আতাউর রহমান কাবুল : কাজের ফাঁকে বিশ্রাম না নিয়ে যারা কম্পিউটার আর টিভির পর্দায় বেশিক্ষণ চোখ রাখেন, তাদের কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম বা সিভিএস হতে পারে। বিশেষ করে যারা কোনো বিরতি ছাড়াই একটানা পিসি বা ল্যাপটপে কাজ করেন, তাদের এ রোগ হয়। এটা হলে চোখে জ্বালাপোড়ার সঙ্গে থাকে অস্পষ্ট দেখা, চোখ লাল বা শুষ্ক হওয়া, মাথাব্যথা এবং ঘাড় ও পিঠ ব্যথা। এ রোগ ধীরে ধীরে আরো বেশি অসুস্থ করে তুলতে পারে। তাই এটা দূর করতে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ আই হসপিটালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন অধ্যাপক এম নজরুল ইসলাম। তা হলো-
কম্পিউটারের মনিটর থেকে চোখ কমপক্ষে চার থেকে আট ইঞ্চি নিচে রাখা।
টানা দীর্ঘক্ষণ কাজ না করে মাঝেমধ্যে চোখের বিরতি দেওয়া। এ জন্য প্রতি ২০ মিনিট কাজ করার পর ২০ সেকেন্ড বিরতি এবং এ সময়ে কমপক্ষে ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তুর দিকে তাকানো (সবুজ প্রকৃতি হলে ভালো)। চোখের পানি যেন শুকিয়ে না যায় সে বিষয়ে সচেতন থাকা। বেশি শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ড্রপ ব্যবহার করা। মাঝে মধ্যে চেয়ার ছেড়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেওয়া। রাত জেগে কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ কাজ না করাই শ্রেয়। কাজ করলেও কোনো একটা আলো জ্বালিয়ে বা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখুন। কম্পিউটারে বসার সময় পিঠ সোজা রেখে সোজা চেয়ারে বসুন। যাদের চোখে রিফ্র্যাকশন বা প্রতিসরণের সমস্যা রয়েছে, তাদের অবশ্যই সঠিক চশমা ব্যবহার করা উচিত। এ জন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা ও চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
ইন্টারনেটে আসক্তি: প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে; কিন্তু তা যদি আসক্তি বা নেশায় রূপ নেয় তখন তাকে ইন্টারনেট আসক্তি বলে। এই অতিরিক্ত নেট আসক্তিকে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসর্ডার বা এডিএইচডি বলা হয়, যা এক প্রকার মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর সেখানে এডিএইচডিতে আক্রান্ত। এসব শিশু খিটখিটে মেজাজের হয়, মিথ্যা কথা বলে এবং সবার সঙ্গে অহেতুক তর্কে লিপ্ত হয়, স্কুলে রেজাল্টও খারাপ করে। পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, বিশিষ্ট মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহসানুল হাবিব বলেন, ইন্টারনেট আসক্তির মূল কারণগুলো হলো কৌতূহল ও উৎসাহ, তথ্য নিয়ে হিমশিম খাওয়া, সাইবার সেক্সে আসক্তি, ভার্চুয়াল বন্ধুবান্ধব, বিকল্প বিনোদন, ধোঁকাবাজি প্রভৃতি। সতর্ক হতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তা হলো-
ইন্টারনেট ব্যবহার যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে বা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখা, বিশেষ করে শিশুরা নেটে কীভাবে সময় ব্যয় করে অভিভাবকদের সেসব খোঁজখবর রাখা। চিত্তবিনোদনের অন্য উপায়গুলো বা খেলাধুলার প্রতি তাদের সম্পৃক্ত করা। আসক্তি কমানোর জন্য পর্নো সাইট ব্লক বা সফটওয়্যার ব্যবহার। নিজেকে পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি সময় দেওয়া। ঘরের বাইরে সময় কাটানো এবং অন্যান্য কাজকর্মে মনোযোগ বাড়ানো। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যায়াম বা মেডিটেশন।
লো ব্যাকপেইন (এলবিপি): মেরুদণ্ডের নিচের অংশের বা কোমরে ব্যথা, যা সাধারণত হাড় ও মাংসপেশির ক্ষয় হলে হয়। তবে পিসিতে দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে কাজ করতে গিয়ে অনেকে লো ব্যাকপেইন বা এলবিপিতে ভুগছেন। পঙ্গু হাসপাতালের হাড়, ট্রমা ও জোড়া বিশেষজ্ঞ এবং আর্থ্রোস্কোপিক সার্জন ডা. জি এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, যারা দীর্ঘক্ষণ বা কোনো বিরতি ছাড়াই চেয়ারে বসে পিসিতে বা ল্যাপটপে কাজ করেন, তাদের এ সমস্যা হতে পারে। তিনি এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তা হলো-
মেরুদণ্ড সোজা করে চেয়ারে বসা, বিশেষ করে মাথা সোজা রেখে কোমরের স্বাভাবিক বাঁক ঠিক রেখে এমনভাবে বসা, যাতে দেহের ভার কোমরে সমানভাবে পড়ে। সামনে ঝুঁকে দীর্ঘক্ষণ কাজ না করা। পেট ও পিঠের মাংসপেশি মজবুত রাখতে ব্যায়াম করা।
হাঁটা বা বসার সময় শরীর সোজা রাখা। মাঝে মাঝে শক্ত বিছানায় বা মেঝেতে টান টান হয়ে শুয়ে থাকা। ব্যথা বেশি হলে থেরাপি নেওয়া, ব্যায়াম করা বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
কার্পাল টানেল সিনড্রোম (সিটিএস): এটি কবজির প্রদাহজনিত রোগ। কার্পাল টানেল অর্থাৎ কবজির হাড় ও সংশ্লিষ্ট পেশির সংযোগকারী টেন্ডনগুলোর মধ্যবর্তী সুড়ঙ্গে মিডিয়ান স্নায়ুর চাপে এই প্রদাহ হয়। যারা নিয়মিত কম্পিউটারে কাজ করতে গিয়ে ক্রমাগতভাবে কবজির ওপর চাপ ফেলেন, বিশেষ করে যারা বেশিক্ষণ ধরে টাইপিংয়ের কাজে নিয়োজিত থাকেন, তারা এ সমস্যায় বেশি ভোগেন। সাধারণত মাউস ব্যবহারে হাত আক্রান্ত হয় এবং কি-বোর্ড ব্যবহার থেকেও এটি হতে পারে। কবজিসন্ধিতে ব্যথা বা অস্বস্তি, হাতের পেশিতে ব্যথা ও হাত অসাড় মনে হওয়া, রাতে ব্যথা হওয়া, শক্ত হয়ে যাওয়া, হাতে শক্তি না পাওয়া ইত্যাদি প্রধান লক্ষণ। এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে অ্যাপোলো হসপিটালস ঢাকার অর্থোপেডিকস কনসালট্যান্ট ডা. ও এফ জি কিবরিয়া বলেছেন, কিছু ব্যায়াম আছে যা করলে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কবজির ব্যায়াম অন্যতম। এছাড়া তিনি আরগোনোমিকস কিবোর্ড ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন; যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করা যায়।
ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি): কম্পিউটার সিনড্রোমগুলোর মধ্যে মারাত্মক রোগ ডিপ ভেইন সিনড্রোম; যাকে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ডিভিটি বলে। যারা কোনো বিরতি ছাড়াই এক দিনে একটানা প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করেন, তাদের পায়ের রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এভাবে জমাট বাঁধতে বাঁধতে ফুসফুস পর্যন্ত চলে আসে। তখন রক্ত চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় শ্বাসকষ্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা বসে কম্পিউটারে কাজ করলে হাতের আঙুল ছাড়া তেমন কোনো অঙ্গ সঞ্চালন হয় না। ফলে রক্ত জমাট বাঁধাই স্বাভাবিক। আর পায়ের রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হলে তা দ্রুত ফুসফুসে ছড়ায়। ডাক্তাররা এ রোগটিকে ইকোনমি ক্লাস সিনড্রোমও বলে থাকেন। এসব সমস্যায় কী করণীয় এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. জিএম সাকলায়েন। তা হলো-
যখন কম্পিউটার ব্যবহার করবেন, তখন ১৫-২০ মিনিট অন্তর চোখ মনিটর থেকে সরিয়ে নিন। কাজ করার সময় হাত-পা যথাসম্ভব নাড়াচাড়া করুন। মাঝেমধ্যে হাঁটাচলা করে আবার কাজ শুরু করুন। প্রচুর পানি পান করুন। ঘণ্টায় কমপক্ষে পাঁচ মিনিট পেশি, চোখ, হাত ও পায়ের ব্যায়াম করুন।
লেখক: স্বাস্থ্য বিষয়ক সাংবাদিক