ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কের দেশ। সারা দেশে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ১৪ হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ‘ভৌত অবকাঠামো’ দিক বিবেচনা করলে এটা নিঃসন্দেহে ভালো সাফল্য। কিন্তু এই বিশাল আয়োজনের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না সেবার নিম্নমান ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে।
ক্লিনিকগুলোয় রোগীরা গেলে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সাক্ষাৎ পান যিনি অল্প সরঞ্জাম ও সীমিত প্রশিক্ষণ নিয়ে সেবা দিচ্ছেন। তার হাতে থাকে পুরোনো কাগজের রেজিস্টার, থাকে না সঠিক রোগ নির্ণয়ে প্রযুক্তির সহায়তা, না আছে ভালো তদারকি। আর এর ফলে ভুল চিকিৎসা, অপ্রয়োজনীয় রেফারেল, রোগ আরও জটিল হওয়া, আর এমন অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অথচ একটু উদ্যোগী হলে এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই বিস্তৃত নেটওয়ার্কের সুফল পাওয়া যেত।
দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দফায় দফায় প্রশিক্ষণ দেওয়া, নতুন ভবন নির্মাণ, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে এমবিবিএস চিকিৎসক নিয়োগ ইত্যাদি উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো যথেষ্ট সংখ্যক এমবিবিএস চিকিৎসককে গ্রামে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি বা হবেও না। তারা ভালো সুযোগের খোঁজে শহরে চলে যান আর এটা ঠেকানোর আপাত কোনো পলিসি খুব একটা সামনে নেই। এই প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ডিজিটাল রূপান্তর হতে পারে বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবসম্মত ও টেকসই সমাধান। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা, যা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে সহজ, দ্রুত ও নির্ভুল করে তোলে। মোবাইল অ্যাপ, ট্যাবলেট, ক্লাউড ডেটা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও প্রশাসন সবাই একই সিস্টেমে যুক্ত থাকে। এতে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়া যেমন সহজ হয়, অন্যদিকে ডেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষণ হওয়ায় তদারকি ও পরিকল্পনাও উন্নত হয়।
বাংলাদেশে এ ধরনের ডিজিটাল উদ্যোগের একটি সফল উদাহরণ হলো ‘সমন্বিত শিশুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন; যা ভবিষ্যতের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল হতে পারে। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, জ্বর বা অপুষ্টিজনিত রোগ এখনো মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এই রোগগুলো প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় আইএমসিআই কৌশল বিশ্বজুড়ে কার্যকর হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও এটি বহু বছর ধরে চালু আছে, কিন্তু বিভিন্ন ঘাটতির কারণে এর পূর্ণ সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা, যা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে সহজ, দ্রুত ও নির্ভুল করে তোলে। মোবাইল অ্যাপ, ট্যাবলেট, ক্লাউড ডেটা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও প্রশাসন সবাই একই সিস্টেমে যুক্ত থাকে। এই সীমাবদ্ধতা কাটাতেই তৈরি হয় আইএমসিআই ডিজিটাল অ্যাপ যা একটি ট্যাবলেট বা স্মার্টফোনভিত্তিক সফটওয়্যার- যা ধাপে ধাপে স্বাস্থ্যকর্মীকে শিশুর রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে। শিশুর বয়স, ওজন, উপসর্গ বা তাপমাত্রা ইনপুট দিলে অ্যাপটি বলে দেয় কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে, কোন ওষুধ দিতে হবে এবং কখন শিশুকে রেফার করতে হবে।
গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে রেফারেল বার্তা দেয় এবং সব তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপলোড হয় জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থায় (উঐওঝ২)। মজার বিষয় হলো, এটি ইন্টারনেট না থাকলেও ব্যবহার করা যায় তবে ইন্টারনেটের আওতায় আসলে ডাটা আপলোড করা যায়। বর্তমানে সিএইচসিপিদের সরকার থেকে ল্যাপটপ দেওয়া আছে এবং প্রত্যেকে মাসে ১৫ গিগাবাইটের মতো ডাটা ব্যবহার করতে পারেন সরকারি খরচে। তাই তেমন কোনো নতুন আয়োজনেরও দরকার নেই। এর জন্য মূলত প্রশিক্ষণই দরকার।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, এই অ্যাপটির ভালো কার্যকারিতা রয়েছে। বরিশাল জেলায় পাইলট প্রকল্পের ফলাফল ছিল আশাব্যঞ্জক। তা হলো ১. অপ্রয়োজনীয় হাসপাতাল ভর্তি ও পুনঃভর্তি কমেছে। ফলে শিশুরা ঘরের কাছেই সেবা পাচ্ছে। ২. চিকিৎসার মান বেড়েছে। কারণ স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন সঠিক গাইডলাইন অনুসরণ করছেন এবং ৩. পরিবারের খরচ ও চিকিৎসার পেছনে সময় ব্যয় কমেছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রতিটি গ্রামে এমবিবিএস ডাক্তার পাঠানো সম্ভব নয় এবং পাঠালেও তাদের দীর্ঘদিন ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু প্রযুক্তি এই সীমাবদ্ধতাকে সুযোগে পরিণত করতে পারে।
আইএমসিআই অ্যাপের মতো সমাধান স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘গাইডলাইন নির্ভর চিকিৎসক’ হিসেবে গড়ে তোলে। তারা এখন আত্মবিশ্বাসী। কারণ অ্যাপ তাদের বলে দেয় পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। রোগীর পিতা-মাতা যখন জানতে পারেন তাদের সন্তানের চিকিৎসা একটি উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন তাদের আস্থাও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় তদারকি আরো সহজ হয়। কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দূর থেকেই দেখতে পারেন কোন ক্লিনিকে কী ধরনের রোগ বাড়ছে, কোন জায়গায় ওষুধের ঘাটতি হচ্ছে ইত্যাদি। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত ও তথ্যভিত্তিক হবে; যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দক্ষতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
ডিজিটাল অ্যাপ শুধু অসুখ শনাক্ত করার উপকরণ নয়। এটি হতে পারে শিশুর সামগ্রিক বিকাশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যম। ভবিষ্যতে এই প্ল্যাটফর্মে শিশুর বৃদ্ধি, ওজন-উচ্চতা, টিকা গ্রহণ, আচরণ ও শেখার ক্ষমতা সংক্রান্ত তথ্য যুক্ত করা যেতে পারে। একই অ্যাপে যদি শিশুর বিকাশজনিত বিলম্ব, অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ বা কথাবার্তার বিলম্ব চিহ্নিত করার সহজ প্রশ্ন বা চেকলিস্ট যুক্ত করা যায়; তাহলে গ্রামের শিশুরাও সময়মতো প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা রেফারেল পেতে পারে। এভাবে আইএমসিআই অ্যাপ শুধু রোগ নিরাময় নয় বরং শিশুর সামগ্রিক বিকাশে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ ব্যয় করে; যার বড় অংশই অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় অপচয় হয়। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ এই অদক্ষতা কমিয়ে আর্থিক সাশ্রয় এনে দিতে পারে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষেত্রেই ডিজিটাল পরিষেবা বেড়েছে। নাগরিক সেবা, মোবাইল ব্যাংকিং, শিক্ষায় প্রযুক্তি সব জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্যখাতে সেই একই বিপ্লব আনার। প্রায় ১৪ হাজার ক্লিনিক, বিস্তৃত ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, আর অপেক্ষাকৃত তরুণ, প্রযুক্তি-সচেতন স্বাস্থ্যকর্মী আমাদের হাতে প্রস্তুত আছে।
যা দরকার, তা হলো একটি সমন্বিত ডিজিটাল স্বাস্থ্য ইকোসিস্টেম, যেখানে আইএমসিআই অ্যাপের মতো সলিউশনগুলো একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকবে। এই ব্যবস্থা প্রাথমিক সেবাকে করবে ‘স্মার্ট’। কারণ এতে রোগীর ইতিহাস, প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট, সবই রাখা যাবে এক জায়গায়। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত রেফারেল সিস্টেম করা যাবে ডিজিটাল ও ট্র্যাকযোগ্য। একই সঙ্গে এই প্ল্যাটফর্মের ওপর ভিত্তি করে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা, অসংক্রামক রোগ সংক্রান্ত সেবা, মানসিক স্বাস্থ্য ও বিশেষ করে বিষণ্নতা বা উদ্বেগের প্রাথমিক চিহ্ন নির্ণয়, টেলিমেডিসিনসহ অন্যান্য সেবা যুক্ত করা যাবে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ ব্যয় করে; যার বড় অংশই অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় অপচয় হয়। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ এই অদক্ষতা কমিয়ে আর্থিক সাশ্রয় এনে দিতে পারে। এই গবেষণা দেখা যায়- যেহেতু এই ব্যবস্থা চালু করতে প্রশিক্ষণ ছাড়া আর তেমন কোনো বড় খরচ নেই। কারণ ল্যাপটপ ইতোমধ্যেই দেওয়া আছে, ইন্টারনেট দেওয়া আছে, ডিএইচআইএস২-এর জন্য নতুন কোনো খরচ নেই। তাই এ খাতে সামান্য খরচ করে ব্যাপক রিটার্ন পাওয়া যায়। বিশ্বের খুব কম স্বাস্থ্য কর্মসূচিই এত কম খরচে এত বেশি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুফল দিতে পারে।
এখন সময় আইএমসিআই অ্যাপের মতো উদ্ভাবনগুলো জাতীয় পর্যায়ে প্রসারিত করার। সরকার চাইলে ধাপে ধাপে পুরো দেশে এই প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারে। প্রথমে শিশুস্বাস্থ্য, তারপর মাতৃস্বাস্থ্য ও টেলিমেডিসিন। যথাযথ প্রশিক্ষণ, ডিভাইসের জোগান এবং স্থানীয় পর্যায়ে ইন্টারনেট সহায়তা থাকলে এ উদ্যোগ সফল হবে।
বাংলাদেশ তার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মজবুত অবকাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করেছে। কিন্তু এর সুফল পেতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহারই আপাত সমাধান। আইএমসিআই ডিজিটাল অ্যাপ প্রমাণ করেছে যে অল্প বিনিয়োগ ও কার্যকর নেতৃত্বের মাধ্যমে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা সম্ভব। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল রূপান্তরই বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সবচেয়ে স্মার্ট, সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান।
লেখক: অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ





















