তাহ্সিনা তাসনিম মৃদু : ধরে নিলাম ‘ঢণত’ অধম ছিল। তাই বলে উত্তম হওয়ার নজির স্থাপন করা যেত নাকি? একজন আইনজীবী জানেন তার আপন ঘর ছাড়াও আরেকটি ঘর রয়েছে। সে ঘরের নাম হলো আদালত এবং সেখানে তার সঙ্গে বসবাসকারী সদস্যকে সে বন্ধু (লার্নেড ফ্রেন্ড) বলে। বন্ধুত্বের মাঝে বিবাদ হয়নি এমন কোনো বন্ধু অভিজ্ঞতা কারও রয়েছে কি?
মানুষ সামাজিক জীব হলেও মনুষ্য প্রকৃতি হলো সহাবস্থানকারীদের সাথে মাঝে মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়া। আবার এই মানুষই প্রচণ্ড মানবিক আচরণ করতে জানে। এই যেমন, মানুষ কখনো কখনো ভাই-বোনদের সাথে একটা ছোট রুম ভাগাভাগি করা নিয়েও বিবাদে জড়িয়ে যায়। আবার পৃথিবীজুড়ে এই মানুষই চিনে না জানে না হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিলিস্তিনবাসী ও তাদের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রার্থনা করে, তাদের কষ্ট দেখে বিমর্ষ হয়, প্রতিবাদ করে।
এত ভূমিকার অবতারণা যে প্রসঙ্গে, ৬ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় অনলাইনে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম দেখি, তা হলো- ‘আওয়ামীপন্থি ৮৪ আইনজীবীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ’। দেশের সব শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য গণমাধ্যমেও এভাবেই এসেছে সংবাদটি। এই সংবাদের বরাতে জানা যায়, ৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখে এসব আওয়ামীপন্থি আইনজীবী আদালত প্রাঙ্গণে বিরোধী মতের আইনজীবীদের ওপর হামলা, চেম্বার ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটান।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার ৬ মাস পরে একজন আইনজীবী বাদী হয়ে মামলা করলে আওয়ামীপন্থি আসামি আইনজীবীরা উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেন। সেই আগাম জামিন শেষ হওয়ার পূর্বে নিম্ন আদালতে ৯৩ জন আসামি আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের আবেদন করলে ৮৪ জন আইনজীবীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ ঘটনা কেন্দ্র করে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন বারের আইনজীবী সমাজের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একপক্ষ এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছেন, কেউ নিন্দা জানাচ্ছেন, কেউ করছেন প্রতিবাদ। আবার কেউ কেউ সন্তুষ্টি প্রকাশসহ একে কর্মফল ও প্রকৃতির বিচার বলে আখ্যায়িত করছেন।
প্রথম কথা হলো জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর এ ব্যাপারটি আদালতের এখতিয়ার (ফরংপৎবঃরড়হ)। এ নিয়ে কথা নেই। তবে চিন্তার বিষয় হলো, মতামত প্রকাশ ও তার ধরন নিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের মামলা নতুন কিছু নয়। যদিও সব মামলা আইন ও অপরাধ দ্বারা সংজ্ঞায়িত হওয়ার কথা, তবুও সব ক্ষমতার পালাবদলে সাধারণ মানুষের কাছে এ মামলাগুলোর একটি নাম দাঁড়িয়ে গেছে, তা হলো ‘রাজনৈতিক মামলা’। আর এসব মামলার ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি যে অনেকটাই নির্ভর করে ক্ষমতার মসনদের ওপর- এ এক অপ্রিয় সত্য।
এ ধরনের ঘটনায় প্রতিহিংসামূলক অভিপ্রকাশ মানে হলো প্রতিহিংসার চক্রকে এগিয়ে নেওয়া। প্রতিহিংসার একই রাস্তায় হাঁটলে তথাকথিত প্রতিশোধ গ্রহণ হয়তো হবে, তবে এই প্রতিশোধের আগুনের লেলিহান শিখা এত উত্তাপ ছড়াতে পারে যে ভস্ম হয়ে যেতে পারে আমাদের ঘর এবং সেই উত্তাপে পুড়বে সবাই, রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক।
ক্ষমতা কখন কার হাতে ন্যস্ত হবে, তা উপরওয়ালা ও নির্বাচন নির্ধারণ করেন। ইতিহাস সাক্ষী, আজ যে রাজা কাল সে নিঃস্ব হয়ে যেতে সময় লাগে না। তাই প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা না করে সহনশীলতার পরিচর্যা করাই উত্তম সিদ্ধান্ত। আগে বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী আইনজীবীদের ওপর এমনই বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য বাহবা নিশ্চয়ই দেওয়া হয়নি। তাহলে এখনো বাহবা পাওয়ার মতো কিছুই হলো না; বরং এই চক্র চলতে থাকলে আরও নষ্ট হতে থাকবে পরিবেশ।
প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের কোনো এক উপন্যাসে পড়েছিলাম- মানুষ সবসময় সুখস্মৃতি বা অন্যের উদার হওয়ার বিষয়টিই মনে রাখে, দুঃখ-কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো বেশি দিন মানসপটে স্থায়ী হয় না।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা শুধু ধ্বংসকেই আহ্বান জানায়। এ ধরনের কার্যে কারো বৃহৎ, উত্তম বা বিশেষ হওয়ার কোনো সুযোগ মানব ইতিহাসে নেই। প্রতিহিংসার বদলে উদারতা দেখালে যে শুধু মানসপটে জায়গা করে নেওয়া যায় তা-ই নয়, বরং এটি একটি উত্তম রাজনৈতিক কৌশলও বটে।
আমাদের দেশের সার্বিক চিত্র খুব যে আদর্শ নয়, তা সবাই কম বেশি উপলব্ধি করতে পারি। দেশে উগ্রবাদীদেরও অভাব নেই। দেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে, ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষোভকে পুনরায় জাগ্রত না করে, ধৈর্য ধারণ করলে সৃষ্টিকর্তা উত্তম প্রতিদান দেবেন আশা রাখি। সৃষ্টিকর্তার আদালত থেকেও একদিন ডাক পড়বে সবার, সেদিন কী জবাব দেবো আমরা? ঘৃণার জবাব ঘৃণাতেই দিয়েছিলাম!
আমরা একে অপরের উদ্দেশে বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসামূলক শব্দ উচ্চারণ থেকে বিরত থাকতে পারি। ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ বাক্য থেকেও বেরিয়ে আসতে পারি। এরকম চলতে থাকলে প্রতিহিংসা কেবল জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধিই পাবে।
আমাদের উদ্দেশ্য তো ‘জঁষব ড়ভ খধ’ি প্রতিষ্ঠা করা। এটা আমার একান্ত বিশ্বাস, দলমত নির্বিশেষে আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসি। এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক তা আমরা সবাই চাই। শুধু চাওয়াগুলোর ধরনের পার্থক্যের কারণে আমাদের মাঝে এত বিবাদ। দেশের হিতে এই চাওয়া-পাওয়ার একটি প্রকারকে যদি আমি ‘সংস্কার’ ধরে নিই, আর এ সংস্কারের নামে যদি কোনো অপসংস্কৃতির লিগ্যাসি তথা প্রতিহিংসার চক্রকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি আর সংস্কার থাকে কি? থাকে না। যা থাকে তা হলো- ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
বহিরাগতদের কোর্ট অঙ্গনে ঢুকে তাফালিং, বিচারকের দিকে ডিম ছোড়া, যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ না করে রাজনৈতিক আদর্শ, পরিচিতি ও স্বজনপ্রীতিভিত্তিক নিয়োগ, বিরোধী দলের সমর্থক আইনজীবীদের কোণঠাসা করার প্রবণতা ও অপরাপর বিদ্বেষমূলক আচরণ আদালতের আদর্শ চিত্রকে শুধু নষ্টই করে দেবে দিন দিন।
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেছিলেন, ঞযব চষধহবঃ ফড়বং হড়ঃ হববফ সড়ৎব ংঁপপবংংভঁষ ঢ়বড়ঢ়ষব. ঞযব চষধহবঃ ফবংঢ়বৎধঃবষু হববফং সড়ৎব ঢ়বধপবসধশবৎং, যবধষবৎং, ৎবংঃড়ৎবৎং, ংঃড়ৎুঃবষষবৎং ধহফ ষড়াবৎং ড়ভ ধষষ শরহফং.
আমাদের আজ শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী, ক্ষত সারাতে সক্ষম ইতিবাচক আবেগের ও দায়িত্বশীল মানসিকতার মানুষ বড্ড বেশি প্রয়োজন। জ্বালাও-পোড়াও আর ভাঙনের হিসাব খাতা একটু বেশিই দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। অতীতের আমাদের নিজেদের রেকর্ড নিজেরাই ছাড়িয়ে যাচ্ছি।
একবার ভাবুন, আপনি বাংলাদেশি নন। অন্য কোনো দেশের সচেতন নাগরিক। তখন এরকম মারামারি ধরাধরি দেখে এ দেশের মানুষকে কী মাপকাঠিতে বিচার করবেন?
নিজেদের জন্য নিজেদেরই দাঁড়াতে হয়। তার জন্য দরকার হয় একতা। তাকিয়ে দেখুন ফিলিস্তিনের দিকে। কোনো দেশ ঘোষণা দিয়ে কি দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে? না। আজ তাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। ইউক্রেনের অবস্থাও গাছে তুলে মই সরিয়ে নেওয়ার মতো।
কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ দেশের থেকে বড় নিশ্চয় নয়! যার যে রাজনৈতিক মতাদর্শই হোক না কেন, আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। আদর্শগত পার্থক্য থেকে সহাবস্থানকারীদের সাথে চিরশত্রুতা প্রতিষ্ঠা করা মোটেও সুবুদ্ধি কিংবা মর্যাদার বিষয় নয়। ‘ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ’ লেগে থাকলে ঘরটা ভেঙে যায়। এভাবে বিবাদ লেগে থাকলে আমাদের ঘরটিও একদিন তার সব ঐতিহ্য হারাবে।
আসুন, অতীতের যে কোনো সময়ের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডকে গাইডলাইন না বানাই। নিজেদের ইউনিটি বজায় রাখি। আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত শক্তিশালী অঙ্গ। আমরা যদি একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারি, একে অন্যের পাশে সুবিবেচনার সাথে দাঁড়াই, তবেই এ প্রতিষ্ঠান ন্যায়কার্যে গতি পাবে এবং একইসাথে শক্তি, মর্যাদা ও পরিচ্ছন্নতা অক্ষুণ্ন থাকবে।
ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বিচারের তীর্থস্থান হোক আমাদের এই সাদা দালানের ঘর, প্রতিহিংসার দুষ্ট চক্র ভাঙার শুরুটাও হোক এখানেই। লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট