প্রত্যাশা ডেস্ক: পুরো শরীর থেঁতলে গেছে, হাতে, পায়ে আর পিঠে বড় বড় দাগ। তীব্র ব্যথায় ছটফট করছে। শুয়ে থাকাও কষ্টকর। খানিকক্ষণ বসে আর শুয়ে অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে দুই স্কুলছাত্রের।
গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়া এই দুইজনের এমন অবস্থা দেখে তাদের স্বজনরা পাগলপ্রায়। হাসপাতালে যেই শুনেছে ছেলেদের এভাবে পিটিয়েছে, কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয় তিন স্কুলছাত্র। তাদের একজন মারা গেছে বাকি দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত শুক্রবার (২২ আগস্ট) চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগরে চোর সন্দেহে স্কুলছাত্র মাহিনকে (১৪) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসময় একই এলাকার রাহাত (১৬) ও মানিক (১৯) নামের দুজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়।
সেদিন যা ঘটেছিল
সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মানিক ঘটনার কথা তুলে ধরে বলেন, চোর সন্দেহে স্থানীয় লোকজন কোনো তদন্ত বা সত্যতা যাচাই ছাড়াই বেধড়ক মারধর শুরু করে তাদের। তার মা বারবার চিৎকার করে বলছিলেন, আমার ছেলে চোর না, ও আমার মানিক, কিন্তু কেউ তার আর্তনাদও শোনেনি।
আহত মানিকের ভাই রাশেদ জানান, বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার ঘুরতে যায় মানিক। সেখান থেকে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। ভোরে তারা ফটিকছড়ি কাঞ্চননগরে পৌঁছায়। সেখানে তাদের চোর সন্দেহে ব্রিজের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি তার।
মানিকের মা রোজি আক্তার বলেন, আমি এতকিছু বুঝি না। আমার ছেলেকে যারা মেরেছে তাদের বিচার চাই।তিনি ছেলের বিচার পাওয়ার জন্য ফটিকছড়ি থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন। পরে চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের করেন।
মানিকের সঙ্গী রাহাতও স্কুলছাত্র। সেও স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। গণপিটুনির শিকার হয় সেও। শরীরের নানা জায়গায় গুরুতর জখম রাহাতের। উঠে দাঁড়াতে পারে না সে।
রাহাতের ভাই আনোয়ার হোসেন সুমন বলেন, আমার ভাই চোর ছিল না। তারা কক্সবাজার থেকে ফেরার সময় গণপিটুনির শিকার হয়। এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। আমার ভাইয়ের ওপর হামলাকারীদের বিচার চাই।
এদিকে, গণপিটুনিতে নিহত মাহিনের মা খদিজা বেগম বলেন, ছেলেকে বেঁধে মারধর করা হচ্ছে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। আমার ছেলে চোর নয়, বারবার বলার পরও আমার সামনে ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। একটু পানি চাইছিল, তারা পানি পর্যন্ত দিতে দেয়নি। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সম্প্রতি এলাকায় কয়েকটি চুরির ঘটনা ঘটেছে। সেই কারণে অচেনা কিশোরদের সন্দেহ হলে লোকজন জড়ো হয়ে যায় এবং পরে গণপিটুনি দেয়। যদিও এভাবে মারধর করা উচিত হয়নি।
ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুর আহমদ বলেন, ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ওই এলাকায় কোনো চুরির ঘটনা ঘটেনি। তারা নিজেরা বাঁচার জন্য চুরির কথা বলছেন। পূর্বের কোনো বিরোধ থেকে নাটক সাজিয়ে ওই কিশোরদের পেটানো হয়েছে।
মামলা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে আহতদের সব বিষয় উল্লেখ রয়েছে। তাই আরেকটা মামলা নেয়নি বলে জানান তিনি।
ঘটনার দিন গভীর রাতে সাগর আলী তালুকদার বাড়িতে চুরির চেষ্টা চালায় একদল চোর। এসময় এলাকাবাসী টের পেয়ে ধাওয়া করে তিনজনকে আটক করে। পরে উত্তেজিত জনতা বেধড়ক মারধর করলে ঘটনাস্থলেই মাহিন মারা যায়। আহত দুইজনকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ফটিকছড়ি থানা পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নোমান ও আজাদ নামের দুই যুবককে আটক করে। গত শনিবার (২৩ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রামের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোতাসিম বিল্লাহর আদালতে জবানবন্দি দেন দুই আসামি। আসামিরা হলেন আজাদ হোসেন (৩৬) ও মোহাম্মদ নোমান (৩৭। এর মধ্যে নোমান গ্রাম্য ডাক্তার ও আজাদ গাড়িচালক।
আদালত সূত্র জানা যায়, জবানবন্দিতে আসামি আজাদ হোসেন বলেন, ছয়দিন আগে এলাকায় কিছু কবুতর চুরি হয়। সেই চুরির অপবাদ দিয়ে ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দিনগত রাত সাড়ে ৩টায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে আসা মাহিনসহ তিনজনকে ধরার চেষ্টা করেন। ওই সময় আজাদ, ফাহাদ, ইমন, আনোয়ার, মুন্না, শাওনসহ ছয়জন ছিলেন। তিন কিশোরকে ধাওয়া দিলে তারা পাশের একটি বাড়ির ছাদে উঠে যায়। পরে তাদের ধরে এনে এলাকার একটি সেতুর সঙ্গে বাঁধা হয়। বাঁধা অবস্থায় তাদের উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে মাহিনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন জানান, নাজিম উদ্দিন, তানভীরসহ অন্তত ৪০ জন তিন কিশোরকে মারধর করতে থাকেন। কারো হাতে লাঠিসোঁটা আর কারো হাতে বিদ্যুতের তার। আর কেউ কিল-ঘুষি মারেন। মারধরের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মাহিন। নিশ্বাস আছে কি না, নাকে হাত দিয়ে দেখা হয়। পরে সেখানে থাকা পল্লী চিকিৎসক নোমান নিশ্চিত করেন, মাহিন মারা গেছে। এরপর হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া সবাই পালিয়ে যায়।
আরেক আসামি মোহাম্মদ নোমানও তার জবানবন্দিতে স্কুলছাত্র মাহিনসহ তিনজনকে মারধরের কথা স্বীকার করেন। তিনিই মাহিনের মৃত্যুর বিষয়টি উপস্থিত সবাইকে জানান। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অন্য আসামিদের নামও উল্লেখ করেন তিনি।
এসি/