প্রত্যাশা ডেস্ক : নদীতে মাছের আনাগোনা থাকলেও এবার ‘প্রকৃতির বৈরিতায়’ গতবারের তুলনায় এক চতুর্থাংশ ডিম মিলেছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায়। প্রাথমিক হিসেবে এবার সাড়ে ৬ হাজার কেজির মত ডিম মিলেছে, যেখানে গতবছর পাওয়া গিয়েছিল ২৫ হাজার কেজি।
প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম ডিম পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, অনুকূল পরিবেশ পেলে জুনে হয়ত আবার ডিম ছাড়তে পারে মা মাছ। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে উপযুক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততায় অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ।এবার হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়া শুরু হয় বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে। ওই সময় থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ নৌকা নিয়ে দেড় হাজারের মত সংগ্রহকারী হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার মধ্যেই ডিম সংগ্রহ শেষ হয়ে যায়।
হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা এলাকার ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া গতকাল শুক্রবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সাতটি নৌকা নিয়ে মাত্র আড়াই বালতি ডিম পেয়েছি। শুধু আমি একা না, সবার একই অবস্থা। আমরা খুব হতাশ। এবার মাছের আনাগোনা ভালো ছিল। কিন্তু ততটা ডিম ছাড়েনি।’
ডিম সংগ্রহকারী এবং হালদা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃষ্টি হয়নি বলে পাহাড়ি ঢল ছিল না। কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার পরিমাণও ছিল কম। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদী হয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে ঢুকেছে।
ফলে লবণাক্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭২ গুণ বেশি ছিল জানিয়ে হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, এই সব কিছু প্রভাব পড়েছে মাছের ডিম ছাড়ার ক্ষেত্রে। হালদা পাড়ের দুই উপজেলার মধ্যে হাটহাজারীতে তিনটি এবং রাউজানে একটি সরকারি হ্যাচারি আছে। পাশাপাশি দুই উপজেলায় মাটির কুয়া আছে মোট ১৬৫টি। এসব হ্যাচারি ও কুয়াতে চলছে নিষিক্ত ডিম ফুটিয়ে রেণু সংগ্রহের কাজ। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলি জানান, ডিম ও রেনুর পরিমাণ নির্ধারণে গঠিত সরকারি কমিটির চূড়ান্ত হিসাব মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা হবে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রাথমিক হিসেবে এবার ৬ হাজার ৫০০ কেজির মত ডিম মিলেছে বলে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া জানান।
রাউজান উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা পীযূষ প্রভাকর বলেন, ‘মোবারকখিল হ্যাচারিতে ৭০০ কেজির মত ডিম এসেছে। এবার ডিম সংগ্রহ কম। আজিমের ঘোনার দিকে যারা ছিলেন, তারা কিছু ডিম পেয়েছেন। নাপিতের ঘোনা থেকে ভাটির দিকে যারা ছিলেন, তারা বলতে গেলে ডিমই পাননি।’ তার হিসাবে নৌকা প্রতি সংগ্রহ গড়ে এক থেকে দেড় কেজি। সংগ্রহকারীদের অনেকে শূন্য হাতেও ফিরেছেন।
‘মা মাছ ডিম ছাড়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকে জোয়ার শুরু হয়। এতে কিছু ডিম নদীর সাথে যুক্ত খালগুলোতে ভেসে যায়। বৃষ্টি না হওয়ায় পানির তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে আমরা অনুকূল তাপমাত্রা বলি।’
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে লবণ পানি নদীতে প্রবেশের পাশাপাশি হালদা পাড়ের কিছু মাটির কুয়াও ভাসিয়ে নিয়েছে বলে পীযূষ প্রভাকর জানান।
হাটাহাজারী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি বলেন, ‘মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ১১২ বালতি, শাহ মাদারি হ্যাচারিতে ৯১ বালতি এবং মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৭৭ বালতি ডিম এসেছে। ডিম ফুটানো শুরু হয়েছে। রেণুর মান ভালো। রোববার থেকে রেণু বিক্রি শুরু হবে।’
প্রতি বালতি ১২ কেজি হিসেবে এই তিন হ্যাচারিতে ৩ হাজার ৩৬০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। রনিরও বলছেন, ইয়াসের প্রভাবে হওয়া অস্বাভাবিক জোয়ারের সময় মা মাছ ডিম ছাড়ায় তার একাংশ ভেসে গেছে। ‘এবার বৃষ্টি হয়নি। পাহাড়ি ঢলও ছিল না। তারপরও জোয়ারে অতিরিক্ত পানির প্রবাহের কারণে মা মাছ ডিম ছেড়েছে বলে ধারণা করছি।’
তবে ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া বলছেন, ‘নদীতে প্রচুর নৌকা ছিল। ডিম খালে গেলেও আমরাই পেতাম। ডিম আসলে বেশি দেয়নি। আশা করছি, জুনে আরো একবার মা মাছ ডিম ছাড়বে।’
গতবছর এ মৌসুমে হালদা থেকে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছিল জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ছিল ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের ২৫ মে রাতে মা মাছ ডিম ছাড়ার পর প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজি রেণু মিলেছিল। ৮০ হাজার টাকা কেজি দরে ওই রেণুর বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি।
হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এ বছর হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা এবং হালদা নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডিম সংগ্রহ নিয়ে ‘অন্যরকম প্রত্যাশার’ সৃষ্টি হয়েছিল।
‘গত ২১ বছরের মধ্যে হালদার পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং মাছ রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এত সফলতার পরও পরিবেশগত দুটো প্যারামিটার সব হিসাব ওলটপালট করে দিয়েছে। তাই ডিমের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল আসেনি।’
তবে উজানে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হলে হালদার মাছের দ্বিতীয়বারের মতো ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানালেন মনজুরুল কিবরিয়া। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলিও বলেন, হালদায় এবার মাছের আনাগোনা ছিল উল্লেখযোগ্য। ডিম পরিপক্ক হলে মাছের পক্ষে তা পেটে রাখা কঠিন। অনুকূল পরিবেশ পেলেই কার্প জাতীয় মাছ ডিম ছেড়ে দেয়। ডিম ছাড়তে না পারলে মাছের পেটেই তা শুঁকিয়ে যায়। তাতে মা মাছের মৃত্যুও হতে পারে।
‘এপ্রিল-আগস্ট হল কার্প জাতীয় মাছের ব্রিডিং টাইম। তবে হালদায় মা মাছ জুনের পর ডিম ছাড়ে না। জুনে আরও দুটি জো (অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথি) আছে। গত বছর ২০ জুন দ্বিতীয়বার ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। আশা করি এবারও দ্বিতীয় দফা ডিম ছাড়বে।’
দ্বিগুণ ভাড়ায় যাত্রী কম, মাস্ক পরায় অনীহা
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় সরকার গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে। মানতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। এর বিপরীতে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। তবে অনেকেই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। যাত্রীদের মাস্ক পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এখনো ঢিলেঢালা ভাব বজায় রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সায়েদাবাদ ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার বাসে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সকালে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। তবে যাত্রী ছিল কম।
সিলেটে যেতে আল-মোবারাকা বাসের টিকিট কেটেছেন মিনা আক্তার। তিনি বলেন, আগে একই বাসে ৩৫০ টাকায় সায়েদাবাদ থেকে সিলেট যেতাম। আজ ৫৫০ টাকা নিয়েছে। সিলেটগামী ননএসি বাসের জনপ্রতি ভাড়া ৪৭০ টাকার পরিবর্তে ৭৫০ টাকা করে নিচ্ছে হানিফ পরিবহন। কুমিল্লাগামী তিশা এক্সক্লুসিভ বাসের যাত্রী আবুল কালাম বলেন, ১৫০ টাকার ভাড়া ২৫০ টাকা নিয়েছে। কুমিল্লার লাকসামের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছিল তিশা পরিবহন। বাসের যাত্রী আব্দুর রহিম বলেন, বাসে যাত্রী ছিল অর্ধেক। আগে জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়া ছিল। আজ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা।
তিশা বাসের সহকারী মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বাস বন্ধ থাকায় যাত্রী কমে গেছে। ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়েও লোকসান গুণতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অনেক যাত্রী বাড়ি যেত। অথচ আজ যাত্রী অনেক কম। আগে দুই যাত্রীর কাছ থেকে পেতাম ৪০০ টাকা। এখন দুই সিটে এক যাত্রী দিচ্ছে ৩২০ টাকা। তিশা বাসের যাত্রী রোকসানা বলেন, মাস্ক পরে ছিলাম। এখন মাথাব্যথা করছে। তাই খুলে রেখেছি।
নোয়াখালীর যাত্রী রাকিব বলেন, সায়েদাবাদ থেকে লাল-সবুজ পরিবহনে (এসি বাস) বাড়ি যাচ্ছি। করোনার আগে জনপ্রতি ৪০০ টাকা ভাড়া ছিল। এখন ৬৪০ টাকা নেওয়া হয়েছে। একই কোম্পানির ননএসি বাসে ভাড়া ছিল জনপ্রতি ৩০০ টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে ৪৮০ টাকা।
হানিফ পরিবহনের যাত্রী আবুল বকর রোমান বলছিলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম নন এসি বাসের ভাড়া ছিল ৪৮০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৭৪০ টাকা হয়েছে। এসি বাসের ভাড়া বিজনেস ক্লাসে ৭০০ টাকা ছিল। এখন ১১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
হানিফ পরিবহনের হেলপার নোমান হোসেন বলেন, লকডাউনে বাস বন্ধ থাকায় এক মাসের বেশি সময় খুব কষ্ট করেছি। বাস বন্ধ থাকায় ৪০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। বাস চলায় প্রতিদিন ৪০০ টাকা পাচ্ছি। ৬০ শতাংশ ভাড়ার কারণে যাত্রী কম। হানিফ পরিবহনের সায়েদাবাদ কাউন্টারের ম্যানেজার আবুল কাশেম বলেন, যাত্রী কম। ভাড়া বাড়ায় মানুষ বাড়তি টাকা দিতে চাচ্ছে না। এই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এসআই রহমান বলেন, আমরা মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে দিচ্ছি। যারা মানছে না তাদের সচেতন করতে মাস্ক দিচ্ছি।
প্রকৃতির বৈরিতায় হালদায় ডিম মিলেছে গতবারের এক চতুর্থাংশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ