ঢাকা ০২:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫

প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের সুযোগ

  • আপডেট সময় : ০৫:৪০:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

মোহাম্মদ আনোয়ার

বাংলাদেশের গর্ব এবং অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আজ প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বজুড়ে প্রায় এক কোটি সংখ্যায় অবস্থান করছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠী শুধু দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজবুত করছেন না, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান। এ বিপুল অবদানের বিপরীতে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকাটা গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। প্রশ্ন উঠছে—এটি কি শুধু অবহেলার ফল, নাকি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ঘাটতি?

দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নীতিগত আলোচনা চললেও আইনি ও প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং প্রশাসনিক ধীরগতির কারণে এ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে যে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন, তা আশাবাদের নতুন দ্বার খুলেছে। নির্বাচন কমিশনও ‘প্রক্সি ভোট’, ‘পোস্টাল ব্যালট’ ও ‘অনলাইন ভোটিং’ পদ্ধতি বিবেচনা করে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ভোটাধিকার কোনো করুণা নয়, এটি নাগরিকের একটি সাংবিধানিক অধিকার। অথচ বাস্তবে প্রবাসীরা এখনো ভোটাধিকার প্রয়োগের বাইরে রয়েছেন। ২০২৪ সালের প্রবাসী দিবসে ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য, ‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার এখন সময়ের দাবি’- এ ঘোষণা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে তার অন্তরালে রয়েছে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, নীতিনির্ধারকদের দ্বিধা ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা।

বাংলাদেশের প্রচলিত ‘জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২’-এ প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই; যা একটি বড় আইনি অন্তরায়। দ্রুত এ আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রবাসীদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পথ সুগম করতে হবে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশের প্রবাসীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, ভারত, মেক্সিকো, পাকিস্তান, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াতেও প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ ভোটারের চেয়ে বেশি প্রবাসী ভোট প্রদান করেছে- এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তিনটি সম্ভাব্য মডেল বিবেচনায় নিচ্ছে- প্রক্সি ভোট, পোস্টাল ব্যালট ও অনলাইন ভোটিং। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, ‘প্রক্সি ভোট’ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও বাস্তবায়নযোগ্য। তবে পদ্ধতি নির্ধারণের পাশাপাশি প্রয়োজন আইনি ও প্রযুক্তিগত কাঠামোর উন্নয়ন এবং দূতাবাসগুলোকে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা দিতে সক্ষম করা।

প্রবাসীরা শুধু অর্থনীতির প্রাণ নয়। তারা দেশের সংকটে মানববন্ধন করেন, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন এবং নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকেন। অথচ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে নির্বাচনে, তাদের অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখন অনলাইন ভোটিং কোনো দুরূহ বিষয় নয়। ইচ্ছা ও অঙ্গীকার থাকলে, অনলাইন বা পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে সহজেই বিশ্বজুড়ে বসবাসরত প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন কয়েকটি সুসংহত উদ্যোগ-
আইনি সংস্কার: আরপিও-১৯৭২ সংশোধন করে প্রবাসীদের ভোটার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা।
প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি: নিরাপদ অনলাইন বা হাইব্রিড পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
দূতাবাসের সম্পৃক্ততা: ভোটার তালিকাভুক্তি, তথ্য যাচাই ও ভোটকেন্দ্র স্থাপনে দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় করা;
পাইলট প্রকল্প: প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইন বা পোস্টাল ভোটিং চালু করে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়া।

বিশ্বের অনেক দেশ যখন প্রবাসীদের ভোটাধিকারকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখছে, তখন বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? প্রবাসীদের নির্বাচনী অন্তর্ভুক্তি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, রাষ্ট্র ও প্রবাসী জনগণের মধ্যকার আস্থার সেতুবন্ধ দৃঢ় করবে। তাই এখন সময় এসেছে প্রবাসীদের ভোটাধিকারকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে রূপ দেওয়ার। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক কাজ নয়; বরং গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। নির্বাচন কমিশন, আইন প্রণেতা ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ ভোটাধিকার কোনো অনুগ্রহ নয়, এটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার। আর এ অধিকার নিশ্চিত করাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

লেখক: কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নের সুযোগ

আপডেট সময় : ০৫:৪০:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

মোহাম্মদ আনোয়ার

বাংলাদেশের গর্ব এবং অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আজ প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বজুড়ে প্রায় এক কোটি সংখ্যায় অবস্থান করছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠী শুধু দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মজবুত করছেন না, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান। এ বিপুল অবদানের বিপরীতে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকাটা গণতান্ত্রিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। প্রশ্ন উঠছে—এটি কি শুধু অবহেলার ফল, নাকি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ঘাটতি?

দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নীতিগত আলোচনা চললেও আইনি ও প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং প্রশাসনিক ধীরগতির কারণে এ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে যে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন, তা আশাবাদের নতুন দ্বার খুলেছে। নির্বাচন কমিশনও ‘প্রক্সি ভোট’, ‘পোস্টাল ব্যালট’ ও ‘অনলাইন ভোটিং’ পদ্ধতি বিবেচনা করে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ভোটাধিকার কোনো করুণা নয়, এটি নাগরিকের একটি সাংবিধানিক অধিকার। অথচ বাস্তবে প্রবাসীরা এখনো ভোটাধিকার প্রয়োগের বাইরে রয়েছেন। ২০২৪ সালের প্রবাসী দিবসে ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য, ‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার এখন সময়ের দাবি’- এ ঘোষণা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে তার অন্তরালে রয়েছে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, নীতিনির্ধারকদের দ্বিধা ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা।

বাংলাদেশের প্রচলিত ‘জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২’-এ প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই; যা একটি বড় আইনি অন্তরায়। দ্রুত এ আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রবাসীদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পথ সুগম করতে হবে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশের প্রবাসীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, ভারত, মেক্সিকো, পাকিস্তান, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াতেও প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ ভোটারের চেয়ে বেশি প্রবাসী ভোট প্রদান করেছে- এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তিনটি সম্ভাব্য মডেল বিবেচনায় নিচ্ছে- প্রক্সি ভোট, পোস্টাল ব্যালট ও অনলাইন ভোটিং। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, ‘প্রক্সি ভোট’ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও বাস্তবায়নযোগ্য। তবে পদ্ধতি নির্ধারণের পাশাপাশি প্রয়োজন আইনি ও প্রযুক্তিগত কাঠামোর উন্নয়ন এবং দূতাবাসগুলোকে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা দিতে সক্ষম করা।

প্রবাসীরা শুধু অর্থনীতির প্রাণ নয়। তারা দেশের সংকটে মানববন্ধন করেন, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন এবং নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকেন। অথচ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে নির্বাচনে, তাদের অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখন অনলাইন ভোটিং কোনো দুরূহ বিষয় নয়। ইচ্ছা ও অঙ্গীকার থাকলে, অনলাইন বা পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে সহজেই বিশ্বজুড়ে বসবাসরত প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন কয়েকটি সুসংহত উদ্যোগ-
আইনি সংস্কার: আরপিও-১৯৭২ সংশোধন করে প্রবাসীদের ভোটার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা।
প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি: নিরাপদ অনলাইন বা হাইব্রিড পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
দূতাবাসের সম্পৃক্ততা: ভোটার তালিকাভুক্তি, তথ্য যাচাই ও ভোটকেন্দ্র স্থাপনে দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় করা;
পাইলট প্রকল্প: প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইন বা পোস্টাল ভোটিং চালু করে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়া।

বিশ্বের অনেক দেশ যখন প্রবাসীদের ভোটাধিকারকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখছে, তখন বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? প্রবাসীদের নির্বাচনী অন্তর্ভুক্তি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, রাষ্ট্র ও প্রবাসী জনগণের মধ্যকার আস্থার সেতুবন্ধ দৃঢ় করবে। তাই এখন সময় এসেছে প্রবাসীদের ভোটাধিকারকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে রূপ দেওয়ার। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক কাজ নয়; বরং গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। নির্বাচন কমিশন, আইন প্রণেতা ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ ভোটাধিকার কোনো অনুগ্রহ নয়, এটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার। আর এ অধিকার নিশ্চিত করাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

লেখক: কলামিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ