লাইফস্টাইল ডেস্ক: প্রতিদিনের রান্নায় আমরা সাধারণত সরিষার তেল অথবা সয়াবিন তেল ব্যবহার করি। তবে তুলনামূলকভাবে সরিষার তেলের চেয়ে সয়াবিন তেল বেশি ব্যবহার করি।
কিন্তু কোন তেলে আমাদের জন্য উপকারী বা একজন ব্যক্তির প্রতিদিন কতটা তেল খাওয়া উচিত? পাঠকদের এসব প্রশ্নের উত্তর জানাতে সংবাদমাধ্যমের কথা বলেছেন আল্-হায়াত হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কনসালটেন্ট ডায়টেশিয়ান ও পুষ্টিবিদ মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল।
সরিষার তেল ও সয়াবিন তেলের মূল পার্থক্য ও পুষ্টিগুণ বিষয়ে আলোচনা করেন তিনি-
১. সরিষার তেল ও সয়াবিন তেলের মূল পার্থক্য কী?
সয়াবিন তেল ও সরিষার তেল — দুইটিই আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয় ভোজ্য তেল, কিন্তু এদের উপাদান ও পুষ্টিগুণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। পার্থক্যগুলো বোঝার আগে স্যাচুরেটেড ফ্যাট সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে। এই রান্নার তেলগুলোতে মূলত তিন ধরণের চর্বি আছে – মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট।
মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হলো এক ধরনের ভালো চর্বি, যা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটও উপকারী চর্বি, যা শরীরের কোষের গঠন ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট হলো ঘন ধরনের চর্বি, যা বেশি পরিমাণে খেলে রক্তে চর্বি জমে হার্টের সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
সয়াবিন তেলে এই স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে ১৬ শতাংশ, আর সরিষার তেলে ১২ শতাংশ। সে হিসেবে সরিষার তেলে ক্ষতিকর চর্বি সয়াবিন তেলের চেয়ে কিছুটা কম।
অন্যদিকে মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট একসঙ্গে ভালো চর্বি হিসেবে দেখলে, সয়াবিন তেলে তা আছে ৮১ শতাংশ, সরিষার তেলেও ৮১ শতাংশ। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়?
পার্থক্যটা মূলত অন্যান্য উপাদানে। সয়াবিন তেলে ভিটামিন ই, ফাইটোস্টেরল – যা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে ও ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। অন্যদিকে সরিষার তেলে ওমেগা–৩ ও ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভারসাম্যপূর্ণ অনুপাত থাকে। আবার ভিটামিন ই-এর সঙ্গে থাকে অ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট – যার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ আছে।
২. শরীরে ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে কোন তেল বেশি উপকারী?
পুষ্টিবিদ মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল বলছেন, শরীরে ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়ানোর ক্ষেত্রে সয়াবিন তেলের তুলনায় সরিষার তেল অনেক বেশি উপকারী। সরিষার তেলে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা রক্তে ভাল কোলেস্টেরল বৃদ্ধি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এতে থাকা ভিটামিন ই হার্টকে সুরক্ষা দেয়, রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে এবং শরীরের প্রদাহ কমায়। অন্যদিকে, সয়াবিন তেলে ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিড তুলনামূলক বেশি, যা এইচডিএল কিছুটা বাড়ালেও অতিরিক্ত গ্রহণে শরীরে প্রদাহ ও চর্বি জমার প্রবণতা বাড়াতে পারে। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে সরিষার তেল সয়াবিন তেলের চেয়ে বেশি উপকারী ও নিরাপদ।
৩. তাহলে রান্নায় প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য কি সরিষার তেল বেশি ভালো?
রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারি, তবে পরিমাণটা এখানে ঠিক রাখা জরুরি। রান্নায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করলে সরিষার তেলও ক্ষতিকর হতে পারে। রান্নার সময় এর প্রাকৃতিক ঝাঁজ খাবারে এক বিশেষ স্বাদ ও গন্ধ যোগ করে, যা হজমেও সহায়তা করে। তবে একই তেল বারবার গরম করলে এর উপকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৪. শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে কোন তেল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর?
শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে চাইলে সয়াবিন তেল বেশি ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেন আরিফ ইকবাল। সয়াবিন তেলে ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক বেশি, কিন্তু ওমেগা–৩ কম থাকায় শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং খারাপ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন বেশি পরিমাণে সয়াবিন তেল খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অন্যদিকে সরিষার তেলে ওমেগা–৩ ও ওমেগা–৬ এর অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ এবং এতে থাকা মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে সাহায্য করে। তাই হার্টের জন্য সরিষার তেল সয়াবিন তেলের তুলনায় বেশি উপকারী ও নিরাপদ।
৫. প্রতিদিন একজন মানুষের কতটুকু তেল খাওয়া নিরাপদ?
সরিষার তেলের গুণাগুণ পেতে সঠিক পরিমাণে ব্যবহারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে – সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য দিনে প্রায় ৩–৪ চা চামচ বা ১৫–২০ মিলিলিটার এবং নারীদের জন্য ২–৩ চা চামচ বা ১০–১৫ মিলিলিটার তেল খাওয়াই যথেষ্ট।
এর বেশি তেল গ্রহণ করলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে ওজন বৃদ্ধি, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ আছে, তাদের জন্য তেলের পরিমাণ আরো কম রাখা উচিত।
রান্নায় কম তেল ব্যবহার করা, খাবার অতিরিক্ত না ভাজা এবং মাঝে মাঝে তেলের ধরন পরিবর্তন করা — যেমন সরিষা, অলিভ বা সয়াবিন তেল পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা শরীরের জন্য উপকারী। তাই সুস্থ থাকতে প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে তেল ব্যবহার করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
এসি/আপ্র/১৫/১০/২০২৫