ঢাকা ১১:২২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

প্রান্তজনের কথা

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৭:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ অগাস্ট ২০২১
  • ১২৫ বার পড়া হয়েছে

শাহানা হুদা রঞ্জনা : লিলি চাকমা একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। কাজের সুবাদে তাকে যেতে হয়েছিল নওঁগার সাওঁতালপল্লীতে। তার কাজ ছিল সেখানে গিয়ে অধিকার, সমাজ সচেতনতা বিষয়ে মানুষকে বোঝানো। কিন্তু সাওঁতালপল্লীতে পৌঁছানোর পর লিলি দেখলেন ওখানে যেভাবে তারা বাস করছেন, সেই অবস্থা কোন মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। ভাঙা বেড়ার বাড়িঘর, বৃষ্টির পানি ঘরের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে, চারিদিকে কাদাপানি পশুপাখির বিষ্ঠা ও নোংরা ছড়ানো। টয়লেট কী জিনিস তা তারা জানেন না। রাস্তাঘাট এবরো-থেবরো। কোনভাবে তারা পড়ে আছেন গ্রামের এক প্রান্তে।

লিলি চাকমা ফিরে এসে বললেন, ‘সাঁওতাল পরিবারগুলোকে দেখে আমার মনে হল এইভাবে মানবেতর পরিবেশে যে প্রান্তিক মানুষগুলোর বাস, তাদের কাছে অধিকার কী আর সমাজ সচেতনতাইবা কী। এসবের কথা বলা বাতুলতা মাত্র। আগে তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করতে হবে, এরপর অন্য কথা।’

লিলি চাকমার কথা একেবারে ঠিক। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অংশে সমতলের আদিবাসীদের বাস। এখানে আছে সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, মাহাতো, মাহালী, পাহান ডালু ও রাজবংশীসহ আরো অনেকে। আদিবাসীদের মধ্যে সাওঁতালদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অথচ এদের অবস্থানই সমাজে সবচেয়ে প্রান্তিক।

এরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরি ও আয়ের সুযোগসহ সমাজে নানাধরণের বৈষম্যের শিকার। সমতল ভূমিতে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম, শতকরা ১৬ ভাগ। সমতল আদিবাসীদের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা নেয়ার জন্য স্কুলেই ভর্তি হতে পারেনা।

পাহাড়ে এবং সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে চরম দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা, জাতীয় পর্যায়ের মোট চরম দরিদ্রের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা পাহাড়ের চেয়ে সমতলে আরো বেশি। নঁওগা ও রাজশাহীতে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ ও ৬৬ শতাংশ। এই তথ্যগুলো উঠে এসেছিল ২০২০ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর একটি গবেষণা থেকে। বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও জীবনের গতিপ্রকৃতির চিত্র তুলে আনার জন্য ‘‘পার্বত্য চট্রগ্রামের ও সমতল আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার গতিপ্রকৃতি” শীর্ষক এই গবেষণা করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে ৪৫ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে সমতলে। আদিবাসীরা মূলত কৃষিজীবী ফলে কৃষি জমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে তারা ব্যাপক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদের ভেতর একটি চরম অনিশ্চিয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।

এই জনগোষ্ঠীর জীবন এবং জীবিকা একসময় ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ, বনভূমি আর ভূমির মালিকানার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ক্রমশ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর থেকে তাদের মালিকানা হারিয়ে গেছে। তারা চাইলেই অন্য যেকোন একটি জীবিকা বেছে নিতে পারেননা। সেখানেও আছে নানাধরণের জাতভেদ প্রথা। যেহেতু সমতল আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, তাই তাদের আর সামনে এগুনো হয়না। বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে যতোটাই এগিয়ে যাক না কেন, আদিবাসীদের অবস্থা সেই তিমিরেই। কারণ তাদের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত কোনো কাজ চোখে পড়েনা।

চাকমা সার্কেল-প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়ের মতে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় থাকা বাংলাদেশে আদিবাসীদের পিছিয়ে থাকার কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসীদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেওয়া। আদিবাসীদের প্রতি কার্যত অবহেলা আছে রাষ্ট্রের।

একবার সমতল আদিবাসীদের এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘আদিবাসী গ্রামগুলোতে বাড়ছে ভূমিহীনের সংখ্যা। আদিবাসী গ্রাম অথচ কোথাও একটা মাধ্যমিক স্কুল পাবেন না। বর্ষায় আদিবাসী গ্রামগুলোর সড়ক নষ্ট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন নিজের জমি হারিয়ে আদিবাসী মানুষ প্রায় দিনমজুর। বিদ্যুৎ, ভালো স্কুল, পাকা সড়ক এসব আমাদের জন্য নয়।”

ভূমিদস্যুরা নানা ছুতায় এদের জমি দখল করে নেয়, বাড়িতে হামলা চালায়, সহায়-সম্পত্তি লুটপাট করে নেয়। আদিবাসীদের কাছে ভূমির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে তারা দাঁড়াবে কোথায়? যারা তাদের নিয়ে কাজ করেন, তারা বলেছেন কোন কোন এলাকায় এদের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, টিউবঅয়েল, শ্মশান ও মানুষকে কবর দেয়ার জায়গাও অন্যের দখলে চলে গেছে।

এই মানুষগুলো সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করেন। সমতলের আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের ভূমি যে কেউ নিয়ে যেতে পারে। এসব ঘটনায় তারা সাধারণত প্রশাসনের সহায়তা পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘ভূমি অধিকার আইন’ বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ভূমি দখলে সব দখলদারের চরিত্রই এক। তাই সমতলের মানুষদের ভূমি রক্ষায় অবিলম্বে ‘ভূমি কমিশন আইন’ করা জরুরি।

এছাড়াও, আদিবাসীদের প্রথাগত অভ্যাস, আচার-আচরণ, সামাজিক আচার, ধর্ম, ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সব আলাদা। পার্বণে, উৎসবে চোয়ানি, হাড়িয়া, মদ পান করে তাই অন্যান্য সম্প্রদায় তাদের সাথে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাদের রয়েছে পরিচয়ের সংকট। তারা মূলধারার জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং রাজনৈতিকভাবেও মূল্যহীন। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিকে সম্মান দিতে হবে।

সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়নে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আর দুর্নীতিবাজরা সেখানেও তৎপর। দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক নানা খাতে বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্যের হারও তাদের মধ্যে বেশি।

এছাড়াও আদিবাসী পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন জীবিকার পরিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উৎস কমে যাওয়া, খাদ্য গ্রহণে পরিবর্তন, বাজার ব্যবস্থা, চাষবাস, জেন্ডার বৈষম্য। পাহাড় ও সমতল দুই আদিবাসীদের ক্ষেত্রেই আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। পাহাড়ে বেশি ৪১ শতাংশ, সমতলে ৫৫ শতাংশ। তাই তাদের ঋণ করতে হয় ব্যবসার ও কৃষি কাজের জন্য।

সমতলে দিনমজুর বেশি। আদিবাসীরা তাদের একক কৃষি থেকে অন্যান্য কৃষি বা অকৃষিকাজে ঝুঁকেছেন জীবিকা অর্জনের জন্য। তারা এখন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিতে চান সেলাই, কুটির শিল্প, পশুপালনের জন্য। আদিবাসীদের পক্ষে পদ্ধতিগত কারণে ঋণ নেয়াটাও কঠিন।

‘বৈষম্যবিলোপ আইন’ দ্রুত পাস করা উচিৎ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে। তবে সমাজের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আদিবাসী হওয়ার কারণে একজন ব্যক্তিকে হোটেলে খাবার দেওয়া হয় না, শশ্মানের জায়গা দেয়া হয় না, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয় না- এসব আচরণ শুধু ব্যক্তি নয়, মানবজাতির জন্য অপমানজনক।

আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকা একটি অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। তাই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য জরিপ পরিচালনা করে প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা উচিৎ। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা দেশে এসডিজি বাস্তবায়ন করতে চাইছি এবং শ্লোগান দিচ্ছি ‘‘কাউকে পিছিয়ে রেখে নয় বরং সবাইকে সাথে নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন করবো।”

তাই এখন এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং আদিবাসী সমাজকেও উন্নয়নের সমান ধারায় যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে রিসোর্স বরাদ্দ, তার প্রয়োগ এবং বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা অতি জরুরি। আমরা সবাই জানি করোনার কারণে সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনানুষ্ঠনিক কাজের সঙ্গে এরা বেশি যুক্ত। এই ধরনের কাজে যেহেতু কোনো নিয়োগপত্র বা নীতিমালা নেই বা অকার্যকর, তাই এদের বড় অংশ এই মহামারিতে চাকুরি হারিয়েছে।

আদিবাসী দিবসে আমরা যেনো ভুলে না যাই গুণীজনের সেই বাণী ‘‘একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কতখানি উন্নত ও সভ্য তার বিচার্য বিষয় হবে সেই সমাজে সবচেয়ে অনগ্রসর, প্রান্তিক ও দুর্বল মানুষেরা কেমন আছে, তার উপর।” আমরা একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। এগিয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়ায় সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রান্তজনের কথা

আপডেট সময় : ০৮:৪৭:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ অগাস্ট ২০২১

শাহানা হুদা রঞ্জনা : লিলি চাকমা একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। কাজের সুবাদে তাকে যেতে হয়েছিল নওঁগার সাওঁতালপল্লীতে। তার কাজ ছিল সেখানে গিয়ে অধিকার, সমাজ সচেতনতা বিষয়ে মানুষকে বোঝানো। কিন্তু সাওঁতালপল্লীতে পৌঁছানোর পর লিলি দেখলেন ওখানে যেভাবে তারা বাস করছেন, সেই অবস্থা কোন মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। ভাঙা বেড়ার বাড়িঘর, বৃষ্টির পানি ঘরের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে, চারিদিকে কাদাপানি পশুপাখির বিষ্ঠা ও নোংরা ছড়ানো। টয়লেট কী জিনিস তা তারা জানেন না। রাস্তাঘাট এবরো-থেবরো। কোনভাবে তারা পড়ে আছেন গ্রামের এক প্রান্তে।

লিলি চাকমা ফিরে এসে বললেন, ‘সাঁওতাল পরিবারগুলোকে দেখে আমার মনে হল এইভাবে মানবেতর পরিবেশে যে প্রান্তিক মানুষগুলোর বাস, তাদের কাছে অধিকার কী আর সমাজ সচেতনতাইবা কী। এসবের কথা বলা বাতুলতা মাত্র। আগে তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করতে হবে, এরপর অন্য কথা।’

লিলি চাকমার কথা একেবারে ঠিক। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অংশে সমতলের আদিবাসীদের বাস। এখানে আছে সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, মাহাতো, মাহালী, পাহান ডালু ও রাজবংশীসহ আরো অনেকে। আদিবাসীদের মধ্যে সাওঁতালদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অথচ এদের অবস্থানই সমাজে সবচেয়ে প্রান্তিক।

এরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরি ও আয়ের সুযোগসহ সমাজে নানাধরণের বৈষম্যের শিকার। সমতল ভূমিতে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম, শতকরা ১৬ ভাগ। সমতল আদিবাসীদের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা নেয়ার জন্য স্কুলেই ভর্তি হতে পারেনা।

পাহাড়ে এবং সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে চরম দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা, জাতীয় পর্যায়ের মোট চরম দরিদ্রের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা পাহাড়ের চেয়ে সমতলে আরো বেশি। নঁওগা ও রাজশাহীতে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ ও ৬৬ শতাংশ। এই তথ্যগুলো উঠে এসেছিল ২০২০ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর একটি গবেষণা থেকে। বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও জীবনের গতিপ্রকৃতির চিত্র তুলে আনার জন্য ‘‘পার্বত্য চট্রগ্রামের ও সমতল আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার গতিপ্রকৃতি” শীর্ষক এই গবেষণা করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে ৪৫ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। এর দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে সমতলে। আদিবাসীরা মূলত কৃষিজীবী ফলে কৃষি জমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে তারা ব্যাপক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদের ভেতর একটি চরম অনিশ্চিয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।

এই জনগোষ্ঠীর জীবন এবং জীবিকা একসময় ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ, বনভূমি আর ভূমির মালিকানার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ক্রমশ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর থেকে তাদের মালিকানা হারিয়ে গেছে। তারা চাইলেই অন্য যেকোন একটি জীবিকা বেছে নিতে পারেননা। সেখানেও আছে নানাধরণের জাতভেদ প্রথা। যেহেতু সমতল আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, তাই তাদের আর সামনে এগুনো হয়না। বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে যতোটাই এগিয়ে যাক না কেন, আদিবাসীদের অবস্থা সেই তিমিরেই। কারণ তাদের উন্নয়নে সরকারের সমন্বিত কোনো কাজ চোখে পড়েনা।

চাকমা সার্কেল-প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়ের মতে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় থাকা বাংলাদেশে আদিবাসীদের পিছিয়ে থাকার কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসীদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেওয়া। আদিবাসীদের প্রতি কার্যত অবহেলা আছে রাষ্ট্রের।

একবার সমতল আদিবাসীদের এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘আদিবাসী গ্রামগুলোতে বাড়ছে ভূমিহীনের সংখ্যা। আদিবাসী গ্রাম অথচ কোথাও একটা মাধ্যমিক স্কুল পাবেন না। বর্ষায় আদিবাসী গ্রামগুলোর সড়ক নষ্ট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন নিজের জমি হারিয়ে আদিবাসী মানুষ প্রায় দিনমজুর। বিদ্যুৎ, ভালো স্কুল, পাকা সড়ক এসব আমাদের জন্য নয়।”

ভূমিদস্যুরা নানা ছুতায় এদের জমি দখল করে নেয়, বাড়িতে হামলা চালায়, সহায়-সম্পত্তি লুটপাট করে নেয়। আদিবাসীদের কাছে ভূমির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাদের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে তারা দাঁড়াবে কোথায়? যারা তাদের নিয়ে কাজ করেন, তারা বলেছেন কোন কোন এলাকায় এদের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, টিউবঅয়েল, শ্মশান ও মানুষকে কবর দেয়ার জায়গাও অন্যের দখলে চলে গেছে।

এই মানুষগুলো সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করেন। সমতলের আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের ভূমি যে কেউ নিয়ে যেতে পারে। এসব ঘটনায় তারা সাধারণত প্রশাসনের সহায়তা পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘ভূমি অধিকার আইন’ বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ভূমি দখলে সব দখলদারের চরিত্রই এক। তাই সমতলের মানুষদের ভূমি রক্ষায় অবিলম্বে ‘ভূমি কমিশন আইন’ করা জরুরি।

এছাড়াও, আদিবাসীদের প্রথাগত অভ্যাস, আচার-আচরণ, সামাজিক আচার, ধর্ম, ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সব আলাদা। পার্বণে, উৎসবে চোয়ানি, হাড়িয়া, মদ পান করে তাই অন্যান্য সম্প্রদায় তাদের সাথে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাদের রয়েছে পরিচয়ের সংকট। তারা মূলধারার জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং রাজনৈতিকভাবেও মূল্যহীন। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিকে সম্মান দিতে হবে।

সমতলের আদিবাসীদের উন্নয়নে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আর দুর্নীতিবাজরা সেখানেও তৎপর। দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক নানা খাতে বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও আদিবাসীদের মধ্যে তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। দারিদ্র্যের হারও তাদের মধ্যে বেশি।

এছাড়াও আদিবাসী পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন জীবিকার পরিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উৎস কমে যাওয়া, খাদ্য গ্রহণে পরিবর্তন, বাজার ব্যবস্থা, চাষবাস, জেন্ডার বৈষম্য। পাহাড় ও সমতল দুই আদিবাসীদের ক্ষেত্রেই আয়ের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। পাহাড়ে বেশি ৪১ শতাংশ, সমতলে ৫৫ শতাংশ। তাই তাদের ঋণ করতে হয় ব্যবসার ও কৃষি কাজের জন্য।

সমতলে দিনমজুর বেশি। আদিবাসীরা তাদের একক কৃষি থেকে অন্যান্য কৃষি বা অকৃষিকাজে ঝুঁকেছেন জীবিকা অর্জনের জন্য। তারা এখন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিতে চান সেলাই, কুটির শিল্প, পশুপালনের জন্য। আদিবাসীদের পক্ষে পদ্ধতিগত কারণে ঋণ নেয়াটাও কঠিন।

‘বৈষম্যবিলোপ আইন’ দ্রুত পাস করা উচিৎ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে। তবে সমাজের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আদিবাসী হওয়ার কারণে একজন ব্যক্তিকে হোটেলে খাবার দেওয়া হয় না, শশ্মানের জায়গা দেয়া হয় না, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয় না- এসব আচরণ শুধু ব্যক্তি নয়, মানবজাতির জন্য অপমানজনক।

আদিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকা একটি অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। তাই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য জরিপ পরিচালনা করে প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা উচিৎ। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা দেশে এসডিজি বাস্তবায়ন করতে চাইছি এবং শ্লোগান দিচ্ছি ‘‘কাউকে পিছিয়ে রেখে নয় বরং সবাইকে সাথে নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন করবো।”

তাই এখন এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং আদিবাসী সমাজকেও উন্নয়নের সমান ধারায় যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে রিসোর্স বরাদ্দ, তার প্রয়োগ এবং বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা অতি জরুরি। আমরা সবাই জানি করোনার কারণে সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনানুষ্ঠনিক কাজের সঙ্গে এরা বেশি যুক্ত। এই ধরনের কাজে যেহেতু কোনো নিয়োগপত্র বা নীতিমালা নেই বা অকার্যকর, তাই এদের বড় অংশ এই মহামারিতে চাকুরি হারিয়েছে।

আদিবাসী দিবসে আমরা যেনো ভুলে না যাই গুণীজনের সেই বাণী ‘‘একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কতখানি উন্নত ও সভ্য তার বিচার্য বিষয় হবে সেই সমাজে সবচেয়ে অনগ্রসর, প্রান্তিক ও দুর্বল মানুষেরা কেমন আছে, তার উপর।” আমরা একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। এগিয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়ায় সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।