেও যারা পিছিয়ে পড়ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন; তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন কিংবা খুনের মতো বিষয়গুলো নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ। এতে তৈরি হয় সামষ্টিক ভীতি। এ থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।