ঢাকা ০১:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিরোধ ও মানবিকতার প্রতীক উইনি ম্যান্ডেলা

  • আপডেট সময় : ০৭:৫১:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

নারী ও শিশু ডেস্ক: দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে স্বাধীনতা, প্রতিরোধ ও মানবিকতার প্রতীক হয়ে আছেন উইনি ম্যান্ডেলা। তিনি কেবল নেলসন ম্যান্ডেলার স্ত্রী নন; বরং নিজ গুণে ও সংগ্রামে ছিলেন বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক অনন্য নেত্রী; যাকে আজও ‘মাদার অব দ্য নেশন’ বলে স্মরণ করা হয়।

শৈশব ও শিক্ষা: উইনি মাদিকিজেলা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার এমবংগেনিতে। তার বাবা ছিলেন শিক্ষক এবং মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার পরিবেশে বড় হন। কৈশোরেই তিনি বুঝতে শিখেছিলেন বর্ণবৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। পরবর্তীকালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই সময় কৃষ্ণাঙ্গ নারীর জন্য উচ্চশিক্ষা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু উইনি তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও মেধার জোরে তা সম্ভব করে দেখান।

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে: ১৯৫৭ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক বছর পর ১৯৫৮ সালে তারা বিয়ে করেন। এই সম্পর্ক উইনিকে রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। ম্যান্ডেলা কারাগারে যাওয়ার পর উইনি হয়ে ওঠেন আন্দোলনের মুখপাত্র ও চালিকাশক্তি।

নেলসন ম্যান্ডেলা যখন ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন, উইনি বাইরে থেকে তার নামে আন্দোলন চালিয়ে যান। পুলিশের নির্যাতন, গৃহবন্দিত্ব, একের পর এক গ্রেফতার ও হয়রানি সবকিছুই সহ্য করেছেন। তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, গৃহবন্দি হয়েছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোয় উইনি দারিদ্র্যপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থেকেছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন ‘অপরাজেয় নারী’, এক অগ্নিশিখা; যাকে থামানো যায়নি।

বিতর্ক ও সমালোচনা: উইনি ম্যান্ডেলার জীবন কেবল আলোতেই ভরা নয়, অন্ধকার দিকও রয়েছে; বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকে তার নেতৃত্বাধীন ‘ম্যান্ডেলা ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব’ নামে একটি গোষ্ঠী সহিংসতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। যদিও তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়, তবুও এই অধ্যায় তার ভাবমূর্তিকে আঘাত করেছিল। এ ছাড়া নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির পর তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

রাজনীতি ও নেতৃত্ব: আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন উইনি। মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারে তিনি সামাজিক কল্যাণ বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তবুও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং অঘঈ-এর ভেতরে প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।

সম্মান ও উত্তরাধিকার: সব বিতর্ক সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষ তাকে দেখতেন তাদের ‘মা’ হিসেবে। তার স্পষ্টভাষী অবস্থান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অধিকার রক্ষায় অবদান তাকে জাতির ‘মাদার অব দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করে।

২০১৮ সালের ২ এপ্রিল উইনি ম্যান্ডেলা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাকে জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে সম্মান জানায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় এই সংগ্রামী নারীকে।

উইনি ম্যান্ডেলা ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নারী হয়েও নেতৃত্বের আসনে আসা সম্ভব- যদি সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে। ব্যক্তিগত জীবনের ভাঙন সত্ত্বেও তিনি জাতির লড়াই থেকে সরে যাননি।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

প্রতিরোধ ও মানবিকতার প্রতীক উইনি ম্যান্ডেলা

আপডেট সময় : ০৭:৫১:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

নারী ও শিশু ডেস্ক: দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে স্বাধীনতা, প্রতিরোধ ও মানবিকতার প্রতীক হয়ে আছেন উইনি ম্যান্ডেলা। তিনি কেবল নেলসন ম্যান্ডেলার স্ত্রী নন; বরং নিজ গুণে ও সংগ্রামে ছিলেন বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক অনন্য নেত্রী; যাকে আজও ‘মাদার অব দ্য নেশন’ বলে স্মরণ করা হয়।

শৈশব ও শিক্ষা: উইনি মাদিকিজেলা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার এমবংগেনিতে। তার বাবা ছিলেন শিক্ষক এবং মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার পরিবেশে বড় হন। কৈশোরেই তিনি বুঝতে শিখেছিলেন বর্ণবৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। পরবর্তীকালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই সময় কৃষ্ণাঙ্গ নারীর জন্য উচ্চশিক্ষা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু উইনি তার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও মেধার জোরে তা সম্ভব করে দেখান।

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে: ১৯৫৭ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক বছর পর ১৯৫৮ সালে তারা বিয়ে করেন। এই সম্পর্ক উইনিকে রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। ম্যান্ডেলা কারাগারে যাওয়ার পর উইনি হয়ে ওঠেন আন্দোলনের মুখপাত্র ও চালিকাশক্তি।

নেলসন ম্যান্ডেলা যখন ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন, উইনি বাইরে থেকে তার নামে আন্দোলন চালিয়ে যান। পুলিশের নির্যাতন, গৃহবন্দিত্ব, একের পর এক গ্রেফতার ও হয়রানি সবকিছুই সহ্য করেছেন। তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, গৃহবন্দি হয়েছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোয় উইনি দারিদ্র্যপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থেকেছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন ‘অপরাজেয় নারী’, এক অগ্নিশিখা; যাকে থামানো যায়নি।

বিতর্ক ও সমালোচনা: উইনি ম্যান্ডেলার জীবন কেবল আলোতেই ভরা নয়, অন্ধকার দিকও রয়েছে; বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকে তার নেতৃত্বাধীন ‘ম্যান্ডেলা ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব’ নামে একটি গোষ্ঠী সহিংসতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। যদিও তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়, তবুও এই অধ্যায় তার ভাবমূর্তিকে আঘাত করেছিল। এ ছাড়া নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির পর তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

রাজনীতি ও নেতৃত্ব: আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন উইনি। মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারে তিনি সামাজিক কল্যাণ বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তবুও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং অঘঈ-এর ভেতরে প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।

সম্মান ও উত্তরাধিকার: সব বিতর্ক সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষ তাকে দেখতেন তাদের ‘মা’ হিসেবে। তার স্পষ্টভাষী অবস্থান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অধিকার রক্ষায় অবদান তাকে জাতির ‘মাদার অব দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করে।

২০১৮ সালের ২ এপ্রিল উইনি ম্যান্ডেলা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাকে জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে সম্মান জানায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় এই সংগ্রামী নারীকে।

উইনি ম্যান্ডেলা ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নারী হয়েও নেতৃত্বের আসনে আসা সম্ভব- যদি সাহস ও আত্মবিশ্বাস থাকে। ব্যক্তিগত জীবনের ভাঙন সত্ত্বেও তিনি জাতির লড়াই থেকে সরে যাননি।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ