সাহিত্য ডেস্ক : কালজয়ী ঔপন্যাসিক ও দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার মারা গেছেন। গত ৮ মে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
সমরেশ মজুমদার একাধারে নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি ও কিশোর উপন্যাস লেখক ছিলেন। মানবজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার রসায়ন প্রকাশ পায় তার লেখায়। বিশেষত তার উপন্যাসগুলোর বিষয়বস্তু, রচনার গতি ও গল্প বলার স্টাইল পাঠকের কাছে তাকে স্বকীয় উচ্চতায় আসীন করেছে। তার লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের নানা অনুষঙ্গ।
২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো সিলেট ভ্রমণ করেছিলেন ‘কালবেলা’র স্রষ্টা। সে সময় ‘বই প্রকাশের গল্প’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে শুনিয়েছিলেন নিজের লেখক হয়ে ওঠার গল্প। সমরেশ মজুমদারের লেখক হয়ে ওঠার গল্প মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনেন সিলেটের তিন শতাধিক ভক্ত ও লেখক এবং শিক্ষাবিদ। গল্পের সুরে, হাস্যরসে শোনান তার জীবন-বাস্তবতা এবং তার সৃষ্ট সাহিত্যকর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ের কথা।
অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদার বলেন, কলকাতার দেশ পত্রিকায় আমার প্রথম একটি গল্প ‘অন্তর আত্মা’ ছাপানোর জন্য দিয়েছিলাম। প্রথমে বললো এক সপ্তাহ পর ছাপা হবে এরপর খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এক মাস পর ছাপা হবে। প্রায় দেড় মাস পর গল্পটি ফেরত দেয় দেশ পত্রিকা। এরপর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদককে গল্প না ছাপানোর কারণ জানতে চাই। তখন ওরা বললো গল্পটি ছাপাখানায় পাঠানোর বদলে ভুল করে আপনার ঠিকানায় ফেরত গেছে। রেখে যান এক সপ্তাহ পর এটি ছাপা হবে। পরে কথামতো গল্পটি ছাপা হয় এবং ১৪ টাকা মাইনে পাই। এরপর গল্পটি পাঠকমহলে সমাদৃত হলে দেশ পত্রিকা পরে নিয়মিত আমার গল্প ছাপাতে শুরু করে। এভাবেই একজন সমরেশ মজুমদার লেখক হয়ে উঠি।
ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে নিজের শুরুর বিষয়ে সমরেশ মজুমদার জানান, মঞ্চনাটকের প্রতি তার খুব টান ছিল। প্রথম গল্পও লেখেন যে নাট্যদলটির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন সেই দলের একটি চিত্রনাট্য রচনার জন্য। যার নাম ছিল ‘অন্তর আত্মা’। কিন্তু সেটি নিয়ে মঞ্চদলটি নাটক করায় সেটি ছাপানোর জন্য দেশ পত্রিকায় পাঠান তিনি। ছাপেনি তারাও। পরে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গল্পটি ছাপান। গল্প ছাপানোর ফলে পত্রিকা থেকে তাকে ১৫ টাকা সম্মানি দেওয়া হয়। সেই টাকা তিনি বন্ধুদের নিয়ে কফি খেয়ে উড়িয়ে দেন। এরপর এই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা তাকে আরও লেখার জন্য তাগিদ দেন। সেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর লোভ থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে পদার্পণ করেন সমরেশ মজুমদার।
আলোচনায় উঠে আসে ‘সাতকাহন’ এর দীপাবলির কথাও। বলেন, আমার বাড়ির পাশে ১২ বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন সকালে সে আমার হাত ধরে বলেছিল, কাকু, আমাকে বাঁচাও। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন মেয়েটির বিয়ে ঠেকাতে পারিনি। তবে বিয়ের আটদিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, কাকু, আমি বেঁচে গেলাম। এখান থেকেই দীপাবলি চরিত্রটি তৈরি হয়। তিনি বলেন, আমরা পুরুষরা মেয়েদের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করি। কিন্তু দীপাবলি ধরনের মেয়ে না। কোনো পুরুষই তাকে স্ত্রী হিসেবে চান না। আর মেয়েরা তাকে জীবনের আদর্শ মনে করে। এটাই এ চরিত্রের সার্থকতা। দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় বারবারই উঠে আসে তার উপন্যাস-ত্রয়ী ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ প্রসঙ্গ। উপন্যাস-ত্রয়ী নিয়ে সমরেশ মজুমদার বলেন, এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লেখেননি। বলা যেতে পারে, বাধ্য হয়েই লিখেছেন। ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশের পরে পাঠকদের আগ্রহের পরে প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে বাকি দুই পর্ব লেখা হয়।
১৯৪২ সালের ১০ মার্চ উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় সমরেশ মজুমদারের জন্ম। শৈশব কাটে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে। স্কুলজীবন শুরু জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। ১৮ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে কলকাতায় আসেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের প্রচ- আসক্তি ছিল। যে কারণে তার প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটকের জন্য। সেই থেকে লেখকজীবনের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তার লেখা ‘অন্যমাত্রা’ গল্পটি দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে দেশ পত্রিকাতেই ছাপা হয় সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নি¤œবিত্ত মানুষের জীবন জীবন্ত হয়ে ওঠে তার লেখনিতে। সমরেশের লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘সাতকাহন’, ‘গর্ভধারিণী’, ‘তেরো পার্বণ’, ‘স্বপ্নের বাজার’, ‘উজান’, ‘গঙ্গা’, ‘ভিক্টোরিয়ার বাগান’, ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’, ‘অনুরাগ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার কালজয়ী ট্রিলজি উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান নিয়েছে।
দীর্ঘ লেখক জীবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু পুরস্কারে ভূষিত হন সমরেশ মজুমদার। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার পান তিনি। চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে পান বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির পুরস্কার। তিনি বাংলাদেশ ও কলকাতা তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষিদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন একজন শুদ্ধাচারী লেখক হিসেবে।
প্রথম গল্প লিখে ১৫ টাকা পেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার
জনপ্রিয় সংবাদ