খান অপূর্ব আহমদ
বছরজুড়ে পালিত বিভিন্ন দিবসের মধ্যে একটি হলো কাদা দিবস। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, কাদা দিবস। প্রতি বছরের ২৯ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় কাদা নিয়ে খেলাধুলা এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগের জন্য। তবে শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে আরো বেশি সংযুক্ত করার লক্ষ্যে দিনটি পালন করা হয় বিশ্বজুড়ে।
কাদা বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় মাড, শুধু মাটি ও পানির সাধারণ মিশ্রণ নয়। এটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপাদান। গৃহনির্মাণ থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিল্প ও সৌন্দর্যচর্চা ইত্যাদি কাজে প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কাদা ব্যবহার করে আসছে নানাভাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে একে পবিত্র ও উপকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাকৃতিক চিকিৎসায় কাদার উপকারিতা-
ত্বকের যত্ন: কাদা মাস্ক ত্বকের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, ব্রণ কমায় এবং ত্বক উজ্জ্বল করে। এ জন্য বেনটোনাইট ক্লে মাস্ক, মুলতানি মাটি কিংবা গ্রিন টি ক্লে মাস্ক ব্যবহার করা হয়।
চুলের যত্ন: শ্যাম্পু ও সাবান জনপ্রিয় হওয়ার আগে মানুষ চুলের যত্নে বিশেষ ধরনের কাদা ব্যবহার করত। এর জন্য প্রয়োজন হতো পুকুরের তলদেশের এঁটেল মাটির কাদা। ভেজা চুলে এটি শ্যাম্পুর মতো করে ব্যবহার করা হতো। এখনো কোনো কোনো এলাকায় এর চল আছে।
পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী: মাটির বাড়ি মূলত কাদা দিয়েই তৈরি হয়। তারপর রোদে শুকালে সেগুলো শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ ধরনের বাড়ি প্রাকৃতিকভাবে শীতল থাকে। ইট, টেরাকোটা ও মাটির পাত্র তৈরিতে কাদা অপরিহার্য।
শিল্প ও সাংস্কৃতিক ব্যবহার: মৃৎশিল্প, মূর্তি ও হস্তশিল্প তৈরিতে কাদা ব্যবহৃত হয়। শিশুদের জন্য কাদা খেলা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে।
বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কাদা চিকিৎসা-
আয়ুর্বেদ (ভারত): ‘মৃত্তিকা চিকিৎসা’ নামে পরিচিত; বিশেষ করে বাত ও ত্বকের রোগে ব্যবহৃত হয়।
ডেড সি থেরাপি (ইসরায়েল/জর্ডান): ডেড সি মাড সোরিয়াসিস ও বাতের চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত।
আফ্রিকান ঐতিহ্যবাহী ওষুধ: কাদার প্রলেপ ক্ষত ও পোড়া জায়গা শুকাতে ব্যবহৃত হয়।
জাপানের ওনসেন থেরাপি: গরম প্রস্রবণের কাদা বা ভলকানিক মাড ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন দেশে খেলাধুলা, স্থাপত্য ও অন্যান্য: পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন কারণে কাদা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমা তৈরিতে বিশেষ মাটির কাদা ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির বাড়ি তৈরিতে কাদার প্রচলন উল্লেখযোগ্য।
শুধু ভারতীয় সংস্কৃতিতেই নয়, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় মাটির ট্যাবলেটে লিখিত হতো রাজকীয় ফরমান। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন গোত্রের আদিবাসীরা কাদাকে তাদের শিল্পের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। আর দক্ষিণ আমেরিকার কিছু গোত্র কাদা দিয়ে তৈরি করে ঔষধি মলম।
পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রে কাদাকে আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিম আফ্রিকায় মালির জেনে মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদ তৈরি হয়েছে কাদা দিয়ে।
জাপানি সংস্কৃতিতেও কাদার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জাপানে আছে পান্টু পুণ্যাহ বা কাদার দৈত্য উৎসব। এ ছাড়া জাপানের বিভিন্ন ওনসেন বা গরম পানির প্রস্রবণের কাদাকে মানুষ ত্বকের জন্য উপকারী বলে মনে করে। জাপানে কাদার মধ্যে বা কাদাকে কেন্দ্র করে অনেক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেগুলো গ্রামীণ ও কৃষিকেন্দ্রিক উৎসবের অংশ। জাপানে কাদাকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় বোরিয়াং মাড ফেস্টিভ্যাল। এই উৎসবে কাদার মধ্যে দৌড়, কুস্তি, সøাইডিং এবং এটি দিয়ে বডি পেইন্টিং করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এটি দেখতে উপস্থিত হয়। বোরিয়াং এলাকার কাদায় খনিজ পদার্থ থাকায় এটি ত্বকের জন্য উপকারী মনে করা হয়। সে জন্য স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা করতে এই উৎসব শুরু হয়েছিল।
ভারতে কাবাডি ও কুস্তি খেলা অনুষ্ঠিত হয় কাদায়। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কাদা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় কাবাডি ও পহেলওয়ানি বা মল্লযুদ্ধ। ভারতেও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে কাদাকে শক্তি ও প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হয়।
কাদায় হওয়া খেলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মাড রান বিখ্যাত। ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার দৌড়ে কাদা, পানিসহ বিভিন্ন বাধা পার হতে হয় খেলোয়াড়দের।
শুধু আমেরিকায় নয়, যুক্তরাজ্যেও খেলা হয় গ্র্যাংজার্স মাড রেস। এটি প্রাচীন গ্রামীণ ঐতিহ্য। স্থানীয় কৃষক সম্প্রদায়ের উৎসব হিসেবে এটি উদ্যাপিত হয়।
থাইল্যান্ডের চোনবুরি প্রদেশে কাদা মাঠে মহিষ দৌড়ের প্রতিযোগিতা হয়। এর নাম বাফালো রেস। কৃষিকাজে মহিষের ভূমিকাকে সম্মান জানাতে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সতর্কতা: সব ধরনের কাদা ত্বকের জন্য উপযুক্ত নয়। ব্যবহার করতে চাইলে অ্যালার্জি টেস্ট করে নেওয়া উচিত। চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যবহার করুন। কাদা দিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজের চিহ্ন। ফলে এই আধুনিককালে প্রকৃতির আরও কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কাদা দিবস পালিত হয়। সূত্র: ডেডসি ডটকম ও অন্যান্য।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ