বিশেষ সংবাদদাতা : ম-পে ম-পে এখন চলছে প্রতিমা সাজানোর শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। দেবীকে সাজাতে ও আরাধনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটায় সরগরম পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার। পূজার যাবতীয় অনুষঙ্গ কেনাকাটায় শাঁখারীবাজারের খ্যাতি রয়েছে। দুর্গাপূজা ছাড়াও সব ধরনের পূজা, ধর্মীয় আচারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে সারা বছর ক্রেতারা ভিড় জমান শাঁখারীবাজারের দোকানগুলোতে। সারি সারি দোকান। কম দামের বেশি দামের, সবকিছুই মেলে এখানে। সরেজমিন শাঁখারীবাজার ঘুরে দেখা যায়, পূজা ও প্রতিমা-সামগ্রীর দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন ক্রেতারা। ভিড় সামলাতে টালমাটাল অবস্থা দোকানিদের। কেউ কিনছেন প্রতিমার জন্য শাড়ি-গহনা, কেউ অস্ত্রশস্ত্র, আবার কেউ বা কিনছেন মুকুট। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত, কোনও কোনও দিন রাতভর চলছে কেনাকাটা। পাইকারি ও খুচরা বেচাকেনায় জমজমাট শাঁখারীবাজার। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেবী দুর্গাকে সাজাতে শাড়ি, মুকুট, টোপর, হার, চূড়া, কানের দুল, নূপুর ইত্যাদি লাগে। সব মিলিয়ে সেট হিসেবে বিক্রি হয়। এক সেট গহনার দাম ১৫০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ‘মা বাসন্তী ভা-ারে’ দেখা গেলো গহনা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন দোকানের স্বত্বাধিকারী শংকর সরকারসহ তিন-চার জন কর্মী। শংকর ৪০ বছর ধরে এই গহনা তৈরির কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘গহনা তৈরির পাথর, পুঁতিসহ বিভিন্ন উপকরণ আসে ভারত থেকে।’ তিনি জানান, একটি মুকুটের দাম ২০০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। গহনার সেট ৫০০ থেকে ১৫ হাজার। দাম নির্ভর করে ডিজাইনের ওপর।’ প্রতিমাকে পরানো হয় ঝলমলে রঙিন সব পোশাক। এসব পোশাকের কাপড় গজ হিসেবে বিক্রি হয়। প্রতি গজ কাপড়ের দাম ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া বিক্রি হয় কৃত্রিম চুল, কেজি হিসেবে। প্রতিকেজি চুলের দাম ৩০০ টাকা। সাজঘরের স্বত্বাধিকারী অপূর্ব দে বলেন, ‘শেষ সময়ে বিক্রি অনেক ভালো। তিন জন কর্মচারী নিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছি না। পূজার শুরুতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাস্টমার এসেছে। এখন ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে লোক আসছে।’ সাজঘরে দেবীর শাড়ি, অন্য প্রতিমার শাড়ি, ধুতি, চুল, গহনা সেট বিক্রি করেন বলে তিনি জানান।
রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা রুপঙ্কর সাহা বলেন, ‘প্রতিমার কাজ শেষ। এখন সাজসজ্জার অনুষঙ্গ কিনতে এখানে এসেছি। প্রতিমার জন্য শাড়ি, কাপড়, চুল, গহনা, অস্ত্র কিনতে হবে।’
পূজাকে কেন্দ্র করে কাঁসা বা পিতলের দোকানেও ভিড় দেখা যায়। কাঁসা ও পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস বিক্রি হচ্ছে ওজন দরে। পিতলের কেজি এক হাজার থেকে ১২শ টাকা এবং কাঁসার কেজি ১৬শ থেকে ১৭শ টাকা।
৪০১ প্রতিমা নিয়ে দুর্গাপূজার বৃহৎ আয়োজনে রাজ মন্দির
বরিশাল সংবাদদাতা জানান, ৪০১টি প্রতিমা নিয়ে গোটা বরিশাল বিভাগে সব থেকে বড় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কবুতরখালীর রাজ মন্দিরে। এরই মধ্যে প্রতিমা তৈরিসহ পূজার আয়োজনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আয়োজকরা জানান, বিগত তিন মাস ধরে ছয়জন সহযোগীকে নিয়ে ছয়জন শিল্পী রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ কাজ শেষ করেছেন। এবারের আয়োজনে বিগত বছরের সঙ্গে নতুন অনেক কিছুই যুক্ত হচ্ছে। যেমন বিগত বছরগুলোর মতো এবারও দুর্গাপূজা যে কয়দিন চলবে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোকের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা রাখা হবে। দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষদের জন্য খাবারের পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হবে। অসহায়, দুস্থ নারীদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ এবং দরিদ্র-মেধা ও কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া মন্দির এলাকায় থাকছে চিকিৎসা ক্যাম্প ও শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্যচিত্র নিয়ে বই কর্নার বা লাইব্রেরি স্থাপনের পাশাপাশি পদ্মা সেতু স্পেনের আদলে বানানো গ্যালারিতে লোকসংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাজ মন্দিরের বৃহৎ পূজার উদ্যোক্তা ডা. সুদীপ কুমার হালদার বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী ডা. স্নিগা চক্রবর্তী এ বৃহৎ পূজার আয়োজনের উদ্যোক্তা। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন-বোন জামাই মিলেই সবকিছু ম্যানেজ করছেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর রাজ মন্দিরের দুর্গাপূজার আয়োজনে কয়েক লাখ লোকের সমাগম ঘটে। আর আসাদের সেবায় ডাক্তার বাড়ির সব লোকজন নিজেদের নিয়োজিত করেন। গত একমাস ধরে আমাদের ৩০ জন আত্মীয়-স্বজন পূজার আয়োজনকে কেন্দ্র করে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সুদীপ কুমার হালদার বলেন, এবারও সার্বিক নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ নিজস্ব শতাধিক ভলানটিয়ার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। পূজা শুরুর দিন থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রসাদের ব্যবস্থা করা হবে। রাজ মন্দিরের পাশেই নারী ও শিশুদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কাউন্সেলিং পয়েন্ট ও ফ্রি স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, পূজা চলাকালে টানা চারদিন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্গাপূজার এ আয়োজনে মন্দিরে ৪০১টি প্রতিমা রয়েছে এবার। যেখানে মহাভারত, রামায়নের সমস্ত পৌরাণিক কাহিনি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মন্দিরের সীমানায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখা মিলবে কৃষ্ণের রাসলীলা, তার নিচেই রয়েছে লোকসংস্কৃতি, ডান পাশে থাকবে আদি শক্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এদের প্রতিমা। এরপর মা কালী মন্দির, এরপরেই কৃষ্ণসহ বিভিন্ন প্রতিমা। পুরো মন্দির ঘুরে অনেক কিছুই দেখতে পাবেন এখানে। ঐতিহাসিক অনেক কিছুই রয়েছে।
সুদীপ কুমার হালদার বলেন, আমাদের এখানে মা দুর্গার প্রতিমা, মা সরস্বতীর মন্দির, মতুয়া ধাম, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রক্ষ্মচারীর মন্দির, মা মনসার মন্দির, ধর্মরাজ জমরাজের প্রতিমাও রয়েছে।
রাজ মন্দিরের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বাবু শৈলেশ্বর হালদার বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও আমরা চাই উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে পূজার আয়োজন শেষ করতে। এরই মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে।
অপর আয়োজক নমিতা হালদার বলেন, তার চার সন্তানসহ স্বজনদের অংশগ্রহণে কয়েক বছর ধরে বৃহৎ আকারে রাজ মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন চলছে। আমাদের এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসেন পূজা দেখতে। রাজ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক পলাশ গাইন বলেন, এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য প্রথমে দাদা-বৌদি (চিকিৎসক দম্পতি) মাত্র ৪১ খানা প্রতিমা দিয়ে এ কবুতরখালী গ্রামের ডাক্তার বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু করেছিল, যা ধীরে ধীরে আজ ৪০১ খানা প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, নিজের ইচ্ছে ও বাবার মানত পূরণ করার লক্ষ্যে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ডা. সুদীপ কুমার হালদার কবুতরখালীর ডাক্তার বাড়ির রাজ মন্দিরে গত ২০১৬ সালে ৪১টি প্রতিমা দিয়ে প্রথম বৃহৎ আকারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এরপরের বছর একশ ও পরের বছর আড়াইশ প্রতিমা নিয়ে দুর্গাপূজার আয়োজনের আকার বড় হতে থাকে। পূজাম-প এলাকায় বাহারি রঙের আলোকসজ্জার মধ্যেই সাজানো হয়েছে প্রতিমাগুলো।