ঢাকা ০৭:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫

প্রত্যাশা যেন সোনার পাথরবাটি

  • আপডেট সময় : ১১:২৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ৮৫ বার পড়া হয়েছে

এম আর খায়রুল উমাম : সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাগুলো দিনে দিনে যেন সোনার পাথরবাটি চাওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। চাণক্যের একটা কথা আছে ‘রাজা কর্ণেন পশ্যতি’ মানে রাজা চোখ দিয়ে নয়, কান দিয়েই রাজ্যের অবস্থা দেখেন। চোখ বন্ধ রেখে কান দিয়ে দেশের অবস্থা বুঝতে গিয়ে সাধারণ জনগণের চাওয়াগুলো সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক ও দুর্লভ বলে ক্ষমতাসীনদের মনে হচ্ছে। বিপরীতে সরকারের চাওয়াগুলোও সাধারণ মানুষের কাছে সোনার পাথরবাটি বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং বলাই যায়; উভয়পক্ষের মধ্যকার এহেন সমন্বয়হীনতাই বর্তমান পরিবেশসৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা পালন করছে। কেউ কারও অবস্থা বুঝতে পারছে এমন কোনো লক্ষণও নেই বললেই চলে। প্রত্যেকেই নিজেদের ভাবনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণেই এমনটা ঘটেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে হয়তো কথা বলার সুযোগ নেই কিন্তু সেই উন্নয়ন ও অগ্রগতি গণমানুষের কতটা কল্যাণে নিবেদিত তা নিয়ে নানাধরনের কথা শোনা যায়।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা খুবই সামান্য- সারা দিনের পরিশ্রমের পর পেট ভরার অন্ন আর ক্লান্তি দূর করার একটা বিছানা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের এই সামান্য চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়নি। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি আজ আকাশ ছোঁয়া, রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ, একটার পর একটা মেগাপ্রকল্পে রয়েছে সাফল্য, কোটিপতির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, শত কোটি টাকার বাজেট লক্ষ কোটিতে পৌঁছেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আয়ু বেড়েছে, অনেকের সেকেন্ড হোম হয়েছে, সমুদ্র বিজয় এসেছে, চাহিদার দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষার ভাবনা বেড়েছে। সাফল্যের খাতায় এমন আরও কত পালক সংযুক্ত হয়েছে তার হিসেব করা কঠিন। আর বিভাগওয়ারি সাফল্যের তালিকা সংরক্ষণ তো সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে। সাধারণ মানুষ এত কিছু জানতে চায় বলেও মনে হয় না এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত পরিবর্তনের কথাও এদের জানাতে চাওয়া হয় বলে বিশ্বাস হয় না। ওই কারণেই সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে রাজধানীর ঠান্ডা ঘরে বসে উন্নয়ন ও অগ্রগতি পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। এলাকার উন্নয়নের কারিগররা চিৎকার শুরু করলেই কেবল সাধারণ মানুষ জানতে পারে তাদের কল্যাণে কী সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে চলেছে।
দেশে এখন চালের বাজার অস্থির, আটা-ময়দার বাজার অস্থির, তেলের বাজার অস্থির, অস্থির আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যকার অস্থিরতা কাটাতে প্রতিদিন বাজার ও আড়তে অভিযান চলছে। অভিযান চলছে সাধারণ মানুষ যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে যায় সে এলাকাগুলোতে। এতে অভিযান চলাকালে জেল-জরিমানার ভয়ে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে অভিযান শেষ হলে বা অন্যত্র সরে গেলে বাজার আবারও অতীতের রূপ ফিরে পায়। সাধারণভাবে বিক্রেতারা ১০ টাকা কেজি আলু কিনে এনে ১২/১৫ টাকায় বিক্রি করে থাকে। ওজনে চুরি না করলে ক্রেতার কাছে প্রতিবার ২৫০/৫০০ গ্রাম বিক্রি করলে এদের লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে যায়। তাই সাধারণ মানুষের মনের অস্থিরতা দূর করতে এদের মেরে কোনো লাভ নেই। অভিযান পরিচালনাকারীরাও জানেন কারা ২ টাকার আলু ১০ টাকা দরে বাজার পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে কোনো অভিযান পরিচালিত হয় না।
যতদূর জানা যায় আলু বাদে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের জন্য আমরা বিদেশনির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজার বলা হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বলা হোক, জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সিংহভাগই ব্যবসায়ী, তাই ব্যবসার স্বপক্ষে ওনাদের অবস্থানও নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ওনারা যদি সিন্ডিকেট করে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে এই জায়গাটা বিবেচনার বাইরেই থেকে যায়। তদুপরি সাধারণ মানুষ যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অস্থির তখন সরকার খাড়ার ঘায়ের মতো পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ক্রিয়াশীল। নতুন বাজেটে অবধারিতভাবেই করের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে দেখা গিয়েছে। আবার এসব সরকারি সেবার মূল্যবৃদ্ধির সপক্ষে যুক্তি দেয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিরা তৎপর আছেন। সরকারিভাবেই যদি মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা যৌক্তিক হয় তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির আজকের বিশ্বে চাল-তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় কীভাবে? তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সোনার পাথরবাটি হয়েই থেকে যায়।
আসুন দেখা যাক, সরকার যদি উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাজার ব্যবস্থাকে মুক্ত করে দেয় তাহলে কী হবে? হতে পারে চাল ২০০ টাকা কেজি, ভোজ্য তেল ৫০০ টাকা কেজি, আটা-ময়দা ১৫০/২০০ টাকা কেজি, আলু ১০০ টাকা কেজি, ডাল ৩০০ টাকা কেজি, মাছ ১০০০ টাকা কেজি, মাংস ২০০০ টাকা কেজি। এদেশের সাধারণ মানুষ তো পেঁয়াজ-রসুন-আদা ৩০০ টাকা কেজি দরে খেয়েছেও। তখন যেহেতু কোনো সমস্যা হয়নি এখনো নিশ্চয়ই হবে না। এখন তো বরং সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অন্তর্ভুক্তদের ৫০০ টাকা করে দিচ্ছে, ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে তাহলে সমস্যা কোথায়? উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার দৌড়ে আছে দেশ, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ফলে সামর্থ্য বিবেচনায় মানুষ খাবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে বলে থাকেন মানুষ না খেয়ে মরে না, খেয়েই মরে। সেক্ষেত্রে তাই সাধারণ মানুষের উদরপূর্তির জন্য অভিযান পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় শ্রম ধ্বংস করার কোনো যুক্তি নেই। এই শ্রম দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্যবহৃত হলে দেশ ও জাতি লাভবান হবে।
সাধারণ জনগণের কল্যাণে সরকার নিরক্ষর মুক্ত জেলা, দুর্নীতিমুক্ত জেলা, ভিখারি মুক্ত জেলা, শতভাগ স্যানিটেশনের আওতায় আসা জেলার ঘোষণা দিয়েছে এবং আরও কত কি দিচ্ছে এবং দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে চলেছে। বিপরীতে সাধারণ মানুষ শুধু শ্রম দিচ্ছে। কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে বিদেশে শ্রম দিয়ে তারা সরকারের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এখন শুধু শ্রম দিয়েই যদি পেট ভরে খাওয়ার অধিকার জন্মে যায় তবে ব্যবসায়ীরা কি ঘরে বসে আঙুল চুষবে। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষদের শ্রমই তো মূলত তাদের ব্যবসার প্রধান হাতিয়ার। কৃষক ফসল উৎপাদন করে আর ব্যবসা করে তৃতীয় পক্ষ, শিল্পে শ্রমজীবী মানুষ শ্রম দেয় আর ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। শ্রমিকেরা ন্যূনতম খাবার জোটানোর অর্থ চাইলে পর্যন্ত ধমক খায়। বিদেশে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়ার আগে তাদের নিয়ে যে ব্যবসা হয় তাতে ঋণের জালে মানুষগুলোকে জড়িয়ে দেওয়া হয় যে বছরের পর বছর শ্রম বিক্রি করেও মুক্তি আসে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সোনার পাথরবাটি হয়ে ছিল, আছে এবং থাকবে।
রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক দায়িত্ব পাঁচ বছর পর পর ভোট দিয়ে নিজেদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা, যে দায়িত্ব গত কয়েক বছর ধরে পালনের প্রয়োজন পড়ে না। এখন সাধারণ মানুষের একটি দায়িত্ব আছে বাধ্যতামূলকভাবে রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করা। গ্রাম থেকে আসা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, মেসে বসবাস করা শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী মানুষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে নিজেদের বিশাল রাজনৈতিক অনুসারী হিসেবে দেখানোর প্রতিযোগিতা ছিল এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যদিও এখানে কিছু অর্থ বিনিময় হয়ে থাকে তবে তা অংশগ্রহণে বাধ্য হওয়াদের ভাগ্যে কতটা জোটে বলা যাবে না। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এসব রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট দলের অনুসারী হওয়ার দরকার নেই। যার যখন যেভাবে দরকার ওই চাহিদা পূরণ করলেই হবে। তুমি কী খাবে, তোমার পরিবার কী খাবে সে চিন্তা করার সময় কোথায় রাজনীতিবিদদের। আগে আমিত্বের জয় স্বীকার কর। উন্নয়নের কারিগর হিসেবে এরা নিজের এত উন্নতি করেছে যে তাতেই সাধারণ মানুষের শান্তি পাওয়া একান্ত কর্তব্য। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আত্ম ভাবনা অন্যায়, পাপ।
বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে টেকসই অর্থনীতির দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়েছে সেটা যেমন সত্য তেমনই সমবণ্টনের অব্যবস্থাটাও প্রকট এবং সমধিক সত্য। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা যেখানে মাত্র ৫ জন ছিল সেখানে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ জন। করোনা কালেও সংখ্যা বৃদ্ধির এই দুর্বার গতি বন্ধ হয়নি। মার্চ’ ২০২০ থেকে মার্চ’ ২০২২ এই দুই বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ২০ হাজার ৯৭২ জন। তাই সাধারণ মানুষ আশা করতে পারে এ বছরে যদি বন্যা হয় তবে তা এসব ভাগ্যবানদের সাথে নতুন আরও ভাগ্যবান মানুষ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। বন্যায় যদি নতুন করে ১০ হাজার ভাগ্যবান সৃষ্টি হয় তবেই উন্নয়ন আরও গতি পাবে। তবে এসবের মাঝেও একটু ভাবতে হবে করোনার প্রথম ২ মাসে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও কিন্তু দ্বিগুণ হয়েছে। আর এই দুয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এতটাই যে একটা বাড়লে অন্যটা বাড়তে বাধ্য। সাধারণ মানুষের চোখের ওপর ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ তা শুধু টাঙ্গিয়ে রাখলেই হবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কারণ কাজীর খাতায় তো লেখাই দেশের সব নাগরিক সমান, বৈষম্যহীন সমাজ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কী!
বাঙালির শ্বাশত প্রত্যাশা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। সাধারণ মানুষদের জন্য এ প্রত্যাশা এখন সোনার পাথরবাটি। দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এ একটা অসম্ভব প্রত্যাশা। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে পাওয়া তো সম্ভবই নয় আর সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সম্ভব নয়। ছোট কোনো ব্যবসা করেও প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয় বরং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করলে ভালো থাকা যায়। কারণ সমাজে যত সততার অভাব দেখা যাচ্ছে মানুষ ততই পরকালের সুখের আশায় দান করছে। তবে এ দানে যাতে এককভাবে কারও মুক্তি না আসে সেদিক বিবেচনায় রেখে তবেই দান করা হয়। ফলে সাধারণ জনগণ মরীচিকার পেছনে ঘুরতেই আছে, ঘুরতেই থাকবে অন্তহীন আবর্তে।
লেখক : কলামিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রত্যাশা যেন সোনার পাথরবাটি

আপডেট সময় : ১১:২৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

এম আর খায়রুল উমাম : সাধারণ জনগণের প্রত্যাশাগুলো দিনে দিনে যেন সোনার পাথরবাটি চাওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। চাণক্যের একটা কথা আছে ‘রাজা কর্ণেন পশ্যতি’ মানে রাজা চোখ দিয়ে নয়, কান দিয়েই রাজ্যের অবস্থা দেখেন। চোখ বন্ধ রেখে কান দিয়ে দেশের অবস্থা বুঝতে গিয়ে সাধারণ জনগণের চাওয়াগুলো সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক ও দুর্লভ বলে ক্ষমতাসীনদের মনে হচ্ছে। বিপরীতে সরকারের চাওয়াগুলোও সাধারণ মানুষের কাছে সোনার পাথরবাটি বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং বলাই যায়; উভয়পক্ষের মধ্যকার এহেন সমন্বয়হীনতাই বর্তমান পরিবেশসৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা পালন করছে। কেউ কারও অবস্থা বুঝতে পারছে এমন কোনো লক্ষণও নেই বললেই চলে। প্রত্যেকেই নিজেদের ভাবনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণেই এমনটা ঘটেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে হয়তো কথা বলার সুযোগ নেই কিন্তু সেই উন্নয়ন ও অগ্রগতি গণমানুষের কতটা কল্যাণে নিবেদিত তা নিয়ে নানাধরনের কথা শোনা যায়।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা খুবই সামান্য- সারা দিনের পরিশ্রমের পর পেট ভরার অন্ন আর ক্লান্তি দূর করার একটা বিছানা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের এই সামান্য চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়নি। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি আজ আকাশ ছোঁয়া, রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ, একটার পর একটা মেগাপ্রকল্পে রয়েছে সাফল্য, কোটিপতির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, শত কোটি টাকার বাজেট লক্ষ কোটিতে পৌঁছেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আয়ু বেড়েছে, অনেকের সেকেন্ড হোম হয়েছে, সমুদ্র বিজয় এসেছে, চাহিদার দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষার ভাবনা বেড়েছে। সাফল্যের খাতায় এমন আরও কত পালক সংযুক্ত হয়েছে তার হিসেব করা কঠিন। আর বিভাগওয়ারি সাফল্যের তালিকা সংরক্ষণ তো সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে। সাধারণ মানুষ এত কিছু জানতে চায় বলেও মনে হয় না এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত পরিবর্তনের কথাও এদের জানাতে চাওয়া হয় বলে বিশ্বাস হয় না। ওই কারণেই সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করে রাজধানীর ঠান্ডা ঘরে বসে উন্নয়ন ও অগ্রগতি পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। এলাকার উন্নয়নের কারিগররা চিৎকার শুরু করলেই কেবল সাধারণ মানুষ জানতে পারে তাদের কল্যাণে কী সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে চলেছে।
দেশে এখন চালের বাজার অস্থির, আটা-ময়দার বাজার অস্থির, তেলের বাজার অস্থির, অস্থির আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যকার অস্থিরতা কাটাতে প্রতিদিন বাজার ও আড়তে অভিযান চলছে। অভিযান চলছে সাধারণ মানুষ যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে যায় সে এলাকাগুলোতে। এতে অভিযান চলাকালে জেল-জরিমানার ভয়ে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে অভিযান শেষ হলে বা অন্যত্র সরে গেলে বাজার আবারও অতীতের রূপ ফিরে পায়। সাধারণভাবে বিক্রেতারা ১০ টাকা কেজি আলু কিনে এনে ১২/১৫ টাকায় বিক্রি করে থাকে। ওজনে চুরি না করলে ক্রেতার কাছে প্রতিবার ২৫০/৫০০ গ্রাম বিক্রি করলে এদের লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে যায়। তাই সাধারণ মানুষের মনের অস্থিরতা দূর করতে এদের মেরে কোনো লাভ নেই। অভিযান পরিচালনাকারীরাও জানেন কারা ২ টাকার আলু ১০ টাকা দরে বাজার পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে কোনো অভিযান পরিচালিত হয় না।
যতদূর জানা যায় আলু বাদে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের জন্য আমরা বিদেশনির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজার বলা হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বলা হোক, জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সিংহভাগই ব্যবসায়ী, তাই ব্যবসার স্বপক্ষে ওনাদের অবস্থানও নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ওনারা যদি সিন্ডিকেট করে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে এই জায়গাটা বিবেচনার বাইরেই থেকে যায়। তদুপরি সাধারণ মানুষ যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অস্থির তখন সরকার খাড়ার ঘায়ের মতো পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ক্রিয়াশীল। নতুন বাজেটে অবধারিতভাবেই করের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে দেখা গিয়েছে। আবার এসব সরকারি সেবার মূল্যবৃদ্ধির সপক্ষে যুক্তি দেয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিরা তৎপর আছেন। সরকারিভাবেই যদি মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা যৌক্তিক হয় তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির আজকের বিশ্বে চাল-তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় কীভাবে? তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সোনার পাথরবাটি হয়েই থেকে যায়।
আসুন দেখা যাক, সরকার যদি উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাজার ব্যবস্থাকে মুক্ত করে দেয় তাহলে কী হবে? হতে পারে চাল ২০০ টাকা কেজি, ভোজ্য তেল ৫০০ টাকা কেজি, আটা-ময়দা ১৫০/২০০ টাকা কেজি, আলু ১০০ টাকা কেজি, ডাল ৩০০ টাকা কেজি, মাছ ১০০০ টাকা কেজি, মাংস ২০০০ টাকা কেজি। এদেশের সাধারণ মানুষ তো পেঁয়াজ-রসুন-আদা ৩০০ টাকা কেজি দরে খেয়েছেও। তখন যেহেতু কোনো সমস্যা হয়নি এখনো নিশ্চয়ই হবে না। এখন তো বরং সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অন্তর্ভুক্তদের ৫০০ টাকা করে দিচ্ছে, ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে তাহলে সমস্যা কোথায়? উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার দৌড়ে আছে দেশ, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ফলে সামর্থ্য বিবেচনায় মানুষ খাবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে বলে থাকেন মানুষ না খেয়ে মরে না, খেয়েই মরে। সেক্ষেত্রে তাই সাধারণ মানুষের উদরপূর্তির জন্য অভিযান পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় শ্রম ধ্বংস করার কোনো যুক্তি নেই। এই শ্রম দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্যবহৃত হলে দেশ ও জাতি লাভবান হবে।
সাধারণ জনগণের কল্যাণে সরকার নিরক্ষর মুক্ত জেলা, দুর্নীতিমুক্ত জেলা, ভিখারি মুক্ত জেলা, শতভাগ স্যানিটেশনের আওতায় আসা জেলার ঘোষণা দিয়েছে এবং আরও কত কি দিচ্ছে এবং দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে চলেছে। বিপরীতে সাধারণ মানুষ শুধু শ্রম দিচ্ছে। কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে বিদেশে শ্রম দিয়ে তারা সরকারের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এখন শুধু শ্রম দিয়েই যদি পেট ভরে খাওয়ার অধিকার জন্মে যায় তবে ব্যবসায়ীরা কি ঘরে বসে আঙুল চুষবে। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষদের শ্রমই তো মূলত তাদের ব্যবসার প্রধান হাতিয়ার। কৃষক ফসল উৎপাদন করে আর ব্যবসা করে তৃতীয় পক্ষ, শিল্পে শ্রমজীবী মানুষ শ্রম দেয় আর ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। শ্রমিকেরা ন্যূনতম খাবার জোটানোর অর্থ চাইলে পর্যন্ত ধমক খায়। বিদেশে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়ার আগে তাদের নিয়ে যে ব্যবসা হয় তাতে ঋণের জালে মানুষগুলোকে জড়িয়ে দেওয়া হয় যে বছরের পর বছর শ্রম বিক্রি করেও মুক্তি আসে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সোনার পাথরবাটি হয়ে ছিল, আছে এবং থাকবে।
রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক দায়িত্ব পাঁচ বছর পর পর ভোট দিয়ে নিজেদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা, যে দায়িত্ব গত কয়েক বছর ধরে পালনের প্রয়োজন পড়ে না। এখন সাধারণ মানুষের একটি দায়িত্ব আছে বাধ্যতামূলকভাবে রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করা। গ্রাম থেকে আসা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, মেসে বসবাস করা শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী মানুষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে নিজেদের বিশাল রাজনৈতিক অনুসারী হিসেবে দেখানোর প্রতিযোগিতা ছিল এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যদিও এখানে কিছু অর্থ বিনিময় হয়ে থাকে তবে তা অংশগ্রহণে বাধ্য হওয়াদের ভাগ্যে কতটা জোটে বলা যাবে না। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এসব রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট দলের অনুসারী হওয়ার দরকার নেই। যার যখন যেভাবে দরকার ওই চাহিদা পূরণ করলেই হবে। তুমি কী খাবে, তোমার পরিবার কী খাবে সে চিন্তা করার সময় কোথায় রাজনীতিবিদদের। আগে আমিত্বের জয় স্বীকার কর। উন্নয়নের কারিগর হিসেবে এরা নিজের এত উন্নতি করেছে যে তাতেই সাধারণ মানুষের শান্তি পাওয়া একান্ত কর্তব্য। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে আত্ম ভাবনা অন্যায়, পাপ।
বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে টেকসই অর্থনীতির দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়েছে সেটা যেমন সত্য তেমনই সমবণ্টনের অব্যবস্থাটাও প্রকট এবং সমধিক সত্য। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা যেখানে মাত্র ৫ জন ছিল সেখানে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ জন। করোনা কালেও সংখ্যা বৃদ্ধির এই দুর্বার গতি বন্ধ হয়নি। মার্চ’ ২০২০ থেকে মার্চ’ ২০২২ এই দুই বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ২০ হাজার ৯৭২ জন। তাই সাধারণ মানুষ আশা করতে পারে এ বছরে যদি বন্যা হয় তবে তা এসব ভাগ্যবানদের সাথে নতুন আরও ভাগ্যবান মানুষ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। বন্যায় যদি নতুন করে ১০ হাজার ভাগ্যবান সৃষ্টি হয় তবেই উন্নয়ন আরও গতি পাবে। তবে এসবের মাঝেও একটু ভাবতে হবে করোনার প্রথম ২ মাসে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও কিন্তু দ্বিগুণ হয়েছে। আর এই দুয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এতটাই যে একটা বাড়লে অন্যটা বাড়তে বাধ্য। সাধারণ মানুষের চোখের ওপর ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ তা শুধু টাঙ্গিয়ে রাখলেই হবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কারণ কাজীর খাতায় তো লেখাই দেশের সব নাগরিক সমান, বৈষম্যহীন সমাজ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কত কী!
বাঙালির শ্বাশত প্রত্যাশা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। সাধারণ মানুষদের জন্য এ প্রত্যাশা এখন সোনার পাথরবাটি। দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এ একটা অসম্ভব প্রত্যাশা। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে পাওয়া তো সম্ভবই নয় আর সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সম্ভব নয়। ছোট কোনো ব্যবসা করেও প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয় বরং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করলে ভালো থাকা যায়। কারণ সমাজে যত সততার অভাব দেখা যাচ্ছে মানুষ ততই পরকালের সুখের আশায় দান করছে। তবে এ দানে যাতে এককভাবে কারও মুক্তি না আসে সেদিক বিবেচনায় রেখে তবেই দান করা হয়। ফলে সাধারণ জনগণ মরীচিকার পেছনে ঘুরতেই আছে, ঘুরতেই থাকবে অন্তহীন আবর্তে।
লেখক : কলামিস্ট